ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রার ৭৫ শতাংশের বেশি বিক্রি

সঞ্চয়পত্র থেকে প্রয়োজনীয় খরচ মেটাচ্ছে সরকার

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১৫ জানুয়ারি ২০১৬

সঞ্চয়পত্র থেকে প্রয়োজনীয় খরচ মেটাচ্ছে সরকার

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ সুদহার কমানোর পরও বিক্রি বাড়ছে সঞ্চয়পত্রের। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার কারণে এ খাতে ভর্তুকির পরিবর্তে এখন বড় অঙ্কের আয় আসছে সরকারের। এমন প্রেক্ষাপটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার যে পরিমাণ ঋণ নিচ্ছে, পরিশোধ করছে তার চেয়ে বেশি। সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ায় সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে সঞ্চয়পত্র থেকে ধার করেই প্রয়োজনীয় খরচ মেটাচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নবেম্বর) ১১ হাজার ৩২৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করেছে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতর। এই সময়ে লক্ষ্যমাত্রার ৭৫ শতাংশের বেশি বিক্রি হয়েছে সঞ্চয়পত্র। জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নবেম্বর) এ খাতে নিট বিক্রি হয়েছে ১১ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৮৪ কোটি টাকা বেশি। গত অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নবেম্বর) মাসে সঞ্চয়পত্রে নিট বিক্রি আসে ১১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। গেল চার মাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে পরিবার সঞ্চয়পত্র। এরপরে রয়েছে তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক এবং পাঁচ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্র। পরিসংখ্যান বলছে, গত জুলাই মাসে সঞ্চয়পত্রে বিক্রি আসে ১ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা, গত বছরের চেয়ে ১১৮ কোটি টাকা বেশি। আগস্ট মাসে সঞ্চয়পত্রে বিক্রি আসে ২ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ১৮০ কোটি টাকা বেশি। একক মাস হিসেবে সেপ্টেম্বরে বিনিয়োগ আসে ২ হাজার ৬৫ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৪২৭ কোটি টাকা কম। অক্টোবর মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আসে ২ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা ৩ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৯৬ কোটি টাকা বেশি। নবেম্বর মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আসে ২ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোতে আমানতের সুদের হার হ্রাস এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে একটু বেশি লাভের আশায় সবাই ‘নিরাপদ’ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে বলে মনে করেন অর্থনীতি গবেষক জায়েদ বখত। তিনি বলেন, সুদের হার কমানোর পরও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে এখনও অন্য যে কোন স্কিম থেকে বেশি মুনাফা পাওয়া যায়, সে কারণেই বিক্রি বাড়ছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় ঋণের ভার কমাতে গত ২৩ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার প্রায় ২ শতাংশ করে কমায় সরকার। তবে ওই সময়ের আগে যারা সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন, তারা আগের সুদেই মুনাফা পাবেন বলে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর জানায়। বিক্রি ক্রমাগত বাড়তে থাকায় ঋণের বোঝা কমাতে সরকার ‘বাধ্য হয়েই’ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়েছে বলে মনে করেন জায়েদ বখত। ২৩ মের আগ পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদী পরিবার ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র কিনলে ১৩ দশমিক ৪৫ ও ১৩ দশমিক ২৬ শতাংশ হারে সুদ পাওয়া যেত। সুদের হার কমানোর পর এখন কেউ পাঁচ বছর মেয়াদী পারিবারিক সঞ্চয়পত্র কিনলে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ হারে সুদ পাবেন। আর পাঁচ বছর মেয়াদী পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ হয়েছে। ৩ বছর মেয়াদী ৩ মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে সুদ হার ঠিক করা হয়েছে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে তিন বছর মেয়াদী ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে সুদ হার ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ এবং পাঁচ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ করা হয়েছে। চলতি ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমলেও ব্যাংকের আমানতে সুদহারের তুলনায় অনেক বেশি। এজন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। তবে মুনাফা কমায় সামনের দিনগুলোতে বিক্রি কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন। এই গবেষকের মতে, শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিনের মন্দা এবং ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার কমানোয় নিরাপদ বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুঁকেছেন সবাই। গত ২০ ডিসেম্বর ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম বাংলাদেশ (আইবিএফবি) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, আমাদের দেশে বিনিয়োগের বড় বাধা হচ্ছে ঋণের সুদ হার। ব্যাংকগুলো নিজেরাই সুদ হার নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু তারা সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনছে না। এ সময় ব্যবসায়ী শিল্পদ্যোক্তারা সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর দাবি জানালে মুহিত বলেন, ব্যাংকগুলো যদি ঋণের সুদের হার কমায় তাহলে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও কমানো হবে। গত অর্থবছর সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ৯ হাজার ৫৬ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে সরকার। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে করা হয় ২১ হাজার কোটি টাকা। তবে অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ২৮ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা পায় সরকার। এবার এ খাত থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তবে নবেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসেই নিট ১১ হাজার ৩২৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। আগের অর্থবছরে একই সময়ে যা ১১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা ছিল। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্রে গড়ে ২ শতাংশ হারে সুদহার কমানোর পরও এবার বিক্রি বেশি হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে সরকারের মোট ঋণ কমে এক লাখ ১ হাজার ৯০৫ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। ছয় মাস আগে গত জুন শেষে যা এক লাখ ৫ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা ছিল। এ হিসাবে ছয় মাসে সরকারের নিট ঋণ কমেছে ৩ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে সরকারের মোট ঋণের মধ্যে ৯৩ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা নেয়া হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে। বাকি ৮ হাজার ১৭৯ টাকা নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যেও অর্থবছর শেষে ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ বর্তমানের মতো ঋণাত্মক ধারায় থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
×