ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২

ড. মিহির কুমার রায়

প্রধানমন্ত্রীর দারিদ্র্য বিমোচন মডেল

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ১১ এপ্রিল ২০২২

প্রধানমন্ত্রীর দারিদ্র্য বিমোচন মডেল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রূপকল্প-২০২১-এর মূল উপজীব্য হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবায়ন শুরু হলে দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাসে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর সঙ্গে পরিকল্পনা ও নীতিতে সংযোজন হয় অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর সম্প্রসারণ। যেমন- ২০২০-২১ অর্থবছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশে কাজের বিনিময়ে দুস্থ ভাতাসহ ১২৩টির মতো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী চলছে, যাতে বাজেট বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ৯৫,৫৭৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির আড়াই শতাংশেরও বেশি। টানা তিন মেয়াদে সরকার পরিচালনার অভিযাত্রায় সমাজের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে নতুন নতুন কর্মসূচী যোগ হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রার বাংলাদেশ’ নির্বাচনী ইশতেহার দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে অসামান্য দলিল হিসেবে আবির্ভূত হয়। এ ইশতেহার বাস্তবায়নে সরকার একদিকে অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তরের লক্ষ্যে গ্রহণ করে নানামুখী প্রকল্প, অন্যদিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন এগিয়ে নিতে দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাসে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি বৃদ্ধি করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দারিদ্র্য বিমোচন মডেল পর্যালোচনায় দেখা যায়- মুজিববর্ষের শ্রেষ্ঠ উপহার হিসেবে বঙ্গবন্ধু মডেল ভিলেজ প্রকল্পটি গ্রামোন্নয়নের একটি সফল প্রয়াস। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সমবায় অধিদফতর ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ ধারণায় গ্রামের বৈশিষ্ট্য সমুন্নত রেখে ইতোমধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু মডেল ভিলেজ’ প্রকল্পের প্রস্তাবনা তৈরি করেছে। দেশের ১০ জেলার ১০ উপজেলার ১০ গ্রামে গড়ে পাঁচ হাজার করে মোট ৫০ হাজার মানুষ প্রকল্পটির উপকারভোগী হবেন। এই প্রকল্প দেশের আট বিভাগের নির্বাচিত জেলাগুলোয় বাস্তবায়ন করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে আগামী ১ জুলাই, ২০২২ থেকে এবং সমবায় অধিদফতর হবে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন সংস্থা। বঙ্গবন্ধুও কৃষি এবং পল্লী উন্নয়নকে সামগ্রিক উন্নয়নের মূল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। এই প্রকল্পেও গ্রামের বৈশিষ্ট্য সমুন্নত রেখে সম্পদের সুষ্ঠু ও সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃষির আধুনিকায়ন-যান্ত্রিকীকরণ এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, যোগাযোগ ও বাজার অবকাঠামো সৃষ্টির লক্ষ্যে বহুমুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার করে ১০টি গ্রামের কৃষি খাতে ২৫ শতাংশ কৃষি উৎপাদন বাড়ানো হবে। মধ্যম আয়ের দেশ থেকে পর্যায়ক্রমে উন্নত দেশের মর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষভাবে ১০ গ্রামের ১০ হাজার লোককে দক্ষভাবে গড়ে তুলে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা হবে। প্রত্যাশিত আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো হিসেবে ১০টি সমবায় সমিতি গঠনসহ প্রায় ৫ হাজার ৬০০ বর্গফুটের ১০টি কমিউনিটি ভবন নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ১০টি গ্রাম সমবায় সংগঠিত করা, কৃষি উৎপাদনের যান্ত্রিক ও উত্তম পদ্ধতির প্রচলন করা, ১০টি গ্রামে দুটি এক একর পুকুরে মৎস্য চাষ ও প্রাণিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় গরু পালনের মাধ্যমে আধুনিক ও উত্তম পদ্ধতির প্রচলন, গ্রামীণ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্জাগরণ এবং গ্রামীণ দারিদ্র্যের হার কমানোর লক্ষ্যে কাজ করা। প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা মোতাবেক গ্রামকে শহরে পরিণত করার জন্য সরকারী সম্পদের শতভাগ সুষম বণ্টন, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা