ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

ডুব নিয়ে বিভ্রান্তি!

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২ মার্চ ২০১৭

ডুব নিয়ে বিভ্রান্তি!

১৮ মার্চ ২০১৬ মোস্তফা সরয়ার ফারুকী প্রথম ঘোষণা দেন তিনি একটি নতুন ছবি করছেন, নাম ‘ডুব’। ওইদিন মহরতে চমক হিসেবে হাজির হন বলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা ইরফান খান। সঙ্গে কলকাতার পার্নো মিত্র। এতসব তারকা দর্শককে বেশ আগ্রহীই করে পরবর্তীতে গত বছরেই ৪ নবেম্বর ভারতের প্রভাবশালী বাংলা পত্রিকা আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয় একটি খবর যার শিরোনাম ছিল- ‘হূমায়ন আহমেদের চরিত্রে ইরফান? কিন্তু এত লুকোছাপা কেন?’ মূলত এই খবরের সূত্র ধরেই প্রথম বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় ওঠে। তৈরি হয় তুমুল বিতর্ক। প্রতিবাদ ওঠে হূমায়নপতœী মেহের আফরোজ শাওনের পক্ষ থেকে। ফেসবুক দেয়ালে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে হূমায়ন ভক্তদের। কারণ দুটি। প্রথম কারণ, নন্দিত সাহিত্যিক-নির্মাতা হূন আহমেদের জীবনের একটি অংশ নিয়ে ছবিটি নির্মাণের খবর জানা গেলেও এ বিষয়ে পরিবারের কোন সদস্যের কাছ থেকে। অনুমতি নেয়া হয়নি দ্বিতীয়ত, এমন অভিযোগের বিপরীতে নির্মাতা ফারুকী বরাবরই বলে আসছেন- ‘ডুব ছবিটির গল্প হূমায়ন আহমেদের জীবন থেকে নেয়া নয়। এটা মৌলিক গল্প। তাই এটা নিয়ে বিতর্কেরও সুযোগ নেই। ছবির মূল চরিত্রের অভিনয়শিল্পী ইরফান খান শূটিংয়ের আগে হুমায়ূন আহমেদের প্রচুর ভিডিও দেখেছিলেন। এবং সেগুলো দেখেই হুমায়ূন আহমেদের কথাবার্তা বলার ধরন নিয়ে হোমওয়ার্ক করেছিলেন। গেল নবেম্বরে শুরু হওয়া এমন বিতর্কের মাঝে খানিক ভাটা পড়লেও সম্প্রতি একই ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম। সম্প্রতি ছবিটি তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রিভিউ কমিটিতে জমা পড়ে। একই সময়ে কমিটিতে মেহের আফরোজ শাওন একটি আপত্তিপত্র দেন । এর প্রেক্ষিতে ছবিটি মুক্তির বিষয়ে আপাতত স্থগিতাদেশ দেয়া হয় কমিটির পক্ষ থেকে। ফলে তৈরি হয় ছবিটি নিয়ে নতুন করে পুরনো বিতর্ক। এই স্থগিতাদেশের খবরটিও বাংলাদেশের মিডিয়া প্রথম জানতে পারে শুক্রবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পত্রিকা ভ্যারাইটির একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে। মূলত এই পত্রিকাটির মাধ্যমেই গেল বছর প্রথম জানা গেছে- ফারুকী-ইরফান খানের জোটবদ্ধতার কথা। এবার ওই পত্রিকাই প্রথম জানান দেয়, ‘বাংলাদেশ নিষিদ্ধ করেছে ইরফান খান অভিনীত ‘নো বেড অব রোজেস’! অন্যদিকে ছবিটি নিয়ে চলমান বিতর্ক প্রসঙ্গে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি রবিবার দুপুরে মেহের আফরোজ শাওন একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। তিনি বলেন ‘ডুব ছবিতে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বিভ্রান্তিকর অনেক তথ্য রয়েছে। তাই এই সিনেমা নিয়ে সেন্সর বোর্ডকে আমার আপত্তির কথা জানিয়েছি। আমাকে কেউ অপমান করলে সমস্যা নেই। কিন্তু মৌলিক কাহিনী দাবি করে কোন ছবির মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদকে অপমান করা হলে, তা মেনে নেব না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি হুমায়ূনের জীবনী নিয়ে ছবিটি বানানো না হয়ে থাকে, তাহলে তার জীবনের সঙ্গে ডুবের গল্প হুবহু মিলে গেল কেন? ছবিটিতে এমন একটি চরিত্র আছে, যার গাজীপুরে বাগানবাড়ি আছে, তার মেয়ের ক্লাসমেটকে সে বিয়ে করে। এগুলোতো সব হুমায়ূন আহমেদের জীবনে ঘটেছে। এতে আরও দেখানো হয়েছে তার দুটি সংসার আছে। এবং সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সেখানে হুমায়ূনের নাম ব্যবহার না করলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এটা হুমায়ূন আহমেদের জীবন নিয়েই তৈরি। তাই এত লুকোচুরি করা হয়েছে ডুব চলচ্চিত্রটি তৈরি করতে। ইতোমধ্যে এই সিদ্ধান্তের কারণে পক্ষে বিপক্ষে তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ঝড় উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এ বিতর্ককে আরও উস্কে দিয়েছেন ছবিতে অভিনয় করা কলকাতার শিল্পী পার্ণ মিত্র তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে। তিনি লিখেছেন, ‘ইরফানের সঙ্গে অভিনয় মানে ওয়ার্কশপ এ্যাডেন্ট করা। এ ছবিতেও মীরা নায়ারের নেমেসক’য়ের মতো বাঙালী এ্যাকসেন্টে ইংরেজী বলেছে ইরফান। শুধু সেটে ওর অভিনয় দেখাটাই একজন অভিনেতার কাছে বিরাট পাওয়া। আমার অভিনীত চরিত্রটির নাম মেহের আফারোজ শাওন।’ তবে পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘এই কয়েকটা বছর আমরা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় হেডলাইন হয়েছি পজিটিভ কারণে। আর আজকে হেডলাইন হলাম একটা খারাপ বিষয়ে। যে বা যারা সরকারকে বিভ্রান্ত করে এই কাজটা করিয়েছে তারা খুবই খারাপ করলেন। আমরা বিশ্বাস করি, এই স্থগিতাদেশ সাময়িক। সরকারের প্রতি আমাদের আস্থা আছে। আমরা কোন ধরনের কপি রাইট লঙ্ঘন বা কোন বেআইনী কাজ করিনি। এই নির্দেশের পেছনে কী কারণ রয়েছে, আমরা তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে তা জানতে চাইব। আমরা বিশ্বাস করি এই আদেশ অবিলম্বে প্রত্যাহার করা হবে। ছবিটি নিষিদ্ধ হলেও দেশীয় মাধ্যমে খবর প্রকাশের আগে ভারতের একটি ম্যাগাজিনের ওয়েবসাইটে নিষিদ্ধের খবর প্রকাশ হয়। খবরটি ফারুকী নিজেই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে দিয়েছেন বলে অনেকে বলছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, ছবির সহপ্রযোজক বলিউডের অভিনেতা ইরফান খানও কাজটি করতে পারেন। প্রযোজক হিসেবে তাকে যাবতীয় তথ্য জানানোর নিয়ম রয়েছে। সে হিসেবে পরিচালক তাকে হয়ত নিষিদ্ধের খবর জানিয়েছেন। আর তিনিই হয়ত ভুল তথ্য দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন। ওই ম্যাগাজিনের ওয়েবসাইটে ‘সার্টিফিকেট’ বাতিল বলে প্রকাশ করা হয়েছে। মূলত যৌথ প্রযোজনা কমিটি ছবি প্রিভিউ করার পর অনাপত্তিপত্র দিলে সেটি সেন্সরের জন্য জমা দেয়া হয়। সেন্সরে জমা পড়ার আগেই কীভাবে সার্টিফিকেট বাতিল হয়? বিদেশী সংবাদমাধ্যমে কেন ভুল সংবাদ প্রদান করা হলো সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ। তা ছাড়া দেশীয় সংবাদমাধ্যমকে উপেক্ষা করে বিদেশী সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ করার জন্য ফারুকীর কড়া সমালোচনা করেছেন অনেকে। চলচ্চিত্র নির্মাতা মুরাদ পারভেজ তার ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে বলছেন, ‘ডুব’ চলচ্চিত্র নিয়ে ক’দিন বেশ কিছু আজাইরা জাত গেল- জাত গেল আকুতি শুনছি। চলছে স্যোশাল মিডিয়ায় তুমুল আলোচনা। এতে করে কার কি লাভ হচ্ছে জানি না ফারুকীর যে লাভ হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ফ্রি ফ্রি পাবলিসিটি যা ডুবকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে সহজেই। হতে পারে এটা ফারুকীর সিনেমা মার্কেটিং এর নতুন পলিসি। যা ফারুকী চমৎকারভাবে রপ্ত করেছেন। ওই স্ট্যাটাসে মুরাদ পারভেজ ‘ডুব’ সিনেমাকে হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক নয়- বলে উল্লেখ করেছেন। প্রমাণ টেনেছেন বিস্তর। তিনি লিখেছেন, ‘ডুব সিনেমাটা কোনভাবেই হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক নয় তার প্রধান প্রমাণ যে ডুব চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রের নাম হুমায়ূন আহমেদ নয় জাভেদ হাসান। যদি এটা বায়োপিক হতো তাহলে কোনভাবেই নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের নামজুড়ে দেবার যৌক্তিক লোভ সংবরণ করতে পারতেন না। এমনও হতে পারে যে ফারুকী কোনভাবে হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিজীবন থেকে ‘ডুব’ করতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আর যদি তাই হয় তাহলে সেটার জন্য কারো অনুমতি দরকার পড়ে না। কাজেই পাতা নড়েছে বলেই বাঘ এসেছে ধরে নেবার কোন কারণ নেই। তাছাড়া এমন নয়ত যে একজন হুমায়ূন আহমেদের জীবনে যা ঘটেছে তেমনটা আর কারও জীবনে ঘটেনি? তিনিই প্রথম দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন? তাতো নয়? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসে তৎকালীন সময়ে বিখ্যাত অনেকের গল্প বলেছেন। অন্যদিকে কেউ কেউ শাওনেরও সমালোচনা করে বলেছেন, ছবিটি মুক্তি দেয়া পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করতে পারতেন। তাহলে হয়ত আসল সত্য বের হয়ে আসত। কেউ কেউ বিষয়টিকে ছবি হিট করানোর জন্য পাবলিসিটি স্ট্যান্ট বলেও মন্তব্য করেছেন।
×