
.
পৃথিবীর তিন ভাগের দু’ভাগই পানি, এরপরেও পৃথিবী জুড়ে বাড়ছে পানির সঙ্কট। কারণ তিনভাগ পানির বড় অংশই নোনা পানি। পৃথিবীর মোট পানির মাত্র আড়াই শতাংশ হলো মিঠা পানি, যেটি আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ এবং পানীয় হিসেবে পান করি। তবে এই মিঠা পানির তিন ভাগের দু’ভাগ বন্দী বরফের কারাগারে। দুই মেরুর বরফ ছাড়াও হিমবাহগুলোর দখলে থাকা মিঠা পানির এই ভান্ডার সাধারণের নাগালের বাইরে। ভূগর্ভে লুকায়িত আছে বাকি এক-তৃতীয়াংশের সিংহভাগ। তাই একদিকে যখন পৃথিবী জুড়ে ভূগর্ভস্থ পানির মজুদ ধীরে ধীরে কমে আসছে, অন্যদিকে মেরুর বরফ গলে তা সমুদ্রে যুক্ত হওয়ায় নোনা পানির পরিমাণও বাড়ছে। তাই ব্যবহারযোগ্য পানির সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে বিশ্বজুড়ে।
কৃত্রিম কিংবা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট মরুভূমিতে পানির সমস্যা পৃথিবীর অন্য যেকোন অঞ্চলের চাইতে প্রকট। আর এই সমস্যা সমাধানে কুয়াশা থেকে পানি সংগ্রহ করার এক অভিনব পন্থা কাজে লাগানো হয়েছে সাহারা মরুভূমি সংলগ্ন দেশ মরক্কোতে। Fog water harvesting system’ নামে পরিচিত এই প্রযুক্তি স্বস্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে রুক্ষ-শুষ্ক পাহাড়ী এই অঞ্চলগুলোতে।
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাবার পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের রুদ্রমূর্তি সাহারা মরুভূমিকে টেনে বড় করে দিচ্ছে। ফলে জনবসতিগুলোর আশপাশের এলাকাগুলোতেও হচ্ছে কৃত্রিম মরুকরণ। আর তাই এই এলাকার মানুষগুলোর পানির চাহিদা পূরণ করতে সাহায্য নেওয়া হচ্ছে কুয়াশার। ৬০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে স্থাপিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘Fog water harvesting system’ ব্যবহার করে কুয়াশাকে পানিতে পরিণত করার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মরক্কোর বেসরকারী সংস্থা ‘দার সি হামদ’। এই প্রকল্পের ফলে বদলে গেছে এই এলাকার নারীদের জীবনযাত্রা। আগে প্রতিদিন পানি সংগ্রহের কাজে গড়ে তিন ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হতো তাদের। এখন এই সময়টি বেঁচে যাওয়ার ফলে নারীশিক্ষাসহ নারীদের সামগ্রিক জীবনযাত্রায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। হাজারো মানুষের জীবন পরিবর্তন করে দেওয়া এই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে সাহারা মরুভূমি সংলগ্ন অঞ্চলগুলোতে। জাতিসংঘের ক্লাইমেট চেঞ্জ পুরস্কারে ভূষিত হওয়া এই প্রকল্পের আদ্যোপান্ত নিয়েই আজকের এই লেখা।
ধান বা ঘাসের শিষের ওপর শিশির বিন্দু দেখেননি এমন মানুষ হয়তো খুঁজে বের করা মুশকিল হবে। কিন্তু ধান বা ঘাসের শিষের ওপর সেই ছোট্ট শিশির বিন্দু কেন জমে, তার কারণ জানলেই বুঝতে পারা যাবে এই প্রকল্প কিভাবে কাজ করে।
ঘাসের ওপর শিশিরবিন্দু জমার কারণ
ঘাস কিংবা যে কোন বড় গাছ তার খাদ্য উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে পাতায় পানি ব্যবহার করে। পানি, সূর্যালোক, কার্বন ডাইঅক্সাইড ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন করে। সূর্যালোক শেষ হয়ে এলে কিংবা খাদ্য উৎপাদন শেষ হয়ে এলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি পাতার বাইরে বেরিয়ে আসে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয়ে থাকে প্রস্বেদন। আর এভাবে বেরিয়ে আসা পানি পাতার গায়ের তাপমাত্রা আশপাশের চেয়ে কমিয়ে দেয়। ফলে পাতার চারপাশে থাকা জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে পানির বিন্দু আকারে পাতার গায়ে জমা হয়।
Fog water harvesting system’ প্রকল্পে তাপ সুপরিবাহী ধাতু দিয়ে নির্মিত বিশাল আকারের জাল ব্যবহার করা হয়। বাতাসে ভেসে বেড়ানো কুয়াশার গতিপথে স্থাপন করা হয় বিশালাকার এসব জাল। এই ধাতুর জালের তাপমাত্রা আশপাশের তাপমাত্রার চেয়ে খুব দ্রুত কমে যায়। একটি উদাহরণ ব্যাপারটিকে আরও বোধগম্য করবে। হাওয়ার চলাচল আছে এমন একটি জায়গায় একটি আলপিন এবং একটি কাঠের টুকরো রেখে দিলে আলপিনটি আগে ঠান্ডা হয়ে যাবে। ঠিক তেমনি, বাতাস চলাচলের পথে এসব ধাতু নির্মিত বিশাল আকারের জালে রেখে দেওয়া হয়। এটি দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যায়। ফলে আশপাশের বাতাসে থাকা জলীয়বাষ্প আর কুয়াশাকে দ্রুত ঘনীভূত করে। আর এলাকাটি যদি অধিক কুয়াশাপ্রবণ হয়!
