ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনচিত্র

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮

বদলে যাচ্ছে মানুষের জীবনচিত্র

মাহফুজা জেসমিন (বাসস) ॥ এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। বিশ্বে এক গৌরবোজ্জ্বল জাতি হিসেবে আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। আত্মনির্ভর জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপকরণ। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার উপকরণও এখন তাদের হাতের মুঠোয়। দেশের ৯১ শতাংশ মানুষের ঘরে জ্বলছে বৈদু্যুতিক বাতি। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দারিদ্র্যের হার ৪৮.৯ শতাংশ থেকে অর্ধেকে নেমে হয়েছে ২১.৮ শতাংশ। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ৫৪৩ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ১৭৫১ ডলারে উন্নীত হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় নিবন্ধনের হার শতভাগের দিকে এগিয়ে চলেছে। গ্রামীণ জনপদের দোড়গোড়ায় বিনামূল্যে নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে সারাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্যে দিয়ে একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার ৪২ বছর পর তা আজ বাস্তবে রূপ পেতে শুরু করেছে। খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দশম স্থান অধিকার করেছে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ এবং সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, সেচ, উচ্চফলনশীল নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ফলে এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে বাংলাদেশ ৩য় স্থান ও বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ৫ম স্থান অধিকার করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, জনপ্রতি মাছ গ্রহণের পরিমাণ চাহিদার চেয়ে (৬০ গ্রাম) বৃদ্ধি পেয়ে ৬২.৫৮ গ্রাম-এ দাঁড়িয়েছে। মৎস্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, দেশের মোট উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আসে শুধু ইলিশ থেকে। গত দশ বছরে ইলিশ উৎপাদন প্রায় ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে ২০১৭ সালে ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নিদর্শন (জিআই) সনদ লাভ করেছে, যা বাংলাদেশের মৎস্য খাতের জন্য এক বিশাল অর্জন। দেশ মাংস উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। গত দশ বছরে দেশের মোট মাংস উৎপাদনের পরিমাণ ১০.৮০ লাখ টন থেকে বেড়ে ২০১৭-১৮ সালে ৭২.৬০ লাখ টন হয়েছে। দেশের মোট চাহিদা ৭১.৩৫ লাখ টন এর তুলনায় ১.২৫ লাখ টন মাংস বেশি উৎপাদিত হয়েছে। ২০০৮-০৯ সালের তুলনায় ২০১৭-১৮ সালে দুধ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪.৫ গুণ, মাংস উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৭ গুণ এবং ডিম প্রায় ৩.৫ গুণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালে দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ৪৮.৯ শতাংশ তা এখন অর্ধেকে নেমে হয়েছে ২১.৮ শতাংশ। অতি দারিদ্র্যের হার কমেছে আরও বেশি। একই সময়ে তা ৩৪.৩ থেকে ১১.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। বাঙালী আজ অর্থনৈতিক মুক্তির দ্বারপ্রান্তে। এদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ৫৪৩ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ২০১৮ এর সেপ্টেম্বরে ১৭৫১ ডলারে উন্নীত হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হয়েছে ৭.৮৬% যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড। এর ফলে প্রায় ৫ কোটি মানুষ নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছে। প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্সের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৯তম ও ২০৫০ সালে ২৩তম অর্থনীতির দেশে উন্নীত হবে। গত ১০ বছরে দেশের যোগাযোগ খাতে ঘটেছে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। ৩৮৬ কিলোমিটারেরও বেশি জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। ঢাকা শহর যানজটমুক্ত করার জন্য অনেক উড়াল সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। তৈরি হচ্ছে এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে। বিশ্ব এখন অবাক বিস্ময়ে দেখছে এক সময়ের দাতা-নির্ভর বাংলাদেশ আজ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মার বুকে তৈরি করছে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বহুমুখী সেতু। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগ গত দশ বছরের রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আরও একটি মাইলফলক সৃষ্টি করেছে। এই ১০টি উদ্যোগের ফলে দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনে কোন না কোনভাবে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। দরিদ্র মানুষের সঞ্চিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের সঙ্গে সরকারী অনুদান যুক্ত করে স্থায়ী তহবিল গঠন করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করে দিতে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প সারাদেশে কাজ করছে। দেশের ৮টি বিভাগের ৬৪ জেলার ৪শ’ ৯০ উপজেলাধীন ৪ হাজার ৫শ’ ৫০টি ইউনিয়নের ৪০ হাজার ৯শ’ ৫০টি ওয়ার্ডের সব গ্রামে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশের দেড় কোটিরও বেশি লোককে দারিদ্র্যমুক্ত করা হয়েছে। এর আওতায় ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় তিন কোটি লোককে দারিদ্র্যমুক্ত করা হবে। সারাদেশের নিরাশ্রয় মানুষের ঠিকানা আশ্রয়ণ প্রকল্প। দেশের ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল, অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনের লক্ষ্যে এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত এই প্রকল্পের ৩টি পর্যায়ে ১৯৯৭ থেকে জুন ২০১৮ পর্যন্ত ২ লাখ ৬৪ হাজার ৪৪২টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ২০১৯ সালের মধ্যে আরও ২.৫০ লাখ গৃহহীন ও ছিন্নমূল পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ। এ পর্যন্ত দেশের ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, ৪১৯টি উপজেলা ডিজিটাল সেন্টার, ৬১টি জেলা ডিজিটাল সেন্টার, ৩২১টি পৌর ডিজিটাল সেন্টার ও ৪০৭টি নগর ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এসব তথ্য সেবাকেন্দ্র থেকে অনলাইনে ১১৬ ধরনের সেবা দেয়া হচ্ছে। ৪৩ হাজার অফিস ও ২৫ হাজার ওয়েবসাইট নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম ওয়েব পোর্টাল ‘জাতীয় তথ্য বাতায়ন’ চালু হয়েছে। বাংলা ভাষায় জাতীয় ই-তথ্যকোষ চালু হয়েছে। দেশের সব ভূমি রেকর্ডকে (খতিয়ান) ডিজিটাল করার উদ্দেশ্যে ‘ডিজিটাল ল্যান্ড রেকর্ডরুম সার্ভিস’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ১ হাজার ৩৫৫টি সরকারী অফিসে ই-ফাইলিং চালু হয়েছে। ই-পেমেন্ট ও অনলাইন ব্যাংকিং চালু হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে অনলাইন ও মোবাইল টিকেটিং সেবা চালু করেছে। ডিজিটাল কার্যক্রমের আওতায় নাগরিক পরিসেবার বিল পরিশোধ, ই-টিন গ্রহণ ও অনলাইন ট্যাক্স প্রদান সম্ভব হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমোনপযোগী শিশুদের বিদ্যালয়ে নিট ভর্তির হার ৯৭.৯৭%। ২০১০ সাল থেকে শুরু করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৬০ কোটিরও বেশি পাঠ্যবই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। বিশ্বে বিনামূল্যে বই বিতরণের এমন দৃষ্টান্ত আর কোন দেশে নেই। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৪৪ হাজারেরও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করা হয়েছে। প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সব পাঠ্যপুস্তক অনলাইনে প্রাপ্তির জন্য ই-বুক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে। ওয়েবসাইট ও এসএমএসের মাধ্যমে পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ ও ভর্তি প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। উপবৃত্তি উপকারভোগী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৪০ লাখ। ইউনেস্কোর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৭ সালের ৪৪ শতাংশ থেকে ২০১৬ সালে শিক্ষার হার ৭২.৭৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। দেশের সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হচ্ছেন নারীরা। রাজনীতি, ব্যবসা, প্রশাসন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে তারা সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য প্রথমবারের মতো ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে এবং তাদের জন্য বিসিক শিল্পনগরীতে ১০ শতাংশ প্লট রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিশ্বে তৈরি পোশাকের বাজার সৃষ্টির পেছনেও রয়েছে নারী কর্মীদের একনিষ্ঠ শ্রম। বিদ্যুত খাতের অভূতপূর্ব উন্নয়নের ফলে দেশের অবকাঠামো, কৃষি ও শিল্প খাতের অগ্রগতি আগের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা যেখানে ছিল মাত্র ৪,৯৪২ মেগাওয়াট, বর্তমানে তা রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে হয়েছে ২০,৪৩০ মেগাওয়াট। দেশের ৯১ শতাংশ মানুষ এখন বিদ্যুত সরবরাহের আওতায় রয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশে বিদ্যুত খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় দেড় কোটি মানুষের। গ্রামীণ জনপদের দোড়গোড়ায় বিনামূল্যে নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে ১৬ হাজার ৪৩৮টি কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে দরিদ্র মানুষকে চিকিৎসা পরামর্শের পাশাপাশি ৩২ প্রকারের ওষুধ বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। ৬৪টি জেলা ৪২১টি উপজেলা হাসপাতাল থেকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে চিকিৎসা পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। ৪৩টি হাসপাতাল ও ৩০টি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে পাওয়া যাচ্ছে টেলিমেডিসিন সেবা। ২০০৯ সালে দেশে সরকারী মেডিক্যাল কলেজের সংখ্যা ছিল ১৪টি, যা বর্তমানে ৩৬টিতে উন্নীত হয়েছে। হাজার হাজার অসহায় নারী-পুরুষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় পেয়েছে বেঁচে থাকার অবলম্বন।
×