ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৭ মে ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

৮ মাসে সূচক কমেছে ১১২৩ পয়েন্ট

শেয়ারবাজারে পতনের ধারা অব্যাহত

অপূর্ব কুমার

প্রকাশিত: ০০:০৩, ১৭ মে ২০২৫

শেয়ারবাজারে পতনের ধারা অব্যাহত

.

বিগত সরকারের আমলের ক্ষত শুকানোর আগেই নতুন করে আঘাতে জর্জরিত পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। নতুন সরকার গঠনে সব খাত আশার আলো দেখালেও বিপরীত পরিস্থিতি পুঁজিবাজারে। আরও অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে পুঁজি সংগ্রহের সম্ভাবনাময় এ খাত।  সূচক কমতে কমতে খাদের কিনারে দাঁড়িয়েছে পুঁজিবাজার। পতনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। এ পতনের ধারা এতটাই তীব্র্র যে, একদিনে গত ১২ বছরে সর্বোচ্চ পতনের ঘটনাও ঘটেছে।

সংস্কার কাজে ধীরগতি এবং বাজার সংশ্লিষ্টদের আস্থায় না আনতে পারা বর্তমান নেতৃত্বের বড় দূর্বলতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সেইসঙ্গে শেয়ারবাজারে বড় ব্যবসায়ীদের প্রতিনিয়ত জরিমানা করা এবং নিষ্ক্রিয়দের সক্রিয় করতে না পারাও শেয়ারবাজারকে আরও বেশি অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৮ মাসে প্রধান শেয়ারবাজারের সূচক কমেছে ১১২৩ পয়েন্ট। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আরও নাজুক হয়ে পড়বে অর্থনীতির জনপ্রিয় ও অতীব প্রয়োজনীয় খাতটি। সেই কারণে বাজার অংশীজনেরা প্রধান উপদেষ্টার ৫ দফা সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার পুঁজিবাজারকে যে তলানিতে নিয়ে গেছে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনতে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তারা বলছেন, যে সংস্কার শুরু হয়েছে তা কবে শেষ হবে তার সঠিক সময়সীমা না থাকায় বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাচ্ছে। সেইসঙ্গে এই পতনের বাজারে স্বল্প সময়ে কিছু উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন ছিল। এছাড়া ১১ মে বৈঠকে বাজার মধ্যস্থতাকারী কাউকে না রাখায় বিনিয়োগকারীরা আরও হতাশ হয়েছে বলে অংশীজনেরা মনে করছেন। অপরদিকে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলোর ফল স্বল্প সময়ে দৃশ্যমান না হলে বাজারে আশা ও আস্থা ফিরবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
কি আছে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনায় ?
নানা আন্দোলন ও আলোচনা-সমালোচনার পর গত ১১ রবিবার প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস শেয়ারবাজার অংশীজনদের নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি শেয়ারবাজার নিয়ে ৫টি নির্দেশনা দেন। এগুলো হলো : দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী যেসব বিদেশি বা বহুজাতিক কোম্পানিতে সরকারের মালিকানা রয়েছে সেগুলোকে দ্রুত শেয়ারবাজারে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। গত ২০-৩০ বছরে দেশের বেসরকারি খাতে যেসব ভালো ও বড় বড় কোম্পানি গড়ে উঠেছে সেগুলোকে প্রণোদনা দিয়ে বাজারে আনার উদ্যোগ নেওয়া। বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ দল এনে তিন মাসের মধ্যে পুঁজিবাজার সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ। বড় বড় কোম্পানি যাতে ব্যাংক ঋণ নেওয়ার বদলে শেয়ারবাজারে বন্ড বা শেয়ার ছেড়ে পুঁজি সংগ্রহে আগ্রহী হয় সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
বৈঠকে শেয়ারবাজারকে গতিশীল ও গুণগত পরিবর্তনের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে শেয়ারবাজারকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো প্রণোদনা নেই। সেই কারণে তাৎক্ষণিকভাবে ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। অর্থাৎ স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ না থাকায় শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরেনি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এর আগে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালে বড় দুটি ধসের সম্মুখীন হয় দেশের পুঁজিবাজার। ৯৬-এর পর ঘুরে দাঁড়ালেও ২০১০-এর পর গত ১৬ বছরে গতি আসেনি বাজারে। অথচ দীর্ঘ সময়ে বেশিরভাগই নি¤œমানের কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে। বেশ কিছু কোম্পানির মালিক শেয়ারবাজারে হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের আমলে সব সময়ই শেয়ারবাজার নিয়ে কারসাজির ঘটনা ঘটেছে। ফলে ক্ষতির শিকার হয়েছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।
