
লাঙ্গলবন্দে নিপুণ হাতে এক কারিগর বাঁশ ও সুতা দিয়ে বুনছেন মাছ ধরার বানা
এক সময়ের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ছিল নিপুণ হাতে বাঁশের তৈরি মাছ ধরার ‘বানা’। খাল-বিল, নদী-নালা থেকে মাছ ধরার নানা উপকরণ রয়েছে। বাঁশের তৈরি বানাও মাছ ধরার একটি অন্যতম উপকরণ। এখনো গ্রাম-গঞ্জে বানা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন অনেক মানুষ। কারিগরদের নিপুণ হাতে তৈরি করা হয় বানা। এখনো যেসব এলাকায় খাল-বিল, নদী-নালা রয়েছে, সেসব এলাকায় বানার চাহিদাও রয়েছে প্রচুর।
তবে বানা তৈরির কারিগর ও ব্যবসায়ীদের আক্ষেপ- প্লাস্টিকের মাছ ধরার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বের হওয়ায় বানার চাহিদা দিন দিন কমে এসেছে। বানা তৈরি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই বানার চাহিদাও কমে আসছে। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী বানা। তবুও এক সময়ের বানা তৈরির বাপ-দাদার আদি পেশাটি এখনো অনেকেই ধরে রেখেছেন।
তাদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার লাঙ্গলবন্দের তাজপুরের বারপাড়ার আদি বহ্মপুত্র নদের তীরের বাসিন্দা মো. আনছার আলী এখনো তার বাপ-দাদার আদি পেশাটি ধরে রেখেছেন। তিনি বাঁশ দিয়ে নিখুঁতভাবে বুনছেন মাছ ধরার বানা। তবে কতদিন তিনি এ বানা তৈরির পেশাটি ধরে রাখতে পারবেন, তা তিনি নিজেও জানেন না। শুক্রবার দুপুরে বানা বোনার কারিগর ও ব্যবসায়ী আনছার আলীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি জানালেন, তার নিখুঁত হাতের তৈরি বানার আদ্যোপান্ত ও সুখ-দুঃখের নানা কাহিনী।
সত্তরোর্ধ্ব মো. আনছার আলী। পিতা মৃত সাজ্জাদ আলী। আনছার আলীর বাবার হাত ধরে তিনি এ পেশায় এসেছেন। এক সময়ে আনছার আলী বাবার সঙ্গে নদী-নালা, খাল-বিলে মাছ ধরতেন। মাছ ধরার পাশাপাশি বানা তৈরির কাজও করতেন। আনছার আলী বলেন, বাঁশ চিরে নিখুঁত হাতে বানা বোনা হয়। এটি একটি হস্তশিল্প। এ সময়ের বাঁশের তৈরি বানা খুবই চাহিদা ছিল। কারণ তখন খাল-বিল, পুকুর, নদী-নালায় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এখন আর আগের মতো নদী-নালায়, খাল-বিলে আর মাছ পাওয়া যায় না।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখন মিল-কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত ঝাঁঝাল পানি নদী-নালা, খাল-বিলে ফেলায় মাছ বসবাস করতে পারে না। তাই দিন দিন নদী-নালা, খাল-বিলে এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। দিন দিন নদী-নালা ও খাল-বিল মাছশূন্য হয়ে পড়ছে। তাই মাছ ধরার উপকরণের চাহিদাও দিন দিন কমে আসছে। তিনি বলেন, তবুও বানা তৈরি ও বিক্রি করা বাপ-দাদার পেশা এটি। তাই আমি বাপ-দাদার পেশাটি এখনো আঁকড়ে ধরে রেখেছি।