অনুযায়ী রাস্তা, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ, শতভাগ ভিক্ষুকমুক্তকরণ, শতভাগ বাল্যবিবাহ রোধ, শতভাগ ডিজিটাল সেবা নিশ্চিত, বৃক্ষরোপণ, মাদক নির্মূল, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন, কৃষককে সর্বোচ্চ সুবিধা প্রদান, পরিচ্ছন্ন হাট-বাজার, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অগ্রগতি, গ্রাম আদালতের মাধ্যমে অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনা ও জবাবদিহির মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন। বর্তমান সরকারের ব্যাপক উন্নয়নে গত কয়েক বছরের ব্যবধানে বদলে গেছে দেশের চিত্র, যার আরও একটি সফল সংযোজন হবে এই প্রকল্প। কৃষি খাত ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, যেন গ্রামীণ অর্থনীতিও বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের দ্রুতগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। গ্রামীণ সমাজে জীবিকার বিচিত্রতা আনয়নের প্রচেষ্টায় দুটি প্রধান নিয়ামক রয়েছে- প্রথমত, গ্রামীণ অর্থনীতির প্রতিকূলতা, যা গ্রামীণ জনগণ, বিশেষত দরিদ্রদের বিদ্যমান খেত-খামারভিত্তিক কৃষি কাজের পাশাপাশি অকৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহিত করে। দ্বিতীয়ত, নতুন জীবিকার চাহিদা। এ ধারণা ব্যাপকভাবে গৃহীত যে, কৃষি খাতের সঙ্গে অকৃষি খাতের সম্মিলন দারিদ্র্য বিমোচনের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। অকৃষি খাতের উন্নয়ন সার্বিকভাবে কৃষি খাতের উন্নয়নকেও সহায়তা করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত বাংলাদেশে এ ধরনের জীবিকার সহমিশ্রণ গ্রামীণ সমাজকে আরও বেশি আত্মনির্ভরশীল করে তুলবে এবং দুর্যোগকবলিত এলাকাগুলোকে স্থিতিশীল হতে সহায়ক হবে। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন ছিল বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। জাতির পিতার অসমাপ্ত স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক সময়ে সর্বসাধারণের জন্য যে পেনশন ব্যবস্থা প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছেন তা প্রশংসনীয়। এটি দেশের সামগ্রিক সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। বৈষম্যহীন কল্যাণকর রাষ্ট্রগঠন ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার। সর্বসাধারণের জন্য পেনশন স্কিমের উদ্যোগ সরকারের দূরদর্শী চিন্তার একটি সফল প্রতিফলন। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী হিসেবে সর্বসাধারণের জন্য ঘোষিত পেনশন ব্যবস্থা উন্নয়ন অগ্রগতিতে আরও এক ধাপ নতুন মাত্রা সংযোজন। বর্তমান সরকার কিভাবে দেশের অসহায় ছিন্নমূল মানুষের জন্য কাজ করছে আশ্রয়ণ প্রকল্পই তার জ্বলন্ত প্রমাণ, যা সামগ্রিকভাবে পরিবারের কল্যাণ ও সামাজিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের আওতায় ৪ লাখ ৪২ হাজার ৬০৮ ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এ থেকে বাদ যায়নি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষ, হিজড়া এবং বেদে সম্প্রদায়ও। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীভুক্ত ৪ হাজার ৮৩২ পরিবারের জন্য গৃহ নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। পাহাড়ে বসবাসরত ৮ হাজার ১০৬ পরিবারকেও গৃহ প্রদান করা হয়েছে। তাদের পেশা উপযোগী প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ব্লক চেইন, আইওটি, ন্যানো টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, রোবটিকস, মাইক্রো প্রসেসর ডিজাইনের মতো ক্ষেত্রগুলোতে জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথে নেতৃত্ব দিতে সবাইকে একসঙ্গে উদ্ভাবনের পথে কাজ করতে হবে। তাহলেই আমরা এগিয়ে যাব। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার, বিদ্যুতের ব্যবহার এবং ট্রানজিস্টার আবিষ্কার ব্যাপক শিল্পায়ন সৃষ্টির মাধ্যমে মানবসভ্যতার গতিপথ বদলে দিয়েছিল বলে ওই তিন ঘটনাকে তিনটি শিল্পবিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখন বলা হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তির নিত্যনতুন উদ্ভাবনের পথ ধরে আসছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, যেখানে বহু প্রযুক্তির এক ফিউশনে ভৌতজগত, ডিজিটাল জগত আর জীবজগত পরস্পরের মধ্যে লীন হয়ে যাচ্ছে। ৪র্থ শিল্পবিপ্লব শুধু আমাদের কর্মজীবনকেই পরিবর্তন করছে না, পালটে দিচ্ছে সবকিছুকেই। এটি প্রভাব ফেলবে পরিচয় সত্তায় এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছুতে, ব্যক্তিগত গোপনীয়তায়, সম্পদ মালিকানার ধরনে, ভোগের ধরনে, কাজ ও বিশ্রামের সময়ে, কর্মজীবন গড়ায়, দক্ষতাচর্চায়, মানুষের সঙ্গে সাক্ষাতে এবং পারস্পরিক সম্পর্কেও। