
মায়ের সঙ্গে মন্দিরা চক্রবর্তী
মায়ের সঙ্গে প্রত্যেক সন্তানেরই জড়িয়ে রয়েছে গভীর এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। জন্মের পর থেকে মা-ই হয়ে ওঠেন সন্তানের কাছে পৃথিবী ও সুখ-দুঃখের সঙ্গী। কিন্তু উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়ার পর থেকে সেই মায়ের সঙ্গেই বাড়তে থাকে দূরত্ব। যে মাকে ছাড়া একদিনও চলা যেত না, এখন নানান ব্যস্ততায় জীবন পার করতে হয় মাকে ছাড়াই। বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষে কয়েক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে মায়ের সঙ্গে তাদের গল্প-আড্ডার স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন
সুদীপ চাকমা ও মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ
মা আমার সফলতার সোপান
তখন সদ্য প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। বয়সটা ছিল খেলা করার। তাই স্কুল-মক্তবে যেতে ভালোই লাগত না। প্রতিদিন ভোরে আম্মা আমাকে মক্তবে যাওয়ার তাগিদ দিতেন। আম্মার ভয়ে মক্তবে যেতাম ঠিকই তবে পড়ার প্রতি মনোযোগ থাকত না। অন্যদিকে স্কুলে যাওয়াতে আমার অ্যালার্জি। একদমই ভালো লাগত না। চরম ফাঁকিবাজি যাকে বলে। আম্মা স্বাভাবিকভাবেই খুব রাগী মানুষ, খুবই রাশভারী। যখন নিয়মিত স্কুল-মক্তবে ফাঁকি দিতে থাকলাম তখন তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না।
একদিন আম্মা আমার দুই হাত বাড়ির সামনে থাকা পেয়ারা গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধলেন। কী তার গর্জন! তিনি যেন অচেনা কেউ! এক হাতে লাঠি নিয়ে আমাকে বেদম প্রহার করতে করতে বলতে থাকলেন ‘বল, কাল থেকে আর স্কুল-মক্তবে যাওয়ার কথা বলা লাগবে? সারাটা দিন ঢৈ-ঢৈ করে বেড়াবি, আর স্কুল-মক্তবে যেতে বললেই শয়তান পাছ (পিছে) লাগে?’ একনাগাড়ে আমাকে মেরেই যাচ্ছেন। আমি কান্না করতে করতে বলতে থাকলাম ‘ও আম্মা, আর বলা লাগবে না। ও আম্মা, আর বলা লাগবে না।’
এক সময় আম্মার হাতের লাঠির গতি থামল ঠিকই; তবে মুখে যেন খই ফুটছে। পরে কেউ একজন আমার হাতের বাঁধন খুলে আমাকে আপাতত সেদিনের জন্য মুক্ত করলেন। পরদিন থেকে আমাকে কখনো স্কুল-মক্তবে যাওয়া বা সন্ধ্যা হলে বাড়িতে পড়তে বলার কথা আম্মাকে আর কোনোদিন বলতে হয়নি। নিজ দায়িত্বে এগুলো করতাম। প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও কলেজে প্রথম স্থান অর্জন করেছি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে আইন বিভাগে অধ্যয়ন করছি। ঐ দিনের প্রহার আমাকে প্রতিটা পদে পদে সফলতা এনে দিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ! ঐ প্রহার আমার জীবনের গতিপথ ১৮০ ডিগ্রি বরাবর ঘুরিয়ে দিয়েছে। সঠিক পথের দিশা দিয়েছে। এই স্মৃতি আমি কখনো ভুলব না।
মারুফ হোসেন
আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ছায়ার মতো আগলে রাখেন মা
সেদিনও ঠিক এমনই ছিল, কালবৈশাখীর ঘনঘটা। তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়তাম। প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় এলে দূরে এক বন্ধুর বাড়িতে যেতাম প্রাইভেট পড়তে। সেদিনও গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ, পড়ার মাঝে শুরু হলো কালবৈশাখীর ঝড়। ঝড়ের সঙ্গে ছিল ঘনঘন বিদ্যুৎ চমক, ছিল বজ্রপাত। বাড়িতে আমরা সবাই জানি, বজ্রপাত হলে মা খুব ভয় পেতেন। বৃষ্টি শুরু হলে আমাদেরকেও বের হতে দিতেন না। আমিও তাই মায়ের মতোই খুব ভয় পেতাম বিদ্যুৎ চমকানো দেখে।
