
‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস/তোমার চোখে দেখেছিলেম/আমার সর্বনাশ। এ সংসারের নিত্য খেলায়/প্রতিদিনের প্রাণের মেলায়/বাটে ঘাটে হাজার লোকের/হাস্য-পরিহাস/মাঝখানে তার তোমার চোখে আমার সর্বনাশ। আবার কবি মহাদেব সাহা তার এই চৈত্রে কবিতায় লিখেছেন, এমন চৈত্রের রাতে আমি লিখি শ্রাবণের গান/বর্ষণ থামেনি আজো দুই চোখ জলে ভাসমান/সবাই উল্লাসে মাতে, চৈত্রনিশি করে উদযাপন/আমার ফাল্গুন নেই চৈত্রে নামে অঝোরে শ্রাবণ/এই চৈত্রে আমি বড় ভয়ানক মনঃকষ্টে আছি/এত যে ফুটেছে ফুল আমি তবু দুঃখ পেয়ে বাঁচি। কবিতার শেষ দুই লাইন আরও বেশি রোমান্টিক। এমন চৈত্রের রাতে দুঃখ পাই, কাঁদে বড়ো মন/সবার ফুলের মাস এই চৈত্রে আমার শ্রাবণ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কবি মহাদেব সাহার এই চৈত্র মাস নিয়ে এই কবিতা জোড়ই মূলত চৈত্র মাস নিয়ে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় একটি রোমান্টিক কবিতা। যে মাস নিয়ে এই আবেগ সেই মাসকে কি প্রেমের বোধের বাইরে ফেলা যায়। এই কবিতা পড়লেই চৈত্র মাস এবং বাঙালীর প্রেমের সম্পর্কটি চোখের সামনে ভাসে। প্রেমিকার চোখে মাতাল করা দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভূত হয়। এর ফলে ‘খটখটে’ ধরনের এই ঋতুতেও প্রেমিকার চোখ নেশা ধরায়। নিজেকে গভীরে ডুবিয়ে দিতে ইচ্ছে হয় প্রবলভাবে। ঋতুর সঙ্গে বাঙালীর সম্পর্ক আবেগিক। ঝুম বৃষ্টিতে এক অনুভূত হয় আবার গাছে গাছে ফুল ভরে গেলে অন্য অনুভূতি হয়। বাঙালীর প্রেম-ভালবাসা, আনন্দ-বেদনা, মান-অভিমান এসব কিছুর সঙ্গেই ষড়ঋতুর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বাংলায় আসা প্রতিটি ঋতুর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। ভিন্ন ভিন্ন সাজ। সেই বৈশিষ্ট্যসমূহ সাহিত্যের উপাদান। ঋতুর সঙ্গে প্রকৃতি বদলায়। কখনও আসে কচি পাতার দিন আবার কখনও পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে। কখনও মুষলধারে বৃষ্টিতে ভিজে যায় মাঠ-ঘাট আবার কখনও কুয়াশার চাঁদরে ঢাকা পরে প্রকৃতি। কখনও নতুন বউয়ের মতোন অলঙ্কার পরে হেসে ওঠে। ষড়ঋতু এবং বারো মাস নিয়েই এসব পরিবর্তন আবর্তিত হয়। এসব দেখেই কবিগণ কবিতা লেখে, গল্প, উপন্যাসে তার বর্ণনা পাওয়া যায়। সাহিত্যের বর্ণনায় প্রকৃতির সেসব রুপের খুঁটিনাটি উঠে আসে। ঋতুভিত্তিক কবিতা, গান, ছড়া বা গল্পেও ঋতুর বর্ণনার সঙ্গে বার বার কাহিনীর সংমিশ্রণ উঠে এসেছে। ফলে বাংলার ছয় ঋতু নিয়েই কমবেশি সাহিত্য রচিত হয়েছে। পত্রপত্রিকাগুলোতেও প্রকৃতির রূপ নির্ভার এসব ছড়া-কবিতা প্রায়ই চোখে পড়ে। ঋতুভিত্তিক আয়োজনও থাকে। বসন্ত সংখ্যা, শীত বা হেমন্ত নিয়ে প্রচুর আয়োজন