ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৭ জুন ২০২৪, ৩ আষাঢ় ১৪৩১

তরুণদের ভাবনায় কবি নজরুল

প্রকাশিত: ০০:১২, ২৬ মে ২০২৪

তরুণদের ভাবনায় কবি নজরুল

.

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সাম্য, সম্প্রীতি, দ্রোহ, প্রেম গণমানুষের কবি। শৈশবে লড়েছেন দারিদ্র্যের সঙ্গে আর যৌবনে সংগ্রাম করেছেন শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে। নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েও বঞ্চিত মানুষের পক্ষে চালিয়েছেন লেখনী। কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা বৈষম্যের বিরুদ্ধে থেকেছেন আপোসহীন। সংগীতে সৃষ্টি করেছেন স্বতন্ত্র ধারা। কবিকে স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে এনে দেওয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা। কবির কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত ময়মনসিংহ ত্রিশালে ২০০৬ সালে গড়ে ওঠে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। কবির ১২৫তম জন্মজয়ন্তী বাংলাদেশে আগমনের ৫২তম বছরে কবিকে নিয়ে কী ভাবছেন নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা তা তুলে ধরছেনÑ অনিরুদ্ধ সাজ্জাদ

 

বাঙালির মুক্তির প্রবক্তা

বাঙালির সর্বমানবিক মুক্তির প্রবক্তা বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সর্বসাধারণের কবি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দে জন্ম নেওয়া এই কবি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক এবং দেশপ্রেমিক ছিলেন। নজরুলের চিন্তা-চেতনায় বাঙালি জাতি তথা পরাধীন ভারতবাসীকে স্বাধীনতাকামী করতে অনুপ্রাণিত করেছে। অবহেলিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত বাঙালি তার দ্রোহের অনির্বাণ শিখায় জ্বলে উঠেছে বজ্রশপথে। অনাচার অত্যাচারের প্রতিরোধে উৎপীড়িতের চিরদিনের প্রেরণা তিনি। বাংলা সাহিত্যে নজরুলই প্রথম, যিনি গণমানুষের পক্ষে এবং শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে লেখার জন্য কারাবরণ করেছেন। তার গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হয়েছে, পত্রিকা বন্ধ করা হয়েছে; তবু তার প্রতিবাদী কণ্ঠ পৌঁছেছিল পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী মানুষের চিত্তে। কবির চেতনা আদর্শ চিরভাস্বর হয়ে আছে আমাদের জীবনে। ১৯৭২ সালে ২৪ মে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কবিকে নাগরিত্ব প্রদান করেন। একই বছর ২১ ফেব্রুয়ারি কবিকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। নজরুলের জন্মজয়ন্তী উদযাপনে বরাবরের মতো এবারও মনোজ্ঞ আয়োজন করবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। বছর নজরুল জয়ন্তী শুধু ত্রিশালের নামাপাড়ায় সীমাবদ্ধ নয়, প্রথমবারের মতো জাতীয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদযাপিত হবে। এভাবেই বাংলাদেশের জাতীয় কবি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকুক সকলের হৃদয়ে।

ইয়াসমিন আক্তার স্মৃতি 

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

 

ভাবনায় কবি নজরুল

বাংলা ভাষা সাহিত্যের নক্ষত্র কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি প্রেম-দ্রোহ-মানবতা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিলেন ধূমকেতুর ন্যায়। আমৃত্যু গেয়েছেন মানবতার জয়গান। লিখেছেনÑ ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।কবি নজরুল শুধু কবিই নন, ছিলেন অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এক বীরযোদ্ধা। তিনি কবিতা আর গানে জাগিয়ে গেছেন বিদ্রোহ। দ্রোহের পাশাপাশি তিনি শুনিয়েছেন প্রেম-বিরহের কবিতা, গানও। ২৪ মে, কবির ১২৫তম জন্মবার্ষিকী। শৈশব থেকে দুঃখ দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বেড়ে ওঠা এই দুখু মিয়া মাত্র ১২ বছর বয়সে যোগ দিয়েছিল লেটোর দলে। দারিদ্র্য ঘোচাতে ১৯১২ সালে আসানসোলে কারিগর হয়েছিলেন চা-রুটির দোকানেও। পরিচিত হয়ে উঠেছেন কবি, দার্শনিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, সৈনিক, সাংবাদিক, অভিনেতা প্রভৃতি পরিচয়ে। তিনি কলম ধরেছিলেন শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে। তার লেখনী ছিল শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে। ফলে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল তার বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, প্রলয় শিখা, চন্দ্রবিন্দু যুগবাণী গ্রন্থগুলো। হয়েছেন কারাবন্দিও। নজরুল মানেই সাম্যবাদী মনোভাবের এক নক্ষত্র। সাম্যের জন্য লড়ে যাওয়া এক অকুতোভয় সৈনিক; যার কলমের কালি ইংরেজদের বুকে ছুড়েছে বিষাক্ত তীর। আপন ভঙ্গিতে, আপন খেয়ালে, স্বকীয়তায় সাহসিকতায়Ñ এমন লেখনী বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ। দুরন্ত, সাহসী, মুক্ত খেয়ালিপনার এই মহামানবের জন্মদিনে রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