এজন্য এ রকম সময় আমাকেও তিনি বাইরে যেতে দিতেন না। কিন্তু সেদিন! ঝড়ের মাঝে একাই এসেছিলেন আমাকে নিতে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। অথচ এর আগে কোনোদিন মাকে দেখিনি বজ্রপাত হলে ঘর থেকে বের হতে। তখন মায়ের স্পর্শ পেয়ে যেন সাহস পেয়ে গেলাম। ঝড়ের তীব্রতা বাড়লেও মায়ের পাশে থাকায় তখন আর কোনো ভয় ছিল না। আসলে ‘মা’ শব্দটির কোনো সংজ্ঞা হয় না। প্রকৃত অর্থে এর কোনো দিবসও হয় না। আমাদের চারপাশ স্বার্থপরতা ও বিশ্বাসঘাতকতায় ভরপুর হলেও একমাত্র মা’ই এর বিপরীত।
সব ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে আমাদেরকে বটবৃক্ষের ন্যায় অবিচল ছায়ার মতো আগলে রাখেন। পৃথিবীর সবার কাছে বয়সে, আচরণে, অভিজ্ঞতায় যত বড়ই হই না কেনÑ মায়ের কাছে কিন্তু সেই ছোট্টই থেকে যাই। বাড়ি থেকে যেদিন ক্যাম্পাসের দিকে রওনা দিই, সেদিন যেনো মায়ের আর কোনো ঘুম নেই। সারাটি পথেই ঘন ঘন ফোন দেওয়া, পথে কোনো বিপদ হয় কি না, সব খোঁজখবর রাখেন তিনি। তাই মাঝেমধ্যে ভাবিÑ সবার কাছে তো বড়ই হয়েছি, মায়ের কাছে ছোট থাকতে চাই আজীবন।
মংক্যচিং মারমা
আইন বিভাগ, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়
সকল আবদারে নির্ভরতার জায়গা হয়ে ওঠেন মা
সেই ছোট্টবেলা থেকে মায়ের সঙ্গে ছিল আমার বন্ধুর মতো সম্পর্ক। ছোটবেলা থেকে বাবাকে ভীষণ ভয় পেতাম। তাই সকল আবদারে নির্ভরতার জায়গা হয়ে ওঠেন মা। যখনই কোনো কাজে বিপদে পড়ি সবার আগে যেতাম মায়ের কাছে। আক্ষরিক অর্থে মা-ই ছিল আমার ভরসার জায়গা। তাই মা’র সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকায় তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হাজারও স্মৃতি। ছেলেবেলায় আমি ছিলাম বেশ দুরন্ত।
কিছুতেই দুপুরবেলায় ঘুমাতে যেতাম না। বলেন তো আমি ঘুমিয়ে গেলে কে চুপিচুপি লিচু গাছে উঠে পা দোলাবে! বর-কনে সাজিয়ে কে পুতুলের বিয়ে দেবে! আমি ছাড়া এসব কাজের তদারকি করতে পারবে কি কেউ! এদিকে মা সারাদিন কাজ করে খুব ক্লান্ত থাকতেন। আবার আমাকে রেখে ঘুমাতেও পারতেন না। কখন কি করি সেই চিন্তায়। তাই আমাকে গল্পের লোভ দেখিয়ে ঘুম পাড়াতে নিয়ে যেতেন।
তখন আমি মায়ের পাশে শুয়ে লক্ষ্মী মেয়ের মতো থাকতাম, আর মা ঢুলুঢুলু চোখে আমাকে গল্প শোনাতেন। এরপর হঠাৎ একসময় যখন গল্প থেমে যেত- আমি বুঝতাম, মা নিশ্চিত ঘুমিয়ে পড়েছেন। তখন আমি চুপিচুপি শব্দ না করে মায়ের পাশ থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে পুতুল খেলতাম। তখন খুব সাবধানে থাকতে হতো মা’র যেন ঘুম আবার না ভেঙে যায়। মাঝে মাঝে ধরাও পড়তাম, আর সঙ্গে সঙ্গে বকুনিও খেতাম খুব।
আর এখন পড়াশোনার জন্যে বাসা থেকে অনেক দূর। এই ব্যস্ত জীবনের মাঝেও ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে সেই দুপুরবেলার স্মৃতি। যদি এখনো দুপুরবেলার সেই দিনগুলোর মতো মা আমাকে গল্প বলে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন! কত না সহজ হয়ে যেত জীবনটা!