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় আর্থ-সামাজিক ব্যবধান কমিয়ে আনা হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন এগিয়ে নিতে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাবহির্ভূত অধিকাংশ (প্রায় ৬০ শতাংশ) মানুষকে (যাদের আবার অধিকাংশই গ্রামের মানুষ) ব্যাংকিং সেবার অন্তর্ভুক্ত করেছে। ১০ বছর আগে চালু হওয়া মোবাইল ব্যাংকিং খাতে নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যা ৯ কোটি ৬৪ লাখ এবং ২০২১ সালের এপ্রিলে লেনদেন হয় ৬৩ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস নগদ ও বিকাশের মাধ্যমে সরাসরি ৮৮ লাখ ৫০ হাজার ভাতাভোগীর কাছে ভাতা পৌঁছে দেয়া হয়। ভাতাভোগীদের মধ্যে রয়েছে ৪৯ লাখ বয়স্ক মানুষ, ২০ দশমিক ৫০ লাখ বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা এবং ১৮ লাখ প্রতিবন্ধী। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় আনা হয়েছে প্রতিবন্ধী, হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসরদের। বিগত বছরের জুন পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের সরকারী-বেসরকারী ২৮টি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেট রয়েছে ১৭ হাজার ৪৬৪টি। আউটলেটগুলোর মাধ্যমে মোট ১ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার ৩৫৮টি হিসাব খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৬ লাখ ৭৫ হাজার ৩২৯টি হিসাব নারীর। হিসাবগুলোয় জমা আমানতের পরিমাণ ২০ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ হয়েছে ৩ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান হলো দেশের এজেন্ট আউটলেটগুলোর মধ্যে ২ হাজার ১৯৯টি শহর এলাকায়, যা মোট আউটলেটের প্রায় ১৩ শতাংশ। বাকি ১৪ হাজার ৯৪৬টি গ্রামে। সে হিসেবে এজেন্ট আউটলেটের ৮৭ শতাংশেরও বেশি গ্রামাঞ্চলে থাকার কথা। তবে কিছু নগর অঞ্চলকেও গ্রাম হিসেবে দেখানোয় প্রান্তিক এলাকাগুলোয় এজেন্ট আউটলেটের সংখ্যা বেশি দেখাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকার রূপকল্প-২০৪১ ঘোষণা করে এর বাস্তবায়ন শুরু করেছে, যার লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও জ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। একই সময়ে একটি দারিদ্র্যমুক্ত দেশ উপহার দেয়া। ‘রূপকল্প-২০৪১’কে নীতিমালা ও কর্মসূচীসহ একটি উন্নয়ন কৌশলে রূপান্তরের জন্য এ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ দলিল মূলত ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ অর্জনে সরকারের উন্নয়ন রূপকল্প, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলোর কৌশলগত বিবৃতি এবং তা বাস্তবায়নের পথনক্সা। চারটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি যেমন- সুশাসন, গণতন্ত্র, বিকেন্দ্রীকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর প্রতিষ্ঠিত এ পরিকল্পনার সুফলভোগী হবে জনগণ এবং তারাই হবে প্রবৃদ্ধি ও রূপান্তর প্রক্রিয়ার প্রধান চালিকাশক্তি। দরিদ্রদের নিয়ে বর্তমান বাজেটে অনেক কিছু বলা হয়েছে, যেমন জীবন-জীবিকার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, এসডিজি ও রূপকল্প ২০২১-৪১-এর মূল লক্ষ্যই হচ্ছে দারিদ্র্য কমিয়ে আনা এবং ক্রমান্বয়ে শূন্য দারিদ্র্য লক্ষ্য অর্জন। সামাজিক সুরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি (বাজেটের ১৮ শতাংশ) হচ্ছে মূলত দরিদ্রদের ঘিরে ও সুরক্ষা ব্যয়ের ৭৫ শতাংশই সরাসরি দারিদ্র্যকেন্দ্রিক। কৃষি খাতের সব ব্যয় নিম্নমধ্যবিত্ত, খুদে ব্যবসায়ী, ভূমি শ্রমিক ও নিঃস্বদের জন্য ব্যয়িত, আছে অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচীতে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। সরকার পরিচালিত আটটি ফাউন্ডেশন/প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসৃজনে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দের কথা উল্লেখ আছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে দারিদ্র্য হ্রাসে ভূমিকা রাখবে এরূপ বরাদ্দের পরিমাণ মোট ৩ লাখ ৪২ হাজার ১০৬ কোটি টাকা (বাজেটের প্রায় ৫৭ শতাংশ)। বাজেটে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘পল্লীর দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর আয়বর্ধক কর্মকান্ড বৃদ্ধিতে পল্লী এলাকায় বিনিয়োগ বাড়ানো হবে। তাছাড়াও দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকার চলতি বছরের বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রেখেছে- ১ লাখ ৭০ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৭.