শাহরিয়ার সুমিত ইমরান

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

 

অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি

ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে মানবমঙ্গলের গান গেয়ে, নিপীড়িত মেহনতি মানুষের প্রগতি চেয়েছেন যিনি, তিনিই জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি অত্যাচারিতের প্রতিনিধি, সাম্যের বাহক, বৈষম্যের বিদ্রোহী, গেয়েছেন মানুষের জয়গান আর প্রাণে ছিল তারুণ্যের জয়োল্লাস। যেখানে সাম্প্রদায়িকতা ছিল তার কাছে ঘৃণ্য, মানুষ মানবতার কল্যাণ চিন্তাই ছিল মূল শক্তি। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনে নজরুলের অসংখ্য বৈচিত্র্যপূর্ণ রচনার অবদান অনস্বীকার্য। তার লেখায় উঠে এসেছে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর বীরপুরুষদের বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী। কবি যেমন ইসলামি ভাবধারার গান লিখেছেন তেমনি লিখেছেন শ্যামা সঙ্গীতও। তার কবিতায় মানুষ-মানবতা, সাম্য-একতার যে উপাদান তা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তারুণ্যের বুকে।

সাইফুল ইসলাম

শিক্ষার্থী, মার্কেটিং বিভাগ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

 

জাতীয় কবির স্বীকৃতিতে প্রজ্ঞাপন হোক

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জাতীয়তাবাদের কবি। অসাম্প্রদায়িক, সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের যুগ প্রবর্তক কবি, স্বাধিকার আন্দোলন সংগ্রামী চেতনার কবি। সাম্যবাদী চেতনার অন্যতম আদর্শ কবি কাজী নজরুল ইসলাম কুলি-মজুর কবিতায় বলেছেন, ‘সকল কালের সকল দেশের সকল মানুষ আসি/এক মোহনায় দাঁড়াইয়া শোনো এক মিলনের বাঁশী।

মানুষ সমাজের মূল্যবোধ পরিবর্তনে কবির প্রচেষ্টা ছিল চির দুর্বার। সমাজের সর্বস্তরের অসাম্য প্রতিরোধ করতে কবির লেখনী হয়ে উঠেছিল হিমালয়ের মতো অনড়। তার রচনায় স্থান পেয়েছে অস্তিত্ববাদী মানবতাবাদী চিন্তার নিঃশঙ্কোচ প্রকাশ; দরিদ্র-ক্ষুধার্ত-অত্যাচারিত জনতার জন্য শ্রম আর সৌন্দর্য উপভোগের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় বেজেছে কবির কথামালায়, সংগীতে। নজরুলের সৃষ্টিশীল কর্মজীবনের মূলমন্ত্র ছিল জাতি-ধর্ম-গোত্রের বিভেদমোচন। অথচ জাতীয় পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন আয়োজনে কাজী নজরুল ইসলামকেজাতীয় কবিলেখা হলেও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, জাতীয় আর্কাইভ, নজরুল ইন্সটিটিউট বাংলা একাডেমির কোথাও নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করা সংক্রান্ত কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি বা দলিল পাওয়া যায়নি। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সংসদে আইন পাস করে এই স্বীকৃতি দেওয়া উচিত বলে মনে করছি। তবে সরকারি দলিলে বিভিন্ন প্রসঙ্গে নজরুলকেজাতীয় কবিহিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাকে জাতীয় কবি উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় (জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ) বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ প্রণীত হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতের স্বীকৃতি সংরক্ষণের বিষয়টি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আজকের বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যে চেতনা তার নাম মানবতা।মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, নহে কিছু মহীয়ান’-আজ যেন আমাদের প্রাত্যাহিক উচ্চারণের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাইসা ইসলাম জীম

শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়

×