ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : পল ক্রুগম্যান রূপান্তর : এনামুল হক

ভোটাররা কি ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকছেন

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ভোটাররা কি ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকছেন

বার্লিন ওয়ালের পতনের অল্প ক’দিন পরে আমার এক বন্ধু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ কৌতুক করে বলেছিলেন, ‘জাতীয় আদর্শ কমিউনিজম থেকে মুক্ত হওয়ায় পূর্ব ইউরোপ এখন তার প্রকৃত ঐতিহাসিক পথ ফ্যাসিবাদের দিকে ফিরে যেতে পারে।’ সেই সময়ও তার এই কৌতুকের মধ্যে সত্যিকারের ধার ছিল। আর ২০১৮ সালে তার সেই কথাটা মোটেও আর কৌতুকের মতো শোনায় না। স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে গবেষণা করে থাকে এমন একটি মার্কিন এনজিও ফ্রিডম হাউজ সেটাকে অনুদারতাবাদ বলে থাকে তা এখন পূর্ব ইউরোপজুড়ে মাথাচাড়া দিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরী যেখানে গণতন্ত্র বলতে সচরাচর যা বোঝানো হয়ে থাকে ইতোমধ্যে তার মৃত্যু ঘটেছে। বলাবাহুল্য, দুটো দেশ এখনও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য। উভয় দেশে শাসক দলগুলো যেমন পোল্যান্ডের ল’এ্যান্ড জাস্টিস এবং হাঙ্গেরীর ফিডেসজ পার্টি এমন শাসন ও সরকার কায়েম করে বসেছে তা জনপ্রিয় ধরনের নির্বাচন বজায় রেখেছে তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ধ্বংস করেছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দলন করেছে, ব্যাপক পরিসরে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে এবং ভিন্নমতকে কার্যকরভাবে অবৈধ রূপদান করেছে। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এমন অবস্থা অতি সহজে এখানে এই আমেরিকায়ও ঘটতে পারে। একটা সময় ছিল, তাও বেশি দিন আগের কথা নয়Ñ যখন লোকে বলত যে আমাদের গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, আমাদের স্বাধীনতার গর্বিত ইতিহাস এ ধরনের স্বৈরাচারের দিকে যাত্রা থেকে আমাদের রক্ষা করবে। বস্তুতপক্ষে কিছু লোক এখনও সে কথা বলে। তবে আজ এ ধরনের কথা বিশ্বাস করতে হলে ইচ্ছাকৃতভাবে চোখে ঠুলি পরতে হয়। বাস্তব অবস্থা হলো রিপাবলিকান পার্টি নিজের চিরস্থায়ী শাসন কায়েমের লক্ষ্যে বর্তমান রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে পোল্যান্ডের জাস্টিস এ্যান্ড ল’ পার্টি বা হাঙ্গেরীর ফিদেসজ পার্টির আমেরিকান সংস্করণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত, এমনকি ব্যাগ্রও। অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে কি ঘটছে স্রেফ সেটা একটু দেখে নিন। নর্থ ক্যারোলিনায় একজন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী গবর্নর পদে বিজয়ী হওয়ার পর রিপাবলিকানরা গবর্নরের বেশিরভাগ ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার ব্যবস্থা সংবলিত একটি আইন পাস করতে ক্ষমতাসীন গবর্নরের শেষ দিনগুলোকে কাজে লাগিয়েছিল। জর্জিয়ায় রিপাবলিকানরা কৃষ্ণাঙ্গ প্রধান একটি জেলার বেশিরভাগ ভোটকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার জন্য শারীরিকভাবে পঙ্গু বিকলাঙ্গ ভোটারদের যাতায়াতের সমস্যা নিয়ে স্পষ্টতই ভুয়া একটা উদ্বেগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিল। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় রিপাবলিকান আইন প্রণেতারা বাক্য সুপ্রীম কোর্টের সকল সদস্যকে ইমপিচ করে দলীয় অনুগতদের তাদের স্থলাভিষিক্ত করার জন্য মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় সংক্রান্ত অভিযোগকে কাজে লাগিয়েছে। এগুলো হচ্ছে স্রেফ কিছু ঘটনা যা জাতীয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশজুড়ে এ ধরনের কাহিনী শত শত না হলেও নিশ্চয়ই বেশকিছু রয়েছে। এসব কিছুর মধ্য দিয়ে যেটা প্রতিফলিত হয় তা হলো এই বাস্তবতা যেÑ আধুনিক জিওপি বা রিপাবলিকান পার্টি গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি কোন আনুগত্য বোধ করে না। নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য দলটি যা যা করে পার পেয়ে যেতে পারবে বলে মনে করে ঠিক তাই করবে। জাতীয় পর্যায়ের পরিস্থিতি কি রকম সে পর্যায়ের অবস্থাবলী সত্যিই ভীতিকর। বর্তমানে আমরা একটা ছুরির ধারাল প্রান্তের ওপর বসে আছি। ওখান থেকে ভুল দিকে পড়ে গেলে, বিশেষ করে রিপাবলিকানরা যদি নবেম্বরে কংগ্রেসের উভয় পরিষদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে তাহলে আপনাদের কল্পনার