ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

কামরুল আলম খান খসরু

অপারেশন রূপসী ॥ শীতলক্ষ্যায় পাকিসৈন্যের টহলবোট ধ্বংস

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬

অপারেশন রূপসী ॥ শীতলক্ষ্যায় পাকিসৈন্যের টহলবোট ধ্বংস

(শেষাংশ) অপারেশন শেষে আমি খান সাহেবের বাসায় এসে শুনি তিনি তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাকে নিয়ে বিল সাঁতরিয়ে বহুদূরে চলে গেছেন। এরপর আমি ক্যাম্পে ফিরে আসি। সহ-যোদ্ধারা সাগ্রহে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। তারা খুব উৎকণ্ঠিত ও চিন্তিত ছিল। তারা ভেবেছিল হয়ত বা এ অপারেশনের সময় আমার কিছু হয়ে গেছে। আমি দূর থেকে দু’হাত তুলে তাদের দিকে বিজয় ধ্বনি দেই। তারাও বিপুল উৎসাহে প্রচুর করতালির মাধ্যমে আমাকে অভিনন্দন জানায়। আমার এলএমজির আওয়াজ তাদের কাছে খুব পরিচিত। তাই এলএমজির আওয়াজ পেয়ে তারা ধরে নিয়েছিল আমি কোথাও ‘এ্যাকশন’-এ আছি। আসলে, সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আমি নিজেও কখনও ভাবতে পারিনি যে, প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারব। কারণ আমরা যে মিশনে নেমেছিলাম, তা শেষ না করে ফিরে আসা অসম্ভব। হয়ত শত্রুদের শেষ করতে হবে, নতুবা নিজেকে শেষ হয়ে যেতে হবে। ‘ডু অর ডাই’ এটাই ছিল তখন আমাদের লক্ষ্য। ক্যাম্পে ফিরে এসে আমি এ দুর্ধর্ষ অপারেশন সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করি। অপারেশনের আগের দিন আমার এক সহযোদ্ধা জহিরুল হক বেবিকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম কিছু জরুরি কাজের জন্য। ফেরার পথে যদি সম্ভব হয় তাকে মতিঝিল থেকে ভাল কিছু খাবার আনতে বলেছিলাম। কারণ ক্যাম্পে ডাল ভাত খেতে খেতে অরুচি ধরে গিয়েছিল। যুদ্ধে নেমেছি, জানি না কতদিন বাঁচব। ঢাকা থেকে ফেরার পথে ডেমরা ঘাটে এসে বেবি দেখতে পায়, লোকজন জটলা করে একটি টহল বোট দেখছে। সে একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে যে টহল বোট থেকে কয়েকজন পাক সৈন্যকে হতাহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। সে বোট থেকে তখন তারা বালতি দিয়ে রক্তমাখা পানি সেঁচে নদীতে ফেলছিল। অপারেশনের সময় আমাদের আরও একজন সহযোদ্ধা মাহাবুবুর রহমান জাহাঙ্গীর এপারের তারাবো ঘাটে অবস্থান করছিল। আমরা নিজস্ব গুপ্তচরের মাধ্যমে জানতে পারি, ডেমরা ঘাটে যে বোটটি ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছিল তা থেকে বেশ কয়টি পাকিস্তানী সৈন্যের লাশ অপসারণ করা হয়েছে। এ সময় পাকিসৈন্যরা ফেরিঘাট বন্ধ করে দেয় এবং ঘাটের কাছে জড়ো হওয়া লোকজনকে উন্মাদের মতো রাইফেলের বাট দিয়ে পেটাতে থাকে। আমি পাকিস্তানী সৈন্যদের সম্পর্কে জানি। তাদের মতো এমন হিংস্র ও প্রতিশোধপরায়ণ কোন জাতি নেই। তারা অচিরেই লেজে ঘা খাওয়া সাপের মতো ছোবল দেবে। তাই আমি রূপসী ঘাঁটি থেকে সহযোদ্ধাদের এবং আমার ২ওঈ (ঝবপড়হফ রহ ঈড়সসধহফ) মুরাদকে সকল রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র অনতিবিলম্বে শাদীপুরের