৮ শতাংশ এবং জিডিপির ৩.১১ শতাংশ। এই খাত থেকে পল্লী অঞ্চলে বসবাসকারী অনেকেই সরাসরি উপকৃত হবে। এর মধ্যে আছে সমাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচী যথা বৃদ্ধভাতা, প্রতিবন্ধী, এসিড দগ্ধ, তালাকপ্রাপ্তা, মাতৃত্বজনিত ছুটি ভাতা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, কাবিখা, বিজিএফ, বিজিডি, অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসূচী, আশ্রয়ণ প্রকল্প, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধদের প্রশিক্ষণ এবং আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্প গ্রহণ, গৃহহীনদের গৃহ নির্মাণ প্রকল্প, ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন প্রকল্প ইত্যাদি। আগামী বছরে ১৫০টি উপজেলায় সব বয়স্ক ভাতার আওতায় আনলে আরও ৮ লাখ যোগ হয়ে মোট সংখ্যা দাঁড়াবে ৫৭ লাখ, যার জন্য অতিরিক্ত ৩ হাজার ৪২১ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হবে। এতে মাথাপিছু মাসিক ভাতার পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০১ টাকা। বাংলাদেশের সার্বিক দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচীর মৌলিক ভিত্তি হচ্ছে ড. আখতার হামিদ খানের কুমিল্লা মডেলের চার ধাপ যথাক্রমে পল্লী পূর্ত কর্মসূচী, টিটিডিসি, থানা সেচ কর্মসূচী ও দ্বিস্তরবিশিষ্ট সমবায়। দারিদ্র্য বিমোচন বাংলাদেশের বিগত ৫১ বছরের অন্যতম বড় কার্যক্রম, যার কিছু মডেল বিশ্বে প্রশংসা পেয়েছে তৃতীয় বিশ্বের কিছু দেশে জাতীয় কর্মসূচী হিসেবে। বাংলাদেশে দারিদ্র্য, আর্থিক অসচ্ছলতা, উর্ধমুখী অসমতা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা সত্ত্বেও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক রূপান্তর অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে এবং আজকের নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হিসেবে কাজ করতে পারে। বাংলাদেশে বিশ্বের অন্যতম বড় ক্ষুদ্রঋণ খাত আছে, যা ঋণ ফাঁদ থেকে গরিব পরিবারগুলোকে বেরিয়ে আসতে এবং নিজস্ব ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করতে সাহায্য করেছে। সরকার একটি কম্পিউটেবল জেনারেল ইকুইলিব্রিয়াম মডেল ব্যবহার করে দেখিয়েছে যে, ক্ষুদ্রঋণ নিছকই অর্থ গ্রহণের চেয়ে বেশি মাত্রায় পরিবারগুলোকে সাহায্য করেছে। এটি দেশটির জিডিপি ৯-১২ শতাংশ চাঙ্গা করেছে। তবে ভাগ্যগুণেও বাংলাদেশের অনেকটা সাফল্য এসেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সফলতার আরেক সোপান হচ্ছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, পোশাক রফতানি ও রেমিটেন্স। বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল থাকার পশ্চাতে সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সঠিক কর্মপন্থা ছাড়াও কৃষক, শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, ব্যাংকার, বৃহৎ ভোক্তাশ্রেণীসহ সবার অবদান অনস্বীকার্য। যে কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের সক্ষমতার বিষয়টি এখন স্বীকৃত। দারিদ্র্য বিমোচনের একটি বড় হাতিয়ার হলো বিদ্যুত, যা দিয়ে সরকার আালোকিত বাংলাদেশ তৈরির উদ্যোগে সফল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের গত দুই মেয়াদে বিদ্যুত খাতে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। সারাদেশে শতভাগ ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত নিশ্চিতে এই খাতে চলছে সুবিশাল কর্মযজ্ঞ। আওয়ামী লীগ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে দেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। সেটা আজ বাস্তব। দেশে এখন ৯৯.৫০% মানুষ বিদ্যুত সুবিধা পাচ্ছে, যা অচিন্তনীয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগেই স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর বিদ্যুত পেয়েছে ছিটমহলবাসী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দারিদ্র্য বিমোচন মডেল বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৪১ সালের আগেই দেশ হতে পারে প্রায় দারিদ্র্যশূন্য। লেকক : গবেষক, উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
×