থাকে। লেখাও চোখে পরে প্রচুর। সবচেয়ে বেশিবার এসেছে সম্ভবত ঋতুরাজ বসন্ত, বর্ষা, হেমন্ত, শরত এবং গ্রীষ্ম। এর মধ্যে বসন্তের ফাল্গুন নিয়েই প্রকৃতিপ্রেমী, কবি-সাহিত্যিকদের বেশি মাতামাতি, সমাদৃত। যদিও চৈত্র মাসও বসন্তকালের একটি মাস তবুও এ নিয়ে খুব বেশি আগ্রহ চোখে পড়ে না। সে অর্থে বলা যায় চৈত্র মাস সাহিত্যে কিছুটা অবহেলিত। কিন্তু কেন? হতে পারে চৈত্র মাসের রুক্ষতা এর পেছনের কারণ। গ্রীষ্মের যে খরতাপ তার শুরু হয় চৈত্রে। প্রকৃতির যে কঠোরতা তা লক্ষ্য করা যায় চৈত্রে। বাতাসে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। চোখে-মুখে ক্লান্তি ভাব আসে। তবে সত্যিকার অর্থে চৈত্র মাস বাঙালীর সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে জড়িত এবং বহুকাল পূর্ব থেকেই বাঙালী এই মাসের শেষ দিনে চৈত্র সংক্রান্তি উদযাপন করে। ফাল্গুনে যে প্রকৃতির রূপের সূচনা হয় তার পূর্ণতা আসে চৈত্রে। তাছাড়া ক্যালেন্ডারের হিসেবে এই মাসটি শেষ মাস। ফলে বাঙালী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে একটি নতুন বছরের। তাপ ও দহনকালের কথা মনে করিয়ে দিতে এবং সাহিত্যাবেগের মাস বিদায় দিতে আসে চৈত্র। সেই সঙ্গে নতুনকে বরণ করার প্রস্তুতি নেয় এই চৈত্রেই। ফলে চৈত্রের শেষ দিকে মনে প্রাণে উদ্যামতা আসে।
তবে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাস ঠিকই চৈত্রকে টেনেছেন তার কবিতায়। তার ‘কখন সোনার রোদ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, কখন সোনার রোদ নিভে গেছে-অবিরল সুপারির সারি/আঁধারে যেতেছে ডুবে-প্রান্তরের পার থেকে গরম বাতাস/ক্ষুধিত চিলের মতো চৈত্রের এ অন্ধকার ফেলিতেছে শ^াস/কোন চৈত্রে চলে গেছে সেই মেয়ে-আসিবে না করে গেছে আড়ি/ক্ষীরুই গাছের পাশে একাকী দাঁড়ায়ে আজ বলিতে কি পারি/কোথাও সে নাই এই পৃথিবীতে তাহার শরীর থেকে শ^াস/কোথাও সে নাই আর-পাব নাকো তারে কোন পৃথিবী নিঙাড়ি? চৈত্র মাসের প্রকৃতি বর্ণনায় কাঠ ফাটা রোদ, সবুজের বিদায়, বসন্তের প্রৌঢ়কাল এসব মিলিয়ে এক ধরনের একরোখা পরিবেশ চৈত্রকে আড়াল করে রেখেছে অনেকটাই। আবার হতে পারে এক সময়কার প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সামাজিক অবস্থার বিরূপতার কারণেই এ মাস নিয়ে সেভাবে আশার কিছু হয়নি। কারণ বর্ষা বা বসন্ত অথবা হেমন্ত ঋতুতে প্রকৃতি যেমন পূর্ণ থাকে এক সময় চৈত্রে তেমন ছিল না। এক সময় চৈত্রের খরায় মাঠ-ঘাট শুকিয়ে যেত, কৃষকের ফসল উৎপাদন ব্যাহত হতো। ফলে সমাজে অভাব লেগে থাকত। সমাজের এই চিত্র বাস্তবিকপক্ষে সুখকর নয়। এতসব কারণে হয়ত চৈত্র নিয়ে মাতামাতি হয়নি। মাতামাতি করার সুযোগই হয়নি। আবার একেবারেই যে হয়নি বা হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। তবে তুলনামূলক কম। আজ কিন্তু সে অবস্থা নেই। আজ বিজ্ঞানের কল্যাণে কৃষকের ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয় না। তবে প্রাকৃতিক রুক্ষতা ঠিকই থাকে। এর কিছুটা বর্ণনা মেলে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের, নকশীকাঁথার মাঠে। যেখানে তিনি লিখেছেন, চৈত্র গেল ভীষণ খরায়, বোশেখ রোদে ফাটে/এক ফোঁটা জল মেঘ চোঁয়ালে নামল না গাঁর বাটে। তুবও যে অসীম সৌন্দর্য নিয়ে চৈত্র প্রকৃতিতে হাজির হয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। গাছে গাছে ফাল্গুনে আসা আমের মুকুলে আমের গুটি আসে। কচি সজনে ডাটায় ঝুলে থাকে। বাজারজুড়ে মৌসুমি ফলের সমারোহ হতে শুরু করে। বৈশাখ মাস গ্রীষ্মের শুরু হলেও তার শুরু হয়ে যায় শেষ চৈত্রেই। কিন্তু রাতের আঁধার শেষে দিনের আলোয় প্রবেশের যে আনন্দে মন শিহরিত হয় সেভাবেই এক নতুন সময়কে বরণ করে নিতে, আনন্দে ভাসতে মনে মনে প্রস্তুতি শুরু হয় চৈত্রেই। বছর শেষে বুকের ভেতর এক বিদায়ের সুর বাজে। প্রকৃতিতে যেমন চৈত্রের পরিবর্তন দৃশ্যমান হয় সেভাবেই আমাদের সামাজিক জীবনে চৈত্রের একটা প্রভাব স্পষ্ট থাকে। গ্রামীণ জীবন ও অর্থনীতিতেও এর দৃশ্যমান প্রভাব রয়েছে। বসন্তে যে উৎসাহ উদ্দীপনা শুরু হয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই লিখেছেন, কার যেন এই মনের বেদন চৈত্র মাসের উতল হাওয়ায়/ঝুমকো লতার চিকন পাতা কাঁপে রে কার চক্ষে-চাওয়ায়/হারিয়ে-যাওয়া কার সে বাণী কার সোহাগের স্মরণখানি/আমের বোলের গন্ধে মিশে/কাননকে আজ কান্না পাওয়ায়। চৈত্র মাসের শেষে মূলত চৈত্রসংক্রান্তি ঘিরেই এক সময় গ্রাম-বাংলা মুখরিত হয়ে উঠত। গ্রামে গ্রামে মেলা বসত। সেখানে নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে রাখত বিক্রেতারা। এসব সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য হলো চৈত্রের গাজন। এর সঙ্গে হিন্দু ধর্মের চড়ক পূজার সম্পর্ক রয়েছে। মহাধুমধামে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। নাচ-গান হয়। এই অনুষ্ঠান ঘিরে যে মেলার আয়োজন করা হয় সেখানে পুতুল নাচ, সার্কাস, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এই দিনেই আদিবাসী সম্প্রদায়ের বৈসাবি অনুষ্ঠান পালন করা হয়। মোট কথা আমরা যে একদাগে চৈত্র মাসকে রসকষহীন বলে সায় দেই আসলে তা সত্য নয়। বরং এই চৈত্র মাসও সংস্কৃতিতে পূর্ণ এক মাস। পরিশেষে কবি মহাদেব সাহা‘র চৈত্রের চিঠি কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করা যাক।’ চৈত্রের এই শেষ রজনীতে/তোমাকে পাঠাই বিব্রত খাম/লিখেছি কি তাতে ঠিক মনে নেই/তবু এই চিঠি, এই উপহার! জয়তু চৈত্র।