ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বায়ন থেকে কাক্সিক্ষত সুফল পাচ্ছে না বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ১৭ অক্টোবর ২০১৭

বিশ্বায়ন থেকে কাক্সিক্ষত সুফল পাচ্ছে না বাংলাদেশ

কাওসার রহমান ॥ বিশ্বায়ন থেকে কাক্সিক্ষত সুফল পাচ্ছে না বাংলাদেশ। অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বায়নে অংশীদার হলেও উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাধার কারণে সেভাবে বিশ্ব বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে অতিউদারীকরণের কারণে বাংলাদেশ বিদেশী পণ্যের বাজারে পরিণত হলেও বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের বাণিজ্য বাড়ছে না আশানুরূপ। বরং প্র্রধান বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিযোগী দেশগুলোকে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিলেও বাংলাদেশকে সে সুবিধা দেয়া দূরের কথা, জিএসপি সুবিধাও বন্ধ করে দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফ এ্যান্ড ট্রেড (গ্যাট) নামের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন কর্মসূচী প্রণয়ন করা এবং মুক্তবাজার অর্থনীতিকে গতিশীল করার উদ্দেশ্যে ১৯৪৭ সালে জেনেভায় এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গ্যাট মূলত একটি বাণিজ্যিক চুক্তি। এ চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে চুক্তিটিকে একটি বহুপাক্ষিক বাণিজ্য সংস্থায় রূপান্তর করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ প্রয়োজনেই ১৯৪৭ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত গ্যাটের কর্তৃত্ব আরও শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে চুক্তিটির আলোচনার মাধ্যমে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা গঠনের উদ্যোগ শুরু হয়। অবশেষে ১৯৮৬ সালে গ্যাটের উরুগুয়ে রাউন্ড আলোচনার মধ্য দিয়েই চুক্তিটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) রূপান্তর লাভ করে। ১৯৯৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১১৭টি দেশ এ চুক্তিতে সম্মত হয়। বাংলাদেশ প্রথমদিকেই এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। সংস্থার লক্ষ্য ছিল সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক ভারসাম্য রক্ষা করা। কিন্তু বাণিজ্যিক ছাড়ের ক্ষেত্রে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণে সংস্থাটি কার্যত ব্যর্থ হয়, যার বড় উদাহরণ ‘দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডা’ বা দোহা রাউন্ড নিয়ে কোন অগ্রগতি না হওয়া। এজেন্ডার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার অধিকারী দরিদ্র দেশগুলোর সমান অংশগ্রহণ। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর আপত্তির কারণে ধনী-দরিদ্র দেশগুলোর মাঝে বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষার এ আলোচনা আটকে যায়। পৃথিবীজুড়ে বাণিজ্য যথাসম্ভব অবাধ করা নিয়ে ২০০১ সালে পুরোদস্তুর আলোচনা শুরু হয় দোহায়। কিন্তু সমঝোতা হয়নি। কারণ বাণিজ্যনীতি নিয়ে তখন থেকেই মতান্তর শুরু হয়েছিল আমেরিকা, ইউরোপের মতো উন্নত দুনিয়ার সঙ্গে ভারত, চীনের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর। এর পর অবাধ বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়তে ২০১৩ সালে চুক্তি (ট্রেড ফেসিলিটেশন এগ্রিমেন্ট) হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার বালিতে। কিন্তু অচলাবস্থা তৈরি হয় তা নিয়েও। কারণ ওই চুক্তিতে খাদ্যপণ্যে ভর্তুকির সীমা (১০ শতাংশ) বেঁধে দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। আপত্তি তোলা হয়েছিল খাদ্যপণ্য মজুদ করা নিয়েও। তা নিয়ে বেঁকে বসে ভারত। শেষ পর্যন্ত গণবণ্টনের জন্য শস্য মজুদ রাখার ব্যবস্থা এবং ওই একই লক্ষ্যে দেয়া খাদ্যে ভর্তুকি বজায় রাখা নিয়ে ভারতের দাবির সঙ্গে একমত হয় আমেরিকা। জানায়, যতদিন না ডব্লিউটিওর সদস্য দেশগুলো এ নিয়ে স্থায়ী রফাসূত্র বার করবে, ততদিন চালু থাকবে ওই ভর্তুকি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব বাধা কাটিয়ে ২০১৪ সালে জেনেভায় সদস্য দেশগুলো সিলমোহর দেয় অবাধ বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থা চুক্তিতে। এ চুক্তির সঙ্গে জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১২২টি দেশের জন্য জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করা হলেও বাংলাদেশ এখনও উপেক্ষিত। অন্যতম প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বিনা শুল্কে তৈরি পোশাক রফতানির সুযোগ পেলেও বাংলাদেশ স্থগিত