ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

পাঠ্যবইয়ের মান যাচাইয়ে মানহীন প্রতিষ্ঠান

আসিফ হাসান কাজল

প্রকাশিত: ০০:৪৫, ১৫ জুন ২০২৫

পাঠ্যবইয়ের মান যাচাইয়ে মানহীন প্রতিষ্ঠান

শিক্ষার্থীদের হাতে পৌছে গেছে নিম্নমানের বই

৩১ কোটি বইয়ের মান যাচাইয়ে ছিল মাত্র ২১ জন। আর এই দুই ডজনের কম ব্যক্তিই যাচাই করেছেন চল্লিশ হাজার মেট্রিক টন কাগজের মান। অবাক করা বিষয় হলো স্বল্প সংখ্যক কর্মী দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কাগজের মান খারাপ পায়নি। অবাধে দিয়েছেন ছাড়পত্র।  উল্টা তাদের দেওয়া সনদ ধরেই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌছে গেছে নিম্নমানের বই। যা নিয়ে সব মহলেই উঠে ব্যপক আপত্তি। অথচ কাগজ যাচাইয়ে কোম্পানিটির মেশিন ভালো ছিল না।

পাঁচ কোম্পানিকে ডিঙিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতা হওয়ার পরও কাজ পেয়েছিল ভারত নিয়ন্ত্রিত ফরাসি কোম্পানি ব্যুরো ভেরিটাস। প্রেস মালিকদের অভিযোগ, মান যাচাই নয়, উৎকোচ দিয়েই সার্টিফিকেট দিয়েছে কোম্পানিটি। এতে প্রেস মালিকদের সব বইগুলোই নির্ধারিত মান উতরে গেছে। নি¤œ মানের কাগজ দিলেও ওঠেনি কোনো আপত্তি। প্রেস মালিক ও কোম্পানির মধ্যে যোগসাজশেই ৩২ লাখ টাকায় কাজ পাওয়া কোম্পানিটি ৮ কোটির ব্যবসা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির দাবি তাদের কর্মী ছিল শতাধিক। নিয়ম মেনেই কাজ করা হয়েছে।

অথচ বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) কর্মকর্তারা জানান, এত অল্প জনবলে বিপুল পরিমাণ কাগজ যাচাই-বাছাই করে প্রেসে যাচ্ছে কী না তা দেখা সম্ভব নয়। সেখানে বইয়ের রং, কালি, আকার ঠিকঠাক দেখতে হলে কয়েকশত জনবল ও সময় প্রয়োজন।
প্রতি বছর মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের রং, আকার, কাগজের মান ও কালি ঠিকঠাক আছে কী না তা যাচাইয়ে প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)। এর জন্য দরপত্রের মাধ্যমে তৃতীয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু শর্ষের মধ্যেই ভূত থাকায়, রক্ষক ভক্ষকে পরিণত হয়। গত বছরই এর ব্যতিক্রম হয়নি। গত বছর পিডিআই ইন্সপেকশন করতে ৭৫ লাখ টাকা প্রাক্কলিত দর হিসেবে দরপত্র আহ্বান করে এনসিটিবি। ৬টি কোম্পানি এই দরপত্রে অংশ নেয়।

কোম্পানিগুলো হলো-  ইন্ডিপেনডেন্ট বিডি, শেখ ট্রেডিং, ইনফিনিটি বিডি, কন্ট্রোল ইউনিয়ন বিডি, হাইটেক বিডি এবং ব্যুরো ভেরিতাস। নিয়ম অনুযায়ী সর্বনি¤œ দরদাতাকে কাজ দেওয়ার কথা থাকলেও কাজ পেয়েছে সর্বোচ্চ দরদাতা ভারত নিয়ন্ত্রিত ফরাসি কোম্পানি ব্যুরো ভেরিতাস। দরপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ইন্ডিপেনডেন্ট বিডি প্রাক্কলিত দর ৭৫ লাখ টাকা হলেও এই কাজটি করতে ১৫ লাখ টাকা লিখে দরপত্র জমা দেয়। শেখ ট্রেডিংয়ের দরপত্র মূল্য ১৯ লাখ টাকা।

ইনফিনিটি বিডির দরপত্রে লেখা ২০ লাখ ৬০ হাজার। এছাড়াও কন্ট্রোল ইউনিয়ন বিডি ৯ লাখ, হাইটেক বিডি ৩ লাখ ৯৯ হাজার ও ব্যুরো ভেরিতাস ৩২ লাখ ৬১ হাজারে দরপত্র জমা দেয়। পিপিআর অনুযায়ী সর্বনি¤œ দরদাতার কাজ পাবেন তা না করে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেওয়া হয়।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান জনকণ্ঠকে বলেন, যে কোম্পানি এই কাজের দায়িত্ব নিয়েছে তাদের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো কাগজ প্রেসে ঢুকবে না। তারা মানের ছাড় করলে তবেই বই ছাপা শুরু হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বই ছাপানো হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরাও পাঠ্যবই পেয়েছে, কিন্তু তা নি¤œমানের। তাহলে এই কোম্পানি কিভাবে ছাড়পত্র দিল? সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, দেশের ১১০টি প্রেসে ২৪ ঘণ্টা ২ জন মানুষ কাজ করলেও তাদের ২২০ জন কর্মী দরকার।

