ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

কুদরাত-ই-খুদা বাবু

শিশুশ্রম আগামী প্রজন্ম বিকাশের অন্তরায়

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ২৬ এপ্রিল ২০১৬

শিশুশ্রম আগামী প্রজন্ম বিকাশের অন্তরায়

শিশুশ্রম এদেশে একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এ সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। শিশুশ্রম প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলে ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত’ এ জাতীয় কথাগুলো বাস্তবিক অর্থে প্রলাপে পরিণত হবে। ফলে শিশুশ্রম প্রতিরোধ করা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে কলকারখানা, দোকানপাট, হোটেল-মোটেল, বিপণী বিতান, বাসাবাড়ি, যানবাহনসহ বিভিন্ন জায়গায় অহরহই দেখা যায় শিশুশ্রমের স্বরূপ। এসব জায়গায় নিয়োজিত শিশুরা সারা মাস হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করে। আর সামান্য অপরাধ করলেই তাদের ভাগ্যে জোটে মালিকের মারধর। কিন্তু এসব ‘মালিক’ মাস শেষে তাদের মজুরি বাবদ দেয় যৎসামান্য টাকা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দারিদ্র্যের কারণে আর দশটি শিশুর মতো এদের বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়া কিংবা লেখাপড়া করা সম্ভব হয় না। দারিদ্র্যই তাদের বাধ্য করেছে শিশু শ্রমিকের খাতায় নাম লেখাতে। সবচেয়ে খারাপ লাগে যখন দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের দোকানপাট আর চায়ের দোকানে শিশুরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে এবং শেষ পর্যন্ত তারা নিরক্ষর থেকে যায়। এ যেন ঠিক ‘বাতির নিচে অন্ধকার’। দেশের অসংখ্য শিশু এভাবে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জীবন-জীবিকার তাগিদে স্কুল ছেড়ে তাদের বাধ্য হয়ে বেছে নিতে হচ্ছে শিশুশ্রমের মতো কঠিন কাজ। দেশের সংবিধানসহ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে শিশুদের বিভিন্ন অধিকার সম্পর্কে বলা হলেও বাস্তবতা হচ্ছে দেশের অসংখ্য শিশু তাদের মৌলিক অধিকার থেকেই পুরোপুরি বঞ্চিত হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) ও জাতিসংঘের ইউনিসেফ কর্তৃক পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, এদেশের শতকরা ৭৫ ভাগ শিশুই আর্থিক অনটনের কারণে নাম লেখায় শিশু শ্রমিকের খাতায়। ‘চাইল্ড ওয়েলফেয়ার একটিভিটিজ ইন এশিয়া’ নামক একটি প্রকাশনাতেও দেখা যায় অর্থনৈতিক দারিদ্র্যই শিশুশ্রমের সবচেয়ে বড় কারণ। নিতান্ত আর্থিক কারণে বা পেটের দায়ে শিশুরা কাজ করতে বাধ্য হয়। তবে সব সময়ই যে শিশুরা আর্থিক অনটন বা পেটের দায়ে কাজ করতে বাধ্য হয় তা নয়। আশপাশের বাড়ির অনেক শিশুর কাজ করা ও তাদের অর্থ উপার্জন করা দেখেও অনেক শিশু কাজ করতে আসে। এক্ষেত্রে ওইসব শিশুর বাবা-মা তাদের সন্তানদের কাজ করতে পাঠাতেও খুব একটা কুণ্ঠাবোধ করেন না। কারণ, ওইসব বাবা-মায় এ ধরনের ধারণা পোষণ করেন যে, স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া শিখে টাকা পাওয়া যাবে না, বরং কাজ করলেই টাকা। তারা লেখাপড়ার প্রকৃত অর্থ, গুরুত্ব, মর্মার্থ ও সুদূরপ্রসারী সুফল সম্পর্কে ভালভাবে বোঝেন না এবং বোঝার চেষ্টাও খুব একটা করেন না। দেশের সংবিধানের ১৫ (ক) ধারায় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের জন্য মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল শিশুকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে সংবিধানের ১৭ (ক) ধারায় রাষ্ট্রের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। দেশের সংবিধান অনুযায়ী সকল শিশুর জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ভাষা, আর্থ-সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি নির্বিশেষে সকলে সমান অধিকার ও সুযোগ লাভের অধিকারী। ১৯৫৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে শিশু অধিকার সনদের খসড়া পেশ করা হয় এবং শিশু সনদ গৃহীত হয়। সনদটি গৃহীত হওয়ার পর বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত বিশ্বের অনেক দেশই এ সনদে স্বাক্ষর করে। পরবর্তী সময়ে এই শিশু অধিকার সনদটি আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়, যা মেনে চলা প্রত্যেক সদস্য রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক বলে সনদে উল্লেখ করা হয়। জাতিসংঘের শিশু সনদে ৪৫টি ধারার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং এখানে সন্নিবেশিত অধিকারগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে : ১. বেঁচে থাকার অধিকার ২. বিকাশের বা উন্নত হওয়ার অধিকার ৩. সুরক্ষার অধিকার এবং ৪. অংশগ্রহণের অধিকার। বেঁচে থাকার অধিকারের মধ্যে রয়েছে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এবং শিক্ষা। আর উন্নত হওয়ার অধিকারের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, সংস্কৃতি, মুক্ত মননের পরিবেশ সৃষ্টি ও কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির অধিকার। সনদে মৌলিক অধিকার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘উপযুক্ত সামর্থ্য অর্জনের আগে কোন শিশুকে শারীরিক ও নৈতিক বা মানসিক বিকাশের পক্ষে ক্ষতিকর কোন শ্রমে নিয়োগ করা যাবে না।’ অথচ বাস্তবে ঘটে এর উল্টো। ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত’, ‘আজকের শিশুরাই আগামীতে জাতির কর্ণধার’, ‘ভবিষ্যতে আজকের শিশুরাই দেশ-জাতির নেতৃত্ব দেবে’Ñ এমন সব কথাবার্তা বিভিন্ন সভা-সেমিনারসহ বিভিন্ন জায়গায় বলা হয়ে থাকলেও বাংলাদেশের শিশুদের সামগ্রিক চিত্র ভয়াবহ। এদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান দেয়া সম্ভব নয়। বিভিন্ন সময়ে সরকারী-বেসরকারী সংস্থার উদ্যোগে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী এদেশে প্রায় এক কোটিরও অধিক শিশু শ্রমিক কর্মরত। এরা প্রতিনিয়ত শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে এবং জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য শিশুশ্রমের মতো কঠিন শ্রমকে বেছে নিতে বাধ্য হয়। এ দেশে ৬-১০ বছরের এক কোটি ৬২ লাখ শিশুর মধ্যে স্কুলে যায় ৫০ ভাগের মতো। এদের মধ্যে আবার শতকরা ৩৫ ভাগ শিশুই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না করে দারিদ্যসহ বিভিন্ন কারণে স্কুল ছেড়ে দেয়। আবার দেশের অনেক শিশু দারিদ্র্যসহ বিভিন্ন কারণে কখনই স্কুলে যায় না। দেশে ছিন্নমূল শিশুর সংখ্যা প্রায় কয়েক লাখের মতো। এদের শতকরা ৫০ ভাগেরই নিজস্ব কোন ঠিকানা নেই। এদের সংখ্যা বেশি দেখা যায় রাজধানী ঢাকা শহর তথা দেশের অন্যান্য বড় শহরে। আবার দেশে পুষ্টিহীনতায় ভোগা শিশুর সংখ্যাও কম নয়। দারিদ্র্যসহ পিতা-মাতার অসচেতনতার কারণে অনেক শিশুই শিকার হচ্ছে অপুষ্টির। এসব অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত শিশুশ্রমে আত্মনিয়োগ করতে দেখা যায়। আর বর্তমান সময়ে শিশুদের নানাভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে, যেমন : মাদক চোরাচালান, চুরি, ছিনতাইয়ের কাজে নিয়োজিত করাসহ রাজনৈতিক মাঠে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে এক পক্ষ কর্তৃক আরেক পক্ষের ওপর অস্ত্র ছুড়তে, বোমা-গ্রেনেড-পেট্রোল মারতে, ভাংচুর ও অগ্নিসংেযোগ করতে ইত্যাদি, যা রীতিমতো দুঃখজনক। দেশে শিশুশ্রম বন্ধে বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, সরকার, জনগণ, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ সচেতন প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত অধিকারবঞ্চিত শিশুদের অধিকার বাস্তবায়নে তাদের পাশে দাঁড়ানো। অন্যদিকে শিশুহত্যা, শিশু নির্যাতন ও শিশু অপহরণের সঙ্গে জড়িতদের ‘মানবতার শত্রু’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের যে কোন মূল্যে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। প্রয়োজনে এসব জঘন্য অপরাধীর বিরুদ্ধে বিচারের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়নসহ বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলাও আবশ্যক। অন্যথায় আজকের শিশুদের পক্ষে আগামী দিনের ভবিষ্যত হয়ে ওঠা একদিকে যেমন সম্ভবপর হবে না, তেমনি অন্যদিকে প্রতিটি শিশু থাকবে অনিরাপদ আর প্রতিটি ঘর হবে অশান্তির নীড়, যা কারও কাম্য নয়। লেখক : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি [email protected]
×