খাদিজা আহমেদ ইসরা
প্রতœতত্ত্ব বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
মায়ের উপস্থিতি সবসময়ই সাহস যুগিয়েছে
সালটা ২০১৮। তখন জ্বর নিয়েই এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। তাই মা আমাকে সবসময়ই পরীক্ষার কেন্দ্রে নিয়ে যেতেন। আর অপেক্ষা করতেন পরীক্ষা শেষ হওয়া অবধি। এমনিতেই একটু নার্ভাস থাকতাম কিন্তু সে সময় পরীক্ষার প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা দিন মায়ের উপস্থিতি যেন আমাকে আরো বেশি সাহস যুগিয়েছিল। এতদিন সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল কিন্তু বিপত্তি বাধে গণিত পরীক্ষার সময়। আটকা পড়ে গেলাম কেন্দ্রে ঢুকতে গিয়ে। কেন্দ্রে সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর নেওয়া ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
কিন্তু বের হয়ে যে নরমাল ক্যালকুলেটর নিতে যাব তাও দিচ্ছে না। তখন পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার ঘণ্টাও বেজে গেছে। কেন্দ্রের বাইরে এত যে মানুষ ছিল! তখন চারদিকে দিশেহারা হয়ে মাকে খুঁজছিলাম। কোথাও মাকে দেখতে পাইনি। হঠাৎ করে দেখলাম, কোথা থেকে যেন মা আমার কাছে দৌড়ে এলেন। সবকিছু খুলে বললাম এবং ১০ মিনিটের মধ্যেই মা একটা নরমাল ক্যালকুলেটর নিয়ে হাজির। তারপর মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢুকলাম পরীক্ষার হলে।
সেদিন এত মানুষের ভিড়ে মাকে খুঁজে না পেলেও মা ঠিকই আমাকে খুঁজে নিয়ে আকাশ সমান সাহস জুগিয়েছেন। এত মানুষের ভিড়ে মা আমাকে দেখতে না পেলে কি যে হতো ভাবলেও অবাক লাগে। তাই যতই না পড়ার ইচ্ছা আসুক, তখন শুধু নিজেকে বোঝাতাম: মা এত কষ্ট করে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন... আমাকে ভালো কিছু করতেই হবে।
একুশটা বসন্ত পরিবারের সঙ্গে কাটানোর পর এখন এই সময়গুলোতে ক্যাম্পাসে একা একা দিন পার করছি। এই সময়ও মা ঠিক আমাকে শক্তি যুগিয়ে যাচ্ছেন। যখনই মনে হয় হেরে যাচ্ছি ঠিক তখনই মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে। নিজেকে তখন জিজ্ঞেস করি, ‘আমি কেন পারব না? কেন পারব না আমি?’
মন্দিরা চক্রবর্তী
ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়