শিফট অনুযায়ী করলে দরকার ৬৬০ জন। আর এত কাগজ বিএসটিআই থেকে পরীক্ষা করাতেও ৩৩ লাখ টাকা প্রয়োজন। এর সঙ্গে উৎস কর কর্তন রয়েছে। তা হলে কর্মীদের বেতন, অফিস খরচ কিভাবে চালাল সে প্রশ্ন ওঠে। এনসিটিবির উচিত এই ধরনের কোম্পানির থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া। সেটি যদি তারা করে, তবে তারাও এই ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণ হবে। 
বছরের পর বছর নি¤œমানের প্রতিষ্ঠান দিয়েই বইয়ের মান তদারক করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। যেসব তদারক কোম্পানি মান যাচাইয়ের কাজ করছে না আছে তাদের সক্ষমতা, না আছে জনবল। বরং প্রতিবছর দেখা যাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৯০-৮০ শতাংশ কম দিয়ে যেনতেনভাবে কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুদ্রাকর ও তদারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এক ধরনের যোগসাজশ রয়েছে।  আর সম্মিলিত এই সিন্ডিকেট সবার চোখে ধুলা দিয়ে নি¤œমানের বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছে। এর ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কারণ কাগজে কলমে বইয়ের মান ঠিক দেখাচ্ছে এসব কোম্পানি। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে বইয়ের দৃশ্য ভিন্ন। 
দরপত্রে এমন অংশগ্রহণ ও কাজের মান নিয়ে আশ্চর্য হয়েছেন এনসিটিবি সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) প্রফেসর ড. রিয়াদ চৌধুরী। তিনি জনকণ্ঠকে জানিয়েছিলেন, আমি ১০০ টাকা দর দেব। কিন্তু আমার এই কাজ যারা করে দেবে বলে দরপত্র কিনেছে তারা বলেছে আমি কাজটি ৬ টাকায় করে দেব। কেউ বলেছে ১০ টাকায় করে দেব। বিষয়টি বিস্ময়কর। আমি ১০০ অফার করার পরও তারা ৬ টাকায় কাজ করতে চেয়েছে। এতে স্পষ্ট তাদের অভিসন্ধি ভালো নয়। আবার তাদের বিরুদ্ধে আগেও নানা অনিয়মের অভিযোগ ছিল।
জানা যায়, ব্যুরো ভেরিতাস ফরাসি কোম্পানি হলেও তারা মূলত ভারত থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। এ ছাড়াও এই কোম্পানির বিরুদ্ধে নি¤œমানের কাজ করার দায়ে ও অনিয়মের কারণে বড়সড় জরিমানা গুনতে হয়েছে আগে। লটপ্রতি লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র নেন ব্যবসায়ীরা। যার সঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কতিপয় সদস্য জড়িত বলেও জানা গেছে। এসব কারণে গত বছর ১৩টি পিএলআই রিপোর্ট জব্দ করে এনসিটিবি। অর্থ লেনদেনের যে বিষয়ে তদন্ত করে। কিন্তু সেই তদন্ত প্রতিবেদন ও শাস্তির বিষয়টি আর সামনে আসেনি।
অভিযোগের বিষয়ে ব্যুরো ভেরিতাস কোম্পানির স্বত্বাধিকারী মো. আফজাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জনকণ্ঠকে তিনি হাসপাতালে আছেন বলে জানান। পরে মাত্র ২১ জন বিপুল পরিমাণ কাগজ কিভাবে যাচাই করেছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তার কর্মী ছিল শতাধিক। কোনো কোনো প্রেসকে নি¤œ মানের কাগজ ব্যবহারের জন্য আপত্তি দিয়েছেন এ বিষয়েও কোনো কোম্পানির নাম জানাতে পারেননি। 
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলাম প্রণয়ন, পরিমার্জন করে। এ ছাড়াও প্রতি বছর প্রাক প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাদ্রাসাসহ মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপায়। গত কয়েক বছর সরকারি অর্থে নি¤œমানের বই ছাপানোর কারণে সমালোচনার মুখে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
গত বছরও এনসিটিবির অধীনে ছাপানো পাঠ্যবইয়ের মান নির্দিষ্ট থাকলেও অনেক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান সেটি অনুসরণ করেনি। এসব বই বাঁধাইয়ের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের গাম। পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদ ও পৃষ্ঠা সংখ্যার ক্ষেত্রেও করা হয়েছে নয়ছয়। এমন অনিয়ম, অসঙ্গতিতে ভরা অন্তত ৩৩ শতাংশ নি¤œমানের বই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে বলেও একাধিক সূত্র জানিয়েছেন। এসব বই ছাপিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা বিলের নামে তুলে নেওয়া হয়েছে। 
এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, পিডিআই দরপত্র আহ্বান ও তাদের কার্যক্রমের সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না। আমি যতদূর জানি পিপিআর অনুযায়ী কাজ দেওয়া হয়েছিল। তবে দীর্ঘদিন ধরে এসব রিপোর্টের বিষয়ে অভিযোগ আছে। বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ঊর্ধ্বতনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে বলে জানান তিনি।

×