ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

নজরুল ইসলাম

বড়গ্রাম গণহত্যা

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ১ আগস্ট ২০১৮

বড়গ্রাম গণহত্যা

৩ জুলাই ২০১৮ তারিখে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার উপ-সম্পাদকীয়তে প্রকাশিত ‘শেষ নাহি যে’ শিরোনামে লিখিত একটি নিবন্ধের প্রতি আমার চোখ আটকে যায়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিবন্ধটি বেশ কয়েকবার পড়লাম। আমাদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশের সফল কৃষিমন্ত্রী অগ্নিকন্যা খ্যাত মতিয়া চৌধুরীর লেখা উপ-সম্পাদকীয়টি পড়ে ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার অবহেলিত এক জনপদের নাম ২নং বড়গ্রাম ইউনিয়নের কথা মনে পড়ে গেল। এ ইউনিয়নেই আমার জন্ম, শৈশব, কৈশোর ও বেড়ে ওঠা। স্বাধীনতা যুদ্ধে রয়েছে এ ইউনিয়নের অনেক বীরত্বগাথা ইতিহাস, রক্তঝরা ঘটনাপ্রবাহ। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বর্তমান তালিকা অনুযায়ী এ ইউনিয়নেরই রয়েছে ৬০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পাক হানাদার বাহিনী আর তাদের এদেশের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর হায়েনারা চালিয়েছে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ। একইসঙ্গে চালিয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যা, মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠন, রাহাজানি, অগ্নিসংযোগ এবং দেশের ভৌত-অবকাঠামোয় ধ্বংসযজ্ঞ। শুধু বড়গ্রাম ইউনিয়নেই স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হন ২৬৫জন নারী-পুরুষ। পাক-হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদররা মির্জাকান্দা, কাতলসা, বনবাড়িয়া, মানকোন, দড়িকৃষ্ণপুর, সুবর্ণখিলা ও কেজাইকান্দা গ্রামে ২৬৫জন নারী-পুরুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। একই সঙ্গে চালায় লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ এবং মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন। ১৯৭১ সালের ০২ আগস্ট/১৮ শ্রাবণ ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ সকাল ১১:০০ ঘটিকায় পাক হানাদার বাহিনী ২নং বড়গ্রাম ইউনিয়নের কাতলসার ও মির্জাকান্দা গ্রামের ২৮জন নিরীহ গ্রামবাসীকে ‘কয়াবিলে’ সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি চালায়, যা ‘বড়গ্রাম গণহত্যা’ নামে পরিচিত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সুদীর্ঘকাল ধরে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন অবহেলিত, নিগৃহীত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হবার পর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা বৃদ্ধির উদ্যোগ, মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ সম্মাননা প্রদান এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের কার্যক্রম গ্রহণের ফলেই আজ সম্ভব হয়েছে এসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার। ‘বড়গ্রাম গণহত্যা’য় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করা ও উক্ত হত্যাযজ্ঞে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার অপরাধে ইতোমধ্যে দড়িকৃষ্ণপুর গ্রামের রাজাকার (১) সমশের মৌলভী; (২) সালাম, পিতা জবেদ মুন্সি; (৩) সুরুজ ফকির, পিতা-তয়া ফকির, গ্রাম- লেংড়াবাজার, মুক্তাগাছাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করে আটক করা হয়েছে। তাদের সকলের মামলা বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন রয়েছে। শুধু একটি ইউনিয়নে এক দিনেই যেখানে ২৬৫জন নারী-পুরুষ শহীদ হন, সেখানে সারা বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে কত পরিমাণ লোক শহীদ হয়েছেন, তা সহজেই অনুমেয়। স্বাধীনতার ৪ যুগ পর আজ কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। কেউ বলছেন ৩ লাখ, কেউ বলছেন ৫ লাখ, কেউ বলছেন ৩০ লাখ। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হবার পরও মিরপুরে চলে গণহত্যা। অজপাড়াগাঁয়ের ছোট একটি ইউনিয়নে যেখানে ২৬৫জন নারী-পুরুষ শহীদ হন, সেখানে সারা বাংলাদেশের শহীদদের সংখ্যা নিরুপণ করতে কোন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হয় না। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার ২নং বড়গ্রাম ইউনিয়ন অসামান্য অবদান রেখেছিল। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে এখানকার শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ওপর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনাচারের খড়গ নেমে আসে। সুদীর্ঘকাল ধরে তাদের ওপর চলে আসা নির্যাতনে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও এ এলাকা এবং মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারগুলোর তেমন উন্নতি আজও চোখে পড়েনি। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যে অঞ্চলের মানুষগুলো বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, তাঁরা আজও অত্যন্ত অবহেলিত। কয়াবিলের ‘বড়গ্রাম গণহত্যা’ স্থলে স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনের উদ্যোগে পরবর্তীতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ করা হয়েছে, অত্যন্ত ছোট্ট পরিসরে। এদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভালভাবে তুলে ধরার জন্য, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এ স্থানটিকে আরও বৃহৎ পরিসরে বিনির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। গণহত্যার স্থলে যাবার জন্য এখনও আমাদের হেঁটে যেতে হয়। বর্ষাকালে উক্ত রাস্তাটি পায়ে চলার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। গ্রামের ভৌত-অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকতর উন্নতির লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণের অবকাশ রয়েছে। এ পরিকল্পনায় সরকার তথা এলাকার সচ্ছল ব্যক্তিবর্গ এবং দেশে-বিদেশে অবস্থিত ব্যক্তি উদ্যোক্তাগণকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার গঠনের পর থেকে পরিস্থিতি পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হলেও এ এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের জন্য উল্লেখযোগ্য কিছুই করা হয়নি। বর্তমান সরকারের আবাসন প্রকল্প, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কল্যাণমূলক কর্মকা-ে কখনই তাদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। এখানে প্রশাসন ও নির্বাচিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের প্রতি যথাযথ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন বলে মনে হয় না। যাঁদের ত্যাগে আজ আমরা আমাদের পতাকা পেয়েছি, তাঁদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা অনেক। আশা করছি সরকার তথা সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহ এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং আমাদের বীর সেনানী ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের লক্ষ্যে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। লেখক : কৃষিবিদ
×