বানা বুনতে বাঁশ ও নাইলনের কট সূতার প্রয়োজন হয়। তবে প্রধান উপকরণ হচ্ছে বাঁশ ও সূতা। বাঁশ চিরে শলা কেটে তারপর সুতা দিয়ে বানা বুনতে হয়। বানা তৈরি সম্পূর্ণ হাতের কাজ। নদী-নালা ও খাল-বিলে বানা দিয়ে চারদিকে আটকিয়ে মাছ ধরা হয়। এ ছাড়াও চারদিকে বানা দিয়ে আটকিয়ে নদী-নালা ও খাল-বিলে মাছ চাষও করা যায়। মাছ ধরার অন্যতম উপকরণ হচ্ছে বাঁশের তৈরি বানা। আনছার আলী বলেন, বানা বিভিন্ন সাইজের হয়ে থাকে।
পনেরো ফুট লম্বা ও ছয় ফুট চওড়া একটি বানা বিক্রি করা হয় এক হাজার চারশ’ টাকায়, পনেরো ফুট লম্বা ও সাড়ে চার ফুট চওড়া বানার দাম নয়শ’ টাকা থেকে সাড়ে নয়শ’ টাকা ও পনেরো ফুট লম্বা ও সাড়ে সাত ফুট চওড়া তৈরি বানার দাম দুই হাজার থেকে দুই হাজার দুইশ’ টাকা।
সোনারগাঁয়ের বৈদ্যেরবাজারসহ বিভিন্ন স্থান থেকে বাঁশ ও রপাই মুলি বাঁশ সংগ্রহ করে লাঙ্গলবন্দে আনতে হয়। এ ছাড়াও বানা তৈরির সরঞ্জাম সুতা সোনারগাঁয়ের মোগড়াপাড়া হরুপদি ও কাইকারটেক হাট থেকে সংগ্রহ করেন। পরে বাঁশ চিরে শলা বের করতে হয়। শলাগুলো আবার রোদে শুকাতে হয়। শলা শুকাতে ও নিখুঁত করতে নারীদের ছোঁয়া লাগাতে হয়।
সর্বশেষ শলা ও সুতা দিয়ে কারিগররা মাছ ধরার নানা সাইজের বানা তৈরি করেন। আনছার আলী বলেন, বুনানো বানা পাইকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোকজন এসে পাইকারি কিনে নিয়ে যান। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা থেকে লোকজন এসে তৈরি বানা নিয়ে যান। এ ছাড়াও কুমিল্লা, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এসে আনছার আলীর কাছ থেকে বুনানো বানা মাছ ধরতে ও মাছ চাষ করতে নিয়ে যান। তবে বর্ষা মৌসুমে বানার চাহিদা বেড়ে যায়।
আনছার আলীর কারখানায় ২৫-৩০ জন কারিগর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিখুঁতভাবে বানা তৈরি করেন। কারিগর একটি বড় আকৃতির বানা তৈরি করতে পারলে দুইশ’ চল্লিশ টাকা আয় করতে পারেন। একজন কারিগর একদিনে তিন-চারটিও বানা বুনতে পারেন। এ কারখানায় ১৫-২০ জন নারীও বানার সরঞ্জাম তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করেন। আনছার আলী আক্ষেপ করে বলেন, দিন দিন বানার চাহিদা কমে আসছে।
এখন তিনি কোনোমতে বানা বুনানোর পেশা ও বিক্রি ধরে রেখেছেন। এক সময়ে মনের আনন্দে বানা তৈরি করতেন এবং বিক্রি করতেন। কিন্তু এখন আদি পেশা বলেই এটি এখনো ধরে রেখেছেন তিনি। অনেকেই এ পেশাটি বদলিয়ে অন্য পেশায় ঢুকে পড়েছেন। লাঙ্গলবন্দে এক সময়ে বহু পরিবার বানা তৈরির পেশায় ডুবে ছিলেন। এখন মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার এ পেশায় ডুবে আছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, প্লাস্টিকের মাছ ধরার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বের হওয়ায় বানার চাহিদা দিন দিন কমে এসেছে।
যতই দিন যাচ্ছে, ততই বানার চাহিদাও কমে আসছে। তিনি বলেন, তার চার ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। বানা বোনা ও বিক্রির পেশায় আনছার আলী তার কোনো ছেলেকে যোগদান করাতে পারেননি। তারা অন্য পেশায় ঝুঁকে পড়েছে। হয়তো একদিন বানা তৈরির পেশাটিও বিলীন হয়ে যাবে। তবুও আনছার আলী আজীবন এ পেশাই ডুবে থাকতে চান।