অভিযোগ রয়েছে, এই সময় বাজার থেকে লাখ কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছে সালমান এফ রহমান, খায়রুল ও শিবলী কমিশনারসহ অন্যান্য সহযোগী। ভঙ্গুর ও ভুয়া কোম্পানি তালিকাভুক্তিতে আস্থা হারায় বিনিয়োগকারীরা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমর্থনে বন্ডের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়। বন্ডের সুযোগ কাজে লাগায় বিগত সরকারের সুবিধাভোগীরা। সাবেক আমলা থেকে ব্যবসায়ী ও সরকারি চাকরিজীবীরাও বিও খুলে কারসাজির ঘটনা ঘটিয়েছে।
গত ৫ আগস্ট বিগত সরকারের পতনের পর নতুন আশার সঞ্চার হয় শেয়ারবাজারে। এতে প্রথম তিনদিনেই সূচক বাড়ে ৫৮০ পয়েন্ট। নতুন আশা নিয়ে উজ্জীবিত হতে দেখা যায় বিনিয়োগকারীদের। সেইসঙ্গে যুক্ত হয় অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারের নতুন সম্ভাবনার। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মাসরুর রিয়াজকে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার শীর্ষে পদে নিয়োগ দেয় সরকার। কিন্তু বিএসইসির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মাসরুর রিয়াজকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিরোধিতা করে। পরে বিব্রত হয়ে তিনি দায়িত্ব নিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। পরে খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে চেয়ারম্যান করে বিএসইসির কমিশন গঠন করা হয়। এরপর থেকে প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির ফারাক শুরু হয়। মুখ থুবড়ে পড়ে সূচক ও লেনদেন কমে যেতে থাকে। সর্বশেষ ১৫ মে পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ৮ মাসে প্রধান শেয়ারবাজারের সূচক কমেছে ১১২৩ পয়েন্ট। আর বাজার মূলধনে কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকায়। টানা কমছে সূচক ও লেনদেন।
বর্তমানে প্রায় প্রতিদিনই চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে বিনিয়োগকারীরা মতিঝিলসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করে আসছে। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। তবে শুধু বর্তমান কমিশনকে না দুষে সংশ্লিষ্টরা এর পেছনে স্বল্প সময়ে কোনো সংস্কার না থাকা ও সময় বেশি নেওয়াকে দায়ী করছেন। অংশীজনেরা বলছেন, ১৬ বছরে বাজারকে যে তলানিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনতে এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, এমনিতে বাজার খারাপ। এই মুহূর্তে তাকে স্বল্পমেয়াদি প্রণোদনা দেওয়া উচিত ছিল। এটা তো মানতে হবে গত ১৫ বছরে বাজারের প্রতি অবিচার করা হয়েছে, অন্যায় করা হয়েছে। দুঃশাসন, অপশাসনের কোনো মাত্রা ছিল না। ফলে এ বাজার উদ্ধার করতে গেলে কিছু তো প্রণোদনা লাগবেই। আপনার টাকা দিয়ে হোক বা আস্থা দিয়ে হোক বা উৎসাহ দিয়ে হোক।
পুঁজিবাজার সংস্কারে যে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে তাদের ১৭টি কাজের মধ্যে এখন পর্যন্ত তিন বিষয়ে সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে। তাই ৯ মাস পেরিয়ে যাওয়ায় বর্তমান সরকারের সময় এ সংস্কার শেষ হবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে আগামী বাজেট এবং দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে শেয়ারবাজার নিয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে যেসব বড় সমস্যা রয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগের সমাধান হওয়ার আশা প্রকাশ করা হয়েছে।
অপরদিকে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলোর ফল স্বল্প সময়ে দৃশ্যমান না হলে বাজারে আশা ও আস্থা ফিরবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যে উদ্যোগগুলো তারা নিয়েছে সেগুলো থেকে যদি কোনো ফল দেখাতে পারে তাহলে আর কী করা যায় সেটা ভাবা যাবে। মৌলিক সংস্কারের ক্ষেত্রে আমরা তো তেমন কিছু দেখি নাই। কেননা এখানে আইনি সংস্কার আছে। সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের আভ্যন্তরীণ সংস্কারের প্রয়োজন আছে। পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে যে সংস্কার প্রয়োজন সেটা বাজারের প্রকৃত চিত্র দেখে সময় সময় বাস্তবায়নের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

প্যানেল

×