জলের ভেতর দেখা যায়
নাসরীন নঈম
কার যেন মুখ দেখা যায় জলের ভেতর খুবই স্বচ্ছ জল
মহেনজোদারোর মাটির মোহময় কলস ভেঙে একদিন
লোকটা গড়েছিলো বিশাল এক বাগান-
অনেকগুলি ঝরা পাতার ওপর লিখেছিলো কিসব
হাবিজাবিÑ কৈশোর, যৌবন, আর কী একটা নাম
বোধ হয় প্রেম।
তারপর আকাশে সাদা ঘুড়িকে তাক করে ছুঁড়ে ছিল
কষ্টের আকুতি সব, লোকটা বড় দুঃখী।
ধপাস ধপাস করে নেমে এসেছিল তার নিয়তি
চড়ুই ভাতির শেষে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট, মাটির টোপাটাপি কলিজার টুকরা
কাকে দেখাবে লোকটাÑ ভেবে পায় না আর।
সামাজিক গেরস্থালি ওকে কোন দিন ছুঁতে পারলো না।
সে জীবনের বারো রকমের মানুষকে ভাগ দিতে চেয়েছিল ভালোবাসা।
তবু কেমন হতাশা জিওল মাছের মতো ঘাই দিয়ে যায় বুকে।
তুমি কষ্ট পেওনা মানুষ তোমার হারানো ইচ্ছেগুলো পাখির পালকের ওপর দুলছে
সদ্যজাত শিশুর চোখের আলোতে তুমি আয়না হয়ে গেছো সহজেই
সবাই তোমাকে দেখার জন্যে অগ্রিম টিকিট কাটছে সারিবদ্ধ হয়ে
তুমি জল কিংবা আরশি, প্রতিবিম্বিত চেহারার আদল।
** লাল জামা
রহমান মুজিব
লাল জামা- লাল হতে হতে রক্ত হয়
থাকে পরাবাস্তবতা- তামার বিবর্ণ সূচী
অস্তের অস্বচ্ছ পথ, এ পথে শুনি শিলা-
ঝড়ের নিক্কণ, উপরে নীলগিরির জল
জল না হলে অশ্রু হবে- আর অশ্রু হলে
জেনে যাই- কতটা পোড়ালে বিপদগামী
হয়ে তামা আগুনের ছদ্মবেশ ধারণ করে
এবং আলতাকে করে রক্তের মুখোমুখি
কৈশোরের সেই লাল জামা বৈরী মৈথুনে
আমাকেও তাজা রক্তপি-ে অনুবাদ করে
বেগানা মাছিরা ঝাঁক বেঁধে পাঠ করে আমায়
** বোশেখে জন্ম তার
শেলী সেনগুপ্তা
নূপুরপায়ে মেয়েটি
হাসতে হাসতে ছুটে এসেছিল
এসেছিলো বিদায় নিতে,
মেয়েটির হাত ছিল এক যুবকের হাতে
উসকোখুসকো চুল
বড়ো বেশি অস্থির,
পরস্পরের ভালোবাসা ব্যক্ত করতে
মুহূর্তেই সব তছনছ!
ওরা চলমানতা, পৃথিবীর বুক থেকে বাকলের মতো
ছিঁড়ে ফেলে জীর্ণতা!
নির্জন বদ্বীপ স্তনে আনে দুগ্ধধারা,
ওরা হাত ধরে চলে
নিজস্ব ক্যানভাসে আঁকা প্রতিবিম্ব হয়ে
নির্জনতায় জেগে ওাা কোলাহল যেন,
মেয়েটি বসন্ত,
যুবকের নাম গ্রীষ্ম।
** শরীর আমাদের কথা কয়ে ওঠে
আনিসুর রহমান
আহত সৌনিক, ক্ষত সারাবার আকুলতা কত—
পরাজিত সৈনিকের গ্লানি, ব্যথার দিনলিপি যত;
সময়ে আলো বিছিয়ে স্মৃতি চাপা পাতায় পাতায়;
আকাশে তারার মেলা খবর করে কার ঠিকানায়?
হৃদয়ের কল্পনা বিলাস কারও হাতের পুতুল;
পুতুলের প্রাণ কার হাতে পুতুল তার কি জানে?
হাতে হাতে প্রাণ, ভেতরে তার ঝড় ছটফট কেনে?
বিরহ মিলনের বিধানে কাটাকাটি নবগানে।
ছিলাম আগুন জল হতে গিয়ে বাঁধিলো গোলমাল;
শেষ পাতে সে যে কামের ঈশ্বরী ধর্ম ধারাপাতে;
হৃদয়ে কপাট খুলে পাবে মায়াজাল কী তফাতে?
