
ছবি: সংগৃহীত
শিক্ষাঙ্গনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) উত্থান নিয়ে যখন সারা বিশ্বে আলোড়ন চলছে, তখন একে নিয়ন্ত্রণে অনেক স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শ্রেণিকক্ষে মোবাইল ফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। মূল উদ্দেশ্য—চ্যাটজিপিটি ও অনুরূপ এআই টুলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নকল রোধ। কিন্তু এবার এক নতুন ও অপ্রত্যাশিত বাস্তবতা সামনে এসেছে—এবার কাঠগড়ায় শিক্ষকরাই।
এআই নির্ভর শিক্ষকতা: শিক্ষার্থী নাকি যন্ত্রের কাছে পাঠ নিচ্ছে?
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, শিক্ষার্থীদের প্লেজারিজম ঠেকাতে প্রথমে সতর্ক হলেও, এখন অনেক শিক্ষক নিজেরাই ব্যাপকভাবে এআই ব্যবহার শুরু করেছেন। পাঠদান, হোমওয়ার্ক এবং মূল্যায়ন—সব কিছুতেই দেখা যাচ্ছে চ্যাটজিপিটির মতো টুল ব্যবহারের ছাপ।
নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী এল্লা স্ট্যাপলটন তার পাঠ্যসামগ্রীতে স্পষ্ট ভুল নির্দেশনা, বিকৃত ছবি এবং চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে তৈরি করা কনটেন্ট দেখে বিস্মিত হন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে টিউশন ফির ফেরতের দাবিও জানান।
সহায়ক নাকি প্রতারক? শিক্ষকদের এআই ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন
যুক্তরাষ্ট্রে করা এক জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে ৩৫% বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়মিত এআই ব্যবহার করেন, যেখানে আগের বছর এই হার ছিল ১৮%। লেখালেখির সহায়তা, ক্লাস কনটেন্ট তৈরি, অটোমেটেড মূল্যায়ন এবং 'সহানুভূতিপূর্ণ' মন্তব্য প্রেরণ—এসব কাজে শিক্ষকদের অনেকেই এআইকে সহায়ক মনে করেন।
তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। বিভিন্ন ফোরাম ও প্ল্যাটফর্মে অভিযোগ আসছে—'খালি স্লাইড', 'যন্ত্রসুলভ মন্তব্য', 'সাধারণ ও অসংলগ্ন শব্দাবলী', এমনকি 'অর্থহীন উত্তর'। হাজার হাজার ডলার খরচ করে যারা শিক্ষা গ্রহণ করছেন, তাদের মনে হচ্ছে তারা মানুষ নয়, যন্ত্রের কাছ থেকে শিক্ষা পাচ্ছেন। এতে একধরনের বিশ্বাসঘাতকতার অনুভূতি তৈরি হচ্ছে।
নৈতিক দ্বন্দ্ব ও শিক্ষাগত চ্যালেঞ্জ
ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল শোভলিন এআই ব্যবহারে 'যুক্তিযুক্ততা' বজায় রাখার পক্ষে মত দেন এবং মানবিক সংযোগ ও শিক্ষাগত বিচক্ষণতা বজায় রাখার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। অন্যদিকে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের অধ্যাপক ক্যাটি পিয়ার্স নিজের মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসারে একটি চ্যাটবট তৈরি করেছেন, যা শিক্ষার্থীদের শ্রেণির বাইরে সহায়তা করে।
হার্ভার্ডের প্রোগ্রামিং শিক্ষক ডেভিড মালান সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে এআই সহকারী ব্যবহার করেন, যাতে তিনি সময় বাঁচিয়ে ওয়ার্কশপ বা হ্যাকাথনের মতো কার্যকর শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে মনোনিবেশ করতে পারেন। এই ধরনের ব্যবহার, যদি স্বচ্ছ ও নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে শিক্ষার মান উন্নত করতেও পারে।
বিশ্বাসের সংকটই সবচেয়ে বড় সমস্যা
কিন্তু যখন এর ব্যবহার গোপন বা অতিরিক্ত হয়ে পড়ে, তখন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক ভেঙে পড়ে। যেমনটি ঘটেছিল নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রিক অ্যারোউডের ক্ষেত্রে। তিনি স্বীকার করেন, তিনি চ্যাটজিপিটি ও অন্যান্য এআই টুল ব্যবহার করে নিজের কোর্স তৈরি করেছেন—তবে সব সময় যাচাই করেননি বা শিক্ষার্থীদের জানাননি। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে তিনি নিজের অবস্থান পর্যালোচনা করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট নীতি চালু করে: এআই-সৃষ্ট যেকোনো কনটেন্ট অবশ্যই জানাতে হবে, যাচাই করতে হবে এবং উপযুক্ত ব্যাখ্যা দিতে হবে।
শেষ কথা
শিক্ষাক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজে কোনো 'অপরাধী' নয়। কিন্তু যখন শিক্ষকরা এটি অস্বচ্ছ ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করেন, তখন শিক্ষাব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। প্রযুক্তি নয়, প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষাগত—কীভাবে নিশ্চিত করা যায় যে এআই জ্ঞান অর্জনের সহায়ক হবে, বিকল্প নয়।
আসিফ