হওয়া জিএসপি সুবিধাই ফিরে পাচ্ছে না। ফলে শঙ্কা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশী তৈরি পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায়। এমনিতেই বাংলাদেশী তৈরি পোশাকশিল্প প্রায় ১৬ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর থেকেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে একটি নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড ইউনিয়ন ও সেই সঙ্গে বেশকিছু মানবাধিকার সংগঠন অত্যন্ত শক্ত অবস্থানে গিয়েছিল, যা কি-না জিএসপি সুবিধা বাতিলের বিষয়ে একটি ‘ভূমিকা’ রেখেছিল বলে ধরে নেয়া হয়। যদিও প্রায় ১৬ শতাংশ (১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ) শুল্ক পরিশোধ করেই বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের বাজার ধরে রেখেছে। তবে শঙ্কা হচ্ছে ভারতকে নিয়ে। পোশাকশিল্প খাতে ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল মার্কেট ধরতে আটঘাট বেঁধেই নেমেছে ভারত। এজন্য সরকারী পর্যায়ে যেমন ছয় হাজার কোটি রুপীর প্রণোদনা প্যাকেজ নেয়া হয়েছে, তেমনি উদ্যোক্তাদেরও লক্ষ্য ঠিক করে দিচ্ছে ভারত সরকার। ২০১৮ সালে ২০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি লক্ষ্যমাত্রাকে ২০২৫ সালেই ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায় তারা। আর এমনটি হলে বর্তমানে তৈরি পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশের জন্য আগামী কয়েক বছরেই সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হবে ভারত। ভারতের পোশাক প্রস্তুতকারক এ্যাসোসিয়েশনের (সিএমএআই) সভাপতি রাহুল মেহতা আশা করছেন, ২০১৮ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে ভারতের রফতানি ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। তিনি বলেন, ২০১৭ অর্থবছরে আমরা ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আশা করছি। একই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ অর্থবছরে ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে ২০ বিলিয়ন ডলার রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। তবে এখনই ভারত বাংলাদেশকে তৈরি পোশাকশিল্পে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে না বলে মনে করেন বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি এবং ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম, বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি আবু তৈয়ব। তিনি বলেন, ভারত সরকার যে বিশাল প্রণোদনা দেয়া শুরু করেছে তাতে হয়ত বাংলাদেশের পোশাকশিল্প কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে এখনই ভারত বাংলাদেশের সমপর্যায়ে আসতে পারবে না। তারচেয়ে ভিয়েতনাম যদি আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে আমাদের পেছনে ফেলে তাতে আমি আশ্চর্য হব না। উদ্যোক্তারা বলছেন, ভারতে উৎপাদন খরচ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। শ্রমের মূল্যও বেশি সেখানে। শ্রমঘন শিল্পে ভারত এখনও উপযোগী নয়, বরং প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পে তারা বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। তবে এ নিয়ে বাংলাদেশের আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। সরকারকে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। প্রতিদ্বন্দ্বীরা কিভাবে এগোচ্ছে সেটা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। সরকারকেও সে অনুযায়ী সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, নানা প্রতিকূলতার পরও ২০১৬ সালে তৈরি পোশাক খাতে বিশ্ব বাজারে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। এবারও শীর্ষ রফতানিকারক দেশ চীনের পরেই অবস্থান। ২০১৬ সালে চীনের রফতানি আয় কিছুটা কমলেও দেশটি ১৬১ বিলিয়ন ডলার রফতানি করে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। তবে এ আয় আগের বছরের চেয়ে ৭ শতাংশ কম। অন্যদিকে ৬ শতাংশ বেড়ে বাংলাদেশ এ সময় আয় করেছে ২৮ বিলিয়ন ডলার। মোট রফতানিতেও চীনের অংশ ৩৬.৪ শতাংশ। মোট পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের অংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৪ শতাংশে। শীর্ষ দশে বাংলাদেশের পরে রয়েছে ভিয়েতনাম। দেশটি গত বছর ২৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করেছে। তাদের রফতানি বেড়েছে ৫ শতাংশ। মোট বাজারে ভিয়েতনামের অংশ ৫.৫ শতাংশ। চতুর্থ অবস্থানে থাকা ভারত রফতানি করেছে ১৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক। বিশ্ব রফতানিতে ভারতের অংশ ৪ শতাংশ।
×