না কোনো ফের, পেয়েছি সব, শরীর ও মনে জানে।
সব ব্যথা দূর হয় শরীর কী কথা কয়ে ওঠে;
কামনীড়ে পরস্পরে কি গায় হৃদয়ের কনসার্টে?
জগৎ জীবন জন্ম পরজন্ম ঈশ্বরী কামদেবী;
হৃদয়-মনে শরীর ও কল্পনায় তোমার ছবি।
শুনো, বাঁচি মরি, তোমাতেই ঠেকাই আমার মাথা;
বলেছি কত তবু রয়ে গেছে ঢের অবলা কথা!
** মেঘ
কাদের পলাশ
কোন কিছু না হতে চাওয়াই
আমার একমাত্র ইচ্ছে।
অনেকেই প্রেমিকার টিপ হতে চায়
নথ, বালা কেউবা ওড়না
আমার ওসব ইচ্ছে হয়নি কখনো।
বন্ধুরা আমায় বোকা বলে
প্রেম অনুভূতিহীন রোবট।
ছেলে বেলার প্রিয় পাখি গান গায় ভিনদেশী ডালে
পাশের বাড়ির কাঞ্চনবালা ভালো নেই
দুষ্ট পতি মাতাল থাকে বারোমাস
তাই চোখজোড়া ভরা নদী।
জীবনে প্রথম তীব্র আবদারে গলে গেছি
এখন শুধু একখ- মেঘ হতে ইচ্ছে করে
ইচ্ছে হয়,
আচমকা কাঞ্চনবালার সিঁধুর মুছে দিই।
** পোকায় খেয়েছে স্বপ্নপাতা
আবেদীন জনী
পোড়া দীর্ঘশ্বাস মেখে
বাতাসের ক্যানভাসে ধোঁয়াশার ছবি এঁকে
পাঠিয়ে দিলাম অরাত্রিকা
এ বাতাস কখনও তোমাকে স্পর্শ দিয়ে গেলে
জেনে নিয়ো কেমন যাচ্ছে আমার দিন
সবজির খেতগুলো পুড়ে ছাই দুপুরের রোদে
হিজলগাছের ডালে শালিকজুটির শৈল্পিক বাসাটা
সেদিন ঝড়ো বাতাসে হয়ে গেছে তছনছ
আর পোকায় খেয়েছে আমাদের স¦প্নপাতা।
** সময়ের রথে
সুমন বনিক
কেউ একজন এসে আমাকে টাইম মেশিনে বসিয়ে যাও
ছুটে যাবো আজন্ম শৈশবে- ঘুড়ির মতো নয়, পাখি হয়ে
উড়ে-উড়ে। লাঙল-জোয়াল কাঁধে গাঁয়ের ঐ কাদামাটিজলে-
শস্যদানার হাসি দেখব। কামিনীফুলের ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে
শিশির ধোয়া দূর্বাঘাসে গা ভেজাব।
কেউ একজন এসে আমাকে টাইম মেশিনে বসিয়ে যাও
গিলগামেশের রাজ্যে মহাকাব্যের পাতায় পাতায় খুঁজব
স্বর্গাভিযানের কাহিনী। নালন্দার পালি টোলে শিখব
জীবনের ধারাপাত।সক্রেটিসের হাত ধরে বাতি নিয়ে
হাঁটব আঁধারের আলপথে। রবিঠাকুরের শোবার ঘরে
ফুলদানিতে ফুল সেজে নেব রবি-রশ্মি।
কেউ একজন এসে আমাকে টাইম মেশিনে বসিয়ে যাও
মহাভারতের ব্রাত্যজনদের সঙ্গে গলাগলি করব,
চে’র সান্নিধ্যে গহিন অরণ্যে আয়েসে চুরুট ফুঁকে-ফুঁকে
বুকের পাঁজরে সেঁটে নেব বিপ্লবের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ
চুমু খাবো মাক্সের সমাধি বেদিতে।
কেউ একজন এসে আমাকে টাইম মশিনে বসিয়ে যাও
ক্লিওপেট্রার বুকের ঠিক-ভাঁজে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকব,
আফ্রোদিতির যৌবনের মৌবনে আমৃত্যু থাকব ক্রীতদাস!
দ্রৌপদীর দেহজুড়ে জড়িয়ে দেবো শ্রদ্ধা ও ভালবাসার
কাচস্বচ্ছ মিহি ঢাকাই মসলিন।