ঘনীভূত এই জলীয় বাষ্পকে এই ধাতু নির্মিত জালের নিচে সংরক্ষিত পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। মূলত এই ধাতব জালের আয়তন যত বড় হবে, তত বেশি জলীয় বাষ্প কিংবা কুয়াশাকে ঘনীভূত করা যাবে। ৬০০ বর্গ মিটারের কুয়াশা ধরার একটি জাল থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬,৩০০ লিটার ব্যবহারযোগ্য পানি পাওয়া যায়, যা ৪০০ মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত। কুয়াশা থেকে পাওয়া পানি পরবর্তী ধাপে বিভিন্ন ধরনের পরিশোধনের মধ্য দিয়ে যায়। এই প্রযুক্তির উন্নতি সাধনে কাজ করছে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গবেষকরা। তাদের গবেষকরা এই প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। শুধু মরক্কোতেই নয়, আফ্রিকার নামিব মরুভূমি আর চিলির আতাকামা মরুভূমিতেও এই প্রকল্প ব্যবহার করে পানি উৎপাদন শুরু করা হয়েছে। চুলের চেয়ে চিকন স্টেইনলেস স্টিলে নির্মিত এই জালেই রচিত হচ্ছে লাখো মানুষের জন্য সুপেয় পানির স্বপ্ন।
কুয়াশাকে বন্দী করে পানিতে পরিণত করার প্রক্রিয়াটি বেশ সময়সাপেক্ষ এবং এটি সাধারণত পাহাড়ের উপরে অনেক উঁচুতে স্থাপন করা হয়। তাই যে নারীরা পানি সংগ্রহ করেন, তাদের দরকার উপযুক্ত সংকেত, যাতে তারা বুঝতে পারেন যে পাত্র পানিপূর্ণ হয়েচ্ছে। ‘দার সি হামদ’ এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে চালু করেছে এক অভিনব সেবা। কুয়াশাপানির পাত্র পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মরক্কোর নারীদের মুঠোফোনে একটি মেসেজ পৌঁছে যায়।
মূলত এই প্রকল্প চালু করা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করার খরচ খুবই কম। মরুভূমি এলাকায় দিনে তীব্র সূর্যের আলোয় বায়ুমন্ডলে বিপুল পরিমাণ জলীয় বাষ্প সঞ্চিত হয়। এই ধরনের জাল ব্যবহার করে জলীয়বাষ্পকে ব্যবহারযোগ্য পানিতে পরিণত করা সম্ভব। এই প্রকল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সাধারণ মানুষও কম খরচে নিজেরা কুয়াশা ধরার জাল বানিয়ে নিচ্ছেন।
এই প্রকল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত গবেষকদের মতে, প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে খুব কম খরচে মিঠা পানি পাওয়া যাবে। তাই সমুদ্র তীরবর্তী এলাকাগুলোতেও এই প্রকল্প ব্যবহার সম্ভব। কারণ পানি বাষ্প হওয়ার সময় লবণ সমুদ্রের পানিতেই থেকে যায়। ফলে বৃষ্টির পানির মতই কুয়াশা কিংবা জলীয় বাষ্পকে কাজে লাগিয়ে পাওয়া এই পানি শতভাগ লবণমুক্ত।
বদলে যাওয়া গ্রামগুলোই এখন অনুপ্রেরণা
সাহারা মরুর পাশে মরক্কোর যে গ্রামগুলোতে এই প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে, সেগুলো বদলে যেতে শুরু করেছে। এই প্রকল্প আসার আগে পানি পরিবহন করতে নারীদের গড়ে প্রতিদিন তিন ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় হতো। পাশাপাশি এই কাজে জড়িত তরুণীদের শিক্ষাজীবন এবং পারিবারিক জীবনের মূল্যবান সময়ের সিংহভাগ পানির বোঝা টানতেই ব্যয় হতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিতিও ছিল অনেক কম। কিন্তু এই প্রযুক্তি আসার পরে বদলে গেছে দৃশ্যপট। যেহেতু এখন নারীরা খুব সহজেই মোবাইলে এসএমএস পাবার মাধ্যমেই পানি সংগ্রহের সময় জেনে যান, ফলে সময়ক্ষেপণ কমে এসেছে, বেড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তরুণীদের উপস্থিতির হার। গৃহিণীরা পরিবারকে অধিক সময় দিতে পারছেন। পাশাপাশি তারা অনেকেই কুটির শিল্পের মাধ্যমে পরিবারের আয়ে ভূমিকা রাখতে পারছেন। এর মাধ্যমে শুধু সুপেয় পানির অভাবই পূরণ হয়নি, পাশাপাশি নারী ক্ষমতায়নের মাধ্যমে বদলে গেছে গোটা সমাজের চিত্র।