ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১

এম শামসুর রহমান

স্মরণ ॥ স্মৃতিতে অম্লান আবদুল জলিল

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ৬ মার্চ ২০১৬

স্মরণ ॥ স্মৃতিতে অম্লান আবদুল জলিল

উত্তরবাংলার ঐতিহ্যবাহী নওগাঁ কেডি উচ্চবিদ্যালয় (স্থাপিত ১৮৮৪ খ্রি:) ১৯৫১ সাল। পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে এক কিশোর। নওগাঁর দক্ষিণে অনতিদূরের গ্রাম চকপ্রাণ থেকে এসেছে। বৃত্তি পাওয়া মেধাবী ছাত্র। ছেলেটি নম্র স্বভাবের। সুদর্শন। আচার-আচরণ মার্জিত। কে ডি স্কুলে আমি তার এক বছরের সিনিয়র। বাড়ি নওগাঁ শহরে। বিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থা থেকেই আমাকে সে বড় ভাইয়ের মত সম্মান করত। কালক্ষেপণ না করে তার নামটি বলি- ছেলেটির নাম মোঃ আবদুল জলিল। কে জানত আমাদের ‘জলিল’, জুনিয়রদের ‘জলিল’ ভাই একদিন বাংলাদেশ সরকারের মর্যাদাপূর্ণ বাণিজ্যমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করবে। আজ ৬ মার্চ। অনুজপ্রতিম আবদুল জলিলের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর রাজনীতিক জীবনের গভীরে প্রবেশ না করে এখানে তাঁকে নিয়ে স্মৃতিপটে আঁকা দু’চার কথা বলার আমার এ প্রয়াস। স্কুলের গ-ি পেরিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্ষেত্র আমাদের অভিন্ন রইল না। জলিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হলো। ফজলুল হক হল তার আবাসস্থল। ঢাকায় এলে জলিলের সঙ্গে দেখা করতাম। ঢাকার কাজকর্মে সে আমাদের অকুণ্ঠ সাহায্য-সহযোগিতা করত। ১৯৬৫ সাল। আবদুল জলিল লন্ডনে চলে গেল ব্যারিস্টারি পড়তে। পরের বছর কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে আমিও পাড়ি দিলাম ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। ১৯৬৬-এর ১৪ সেপ্টেম্বর, আজও মনে পড়ে, লন্ডন হিথরো বিমানবন্দরে তার সঙ্গে আমার সাক্ষাত। পরের দিন কিছু কেনাকাটায় জলিল লন্ডনের দোকানপাটে আমাকে নিয়ে যায়। দুদিন বাদেই আমি চলে গেলাম আমার গবেষণা কর্মস্থল লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে। জলিল যথারীতি লন্ডনে থেকে গেল। মাঝেমধ্যে তার লন্ডনের বাসায় এসেছি। ১৯৬৮-এর ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে ’৬৯-এর ১ জানুয়ারি ভোর অবধি নতুন খ্রিস্টীয় বছরকে স্বাগত জানিয়ে আমরা হই-হুল্লোড় করেছি। সঙ্গে ছিল আমারই স্কুল সহপাঠি ও বাল্যবন্ধু (বর্তমানে নওগাঁয় বসবাসররত) মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। পাকিস্তানের তৎকালীন একমাত্র স্নাতকোত্তর ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপনার পাট চুকিয়ে ’৭০-এর ডিসেম্বরের শেষভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণিত বিভাগে যোগ দেই। ’৭১-এর দীর্ঘ নয় মাস উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ঢাকাতেই কাটালাম। সে সময়ের কিছু ঘটনাপ্রবাহ পত্রপত্রিকায় তুলে ধরতাম। আবদুল জলিল তখন ওপার বাংলায় মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার। আমার অনুজ মোঃ শাহিদুর রহমান (বর্তমানে নওগাঁ তুলাপট্টি জনতা ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র অফিসার) তার অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়েই ঢাকায় আবদুল জলিলের ফিরে আসা এবং বৃহত্তর রাজনীতিতে প্রবেশ। তিনি হলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক। সংসদ সদস্য। সাধারণ সম্পাদক। প্রেসিডিয়াম সদস্য। বাণিজ্যমন্ত্রী। কালক্রমে হলেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। এই সঙ্গে যুক্ত করতেই নয়, বক্তৃতা-বিবৃতিতেও আবদুল জলিল ছিলেন পারঙ্গম। ঢাকায় গ্রীণ রোড, ধানম-ি, গুলশানের তার বাসায় যেতাম। মতিঝিলে চেয়ারম্যানের চেম্বারে, মৃত্যুর কয়েকদিন আগেও, আমরা কিছু সময় কাটাই। নওগাঁর নানা উন্নয়নকর্মে আবদুল জলিলের অবদান অপরিমেয়। ব্যাংকের ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতেও তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। সমস্যাপীড়িত মানুষের প্রতি নিরন্তর তিনি তার অকৃপণ সাহায্যহস্ত বাড়িয়ে দিতেন। বার্ধক্যজনিত রোগ ক্রমেই এ নেতাকে ক্ষয়িষ্ণু করে তোলে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল থেকে পৃথিবীর ধুলিধূসরিত রৌদ্রকরোজ্জ্বল সংসারের মায়া ত্যাগ করে আবদুল জলিল চলে গেলেন অনন্তের কল্যাণলোকে। তার মরদেহ ঢাকায় পৌঁছলে সর্বস্তরের মানুষ এই প্রবীণ নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নওগাঁ এ টিম মাঠ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। সেখানে জানাজা শেষে তার গ্রামের বাড়ি চকপ্রাণে পিতামাতার কবরের পাশে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আবদুল জলিল দীর্ঘজীবন লাভ করেন। জীবনযুদ্ধে জয়ী হন। জয় হয়েছেন দেশের জন্য উজ্জীবিত কর্মের সাধনায়। দেশপ্রেমের মহানব্রতে উৎসর্গীকৃত আবদুল জলিলের বর্ণাঢ্য ও কৃতিত্বপূর্ণ কর্মজীবন বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রইবে। বেদনাবিধুর এই দিনে শোকার্ত পরিবারের প্রতি রইল গভীর সমবেদনা। রাজনীতি অঙ্গনের এই বরেণ্য ব্যক্তিত্বকে, এই বড়মাপের মানুষটিকে আমরা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করছি। নিবেদন করছি তার প্রতি অশেষ ভালবাসা, প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। আমাদের কাছে সর্বজন প্রিয় আবদুল জলিলের আজও স্মৃতি অম্লান। লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, গণিত বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
×