ঘাঁটিতে (ঝবপড়হফ অষঃবৎহধঃব ইধংব)-এ সরিয়ে আনার নির্দেশ দেই। সে সঙ্গে রূপসী বাজার ও তার আশপাশের গ্রামের সবাইকে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে পরামর্শ দেই। সে এলাকার সবাই আমাদের কথা মতো দ্রুত তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে থাকে। তবে যারা কিছু হবে না বলে থেকে যায় তাদের করুণ পরিণতি হয়। আমার আক্রমণের পরদিন সকালে নদীপথে পাকিস্তানি সৈন্যরা রূপসী বাজার আক্রমণ করে। প্রথমে তারা মর্টার থেকে অসংখ্য শেল নিক্ষেপ করে। তারপর শুরু হয় ভারি মেশিনগান থেকে গুলিবর্ষণ। মর্টার শেলের বিস্ফোরণের আওয়াজ আর মেশিনগানের গুলির শব্দে পুরো জনপদ কম্পিত হতে থাকে। তারা যাকে যেখানে পায় হত্যা করে। ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেদিন তাদের হাত থেকে মোতালেব খান সাহেবের মিল, কারখানা ও বাড়িটিও রক্ষা পায়নি। সে সময়ে আমরা রূপসী বাজার থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে শাদীপুর গ্রামে শক্ত অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু অসংখ্য সৈন্য নিয়েও সেদিন পাকিস্তানীরা আমাদের ঘাঁটি আক্রমণ করার সাহস দেখায়নি। কারণ আমাদের আক্রমণ করতে হলে পাকিস্তানী সৈন্যদের নৌকায় করে বিল অতিক্রম করতে হবে, কিন্তু তাদের কাছে তখন কোন নৌকা ছিল না। এছাড়াও তারা জানতো শাদীপুর গ্রাম আর আমাদের ঘাঁটি আক্রমণ করলে তাদের ভয়ঙ্কর পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। যা হোক, শীতলক্ষ্যা নদীতে পাকিস্তানী সৈন্যদের তিনটি টহল বোটে হামলা আমার নয় মাস স্থায়ী সশস্ত্র যুদ্ধের সবচেয়ে রোমহর্ষক ও স্মরণীয় ঘটনা। ‘রূপসী অপারেশন’ অর্থাৎ শীতলক্ষ্যায় পাকিসৈন্যদের টহলবোট ধ্বংস আমার একক কৃতিত্বের ফসল। আমার একক বীরত্বপূর্ণ অপারেশনের এ স্মৃতি প্রায়ই আমাকে আবেগাল্পুুত করে তোলে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমার সহযোদ্ধারা প্রায়ই আমাকে বলত শীতলক্ষ্যা নদীতে একক প্রচেষ্টায় পাকিস্তানী সৈন্যদের টহল বোট ধ্বংসের যে সাহস আমি দেখিয়েছলাম তার নজির বাংলাদেশের সশস্ত্র যুদ্ধের ইতিহাসে বিরল। আসলে আমি তা করেছি দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবিচল ভালবাসার কারণে। ১৯৭১ সালের সশস্ত্র যুদ্ধে এ ধরনের যতোগুলো অপারেশন সংঘটিত হয়েছিল, সবগুলো কি আজও তদন্ত হয়েছে? শাদীপুর ক্যাম্পে যারা আমার সহযোদ্ধা ছিলেন তারা হলেন, সেকেন্ড ইন কমান্ড মরহুম ওয়াকিলুর রহমান (মুরাদ), কর্নেল আরশাদ আহমেদ খান পিএসসি (অব) ওরফে খোকন, মেজর মো. নুরুন্নবী (অব.) ওরফে মুন্না, আবদুস সালাম, মরহুম মাহবুবুর রহমান (বাচ্চু), মরহুম মো. রফিকুল হাসান (জাহাঙ্গীর), মরহুম মো. জহিররুল হক (বেবী), মরহুম এবিএম মাহাবুবুর রহমান (জাহাঙ্গীর), মো. মতিউর রহমান (মতি), খন্দকার সামসেদুল হক (খোকন), মরহুম মো. আতাউর রহমান খান নেহাল (’৭১-এ শহীদ), মরহুম কিবরিয়া (’৭১-এ শহীদ), লুৎফা হাসিন (রোজি), ডা. নাজমা শাহিন (বেবী), প্রমুখ। লেখক : গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা
×