চেয়েও দ্রুতগতিতে আমরা আরেক পোল্যান্ড বা হাঙ্গেরীতে পরিণত হব। সম্প্রতি কংগ্রেসে রিপাবলিকান সদস্যদের মধ্যে বিলি করা একটি স্প্রেডশিট বা ইলেক্ট্রনিক নথি নিয়ে এক্সিওসের পরিবেশিত স্কুপ খবর কিছুটা আলোড়ন সৃষ্টি করে। ওই নথিতে ডেমোক্র্যাটরা প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তারা যেসব বিষয়ের ওপর তদন্ত চালাতে পারে বলে রিপাবলিকানরা মনে করে তার একটি তালিকা দেয়া হয়। তালিকার বৈশিষ্ট্যটা হলো এই যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কর রিটার্ন থেকে শুরু করে তালিকার অন্তর্গত প্রতিটি বিষয়ই এমন যে সেগুলো নিয়ে স্পষ্টতই তদন্ত হওয়া উচিত এবং অন্য যে কোন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় থাকলেও তদন্ত হতো। কিন্তু যারা এই দলিলটি বিলি করেছে তারা স্রেফ নিশ্চিতভাবেই ধরে নিয়েছে যে রিপাবলিকানরা এসব ইস্যুর কোনটার ব্যাপারেই কোন উচ্চবাচ্য করবে না। অর্থাৎ সাংবিধানিক দায়িত্বের ওপর দলীয় আনুগত্য জয়যুক্ত হবে। ট্রাম্পের অনেক সমালোচক কিছু দিন আগের আইনগত কিছু ঘটনা নিয়ে রীতিমতো উৎসব করে বসেন। তারা ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার দলের তৎকালীন চেয়ারম্যান পল মানাফোর্টকে বিভিন্ন অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা এবং কোহেনের বিরুদ্ধে আনীত মামলায় দোষ স্বীকারকে এমন লক্ষণ বলে ধরে নেন যে দেশের প্রধান আইন লঙ্ঘনকারী ব্যক্তিটির রেহাই পাওয়ার পথ হয়ত শেষ পর্যন্ত রুদ্ধই হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রিপাবলিকানদের প্রতিক্রিয়া দেখে আনার মধ্যে এক গভীর ভীতি অনুভূত হচ্ছে। ট্রাম্পের দুর্বৃত্তপনার অনস্বীকার্য তথ্য প্রমাণের মুখোমুখি হয়ে তার দলটি তাকে ঘিরে আগের যে কোন সময়ের চাইতে আরও দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এক বছর আগে এটা সম্ভব বল মনে হতো যে দুষ্কর্মে দলের যোগসাজশের একটা সীমা হয়ত আছে। মনে হতো একটা পর্যায় আসবে যখন অন্তত কিছু সংখ্যক প্রতিনিধি পরিষদ সদস্য বা সিনেটররা বলে উঠবেন ঢের হয়েছে, আর নয়। এখন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে এর কোন সীমা পরিসীমা নেই। ট্রাম্পকে রক্ষা করার এবং ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য যা যা করা দরকার তারা তাই করবে। এই কথাটা এমনকি সেই সব রাজনীতিকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যাদের একসময় কিছু ন্যায়নীতি ছিল বলে মনে হতো। মেইনের সিনেটর সুসান কলিন্স ছিলেন স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত বিতর্কে স্বাধীনতার কণ্ঠস্বর। সেই কলিন্স এখন এমন একজন মানুষের প্রেসিডেন্ট হওয়ায় কোন সমস্যা দেখছেন না যিনি অনভিযুক্ত এক যুগ্ম ষড়যন্ত্রকারীকে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপাতি পদে নিয়োগ দিয়েছেন। নিয়োগপ্রাপ্ত সেই বিচারপতি বিশ্বাস করেন যে প্রেসিডেন্টরা অভিযুক্ত হওয়ার দায় থেকে মুক্তি। সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম ২০১৬ সালে ট্রাম্পের নিন্দায় মুখর ছিলেন এবং এই সেদিন পর্যন্ত মনে হয় তিনি মুয়েলারের পরিচালিত তদন্তের অবসান ঘটাতে এ্যাটর্নি জেনারেলকে বরখাস্ত করার বিরুদ্ধে ছিলেন। এখন তিনি সঙ্কেত দিয়েছেন যে তাঁকে বরখাস্ত করে ট্রাম্প ঠিক করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যেসব দেশ সম্প্রতি গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে গণতন্ত্রের সূতিকাগার আমেরিকা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণের এত কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে কেন? আমাকে ‘অর্থনৈতিক উদ্বেগের’ কথা বলবেন না। পোল্যান্ডের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ও তার পরবর্তী সময়েও পোল্যান্ডে ক্রমান্বয়ে প্রবৃদ্ধি ঘটে গেছে। ২০১৬ সালে আমেরিকায় অর্থনৈতিক সঙ্কট ছিল না। গবেষণার পর গবেষণায় দেখা গেছে যে, অর্থনৈতিক দুর্যোগ নয় বরং বর্ণগত বিদ্বেষই ভোটারদের ট্রাম্পের পক্ষে ঠেলে দিয়েছে। বিষয়টা হচ্ছে এই যে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের যে তা-বে ইতোমধ্যে পাশ্চাত্যের অন্য কয়েকটি দেশে গণতন্ত্র কার্যকরভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে আমরাও সেই একই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছি এবং আমরা সেই বিন্দুর অতি, অতি কাছাকাছি পেঁৗঁছে গেছি সেখান থেকে ফিরে আসার আর উপায় নেই। লেখক : নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস
×