ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

বিজয়ের গৌরবগাথা ॥ স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক

প্রকাশিত: ০১:৪৯, ১ ডিসেম্বর ২০২১

বিজয়ের গৌরবগাথা ॥ স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক

দুইশ’ বছরের বৃটিশ শাসনাবসানে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে বাঙালীর মুক্তি আসেনি। শোষকের হাতবদল হয়েছে মাত্র। আগে ছিল ইংরেজ এবং পরে পাকিস্তানী। পাকিস্তানের শুরুতেই বৈষম্য নীতিতে শোষণের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। বাঙালী রাজনীতিকরা গোড়াতেই মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করেন। শুরু হয় মুক্তির সংগ্রাম। নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান। খাঁটি দেশপ্রেম, কঠোর পরিশ্রম, পাকিস্তানীদের নিপীড়ন এবং অসাধারণ নেতৃত্বগুণে সময়ের পরিক্রমায় তাঁর হাতেই আসে মূল নেতৃত্ব। বঙালীর মুক্তিসনদ ছয় দফার হাত ধরে বাঙালীর মুক্তি সংগ্রাম চূড়ান্ত রূপলাভ করে। সকলের প্রিয় শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। ’৬৯ সালে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটে আইয়ুব শাহীর। নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় বসেন ইয়াহিয়া খান। ’৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পরও বাঙালীদের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে গড়িমসি শুরু করে ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র। গর্জে ওঠে বাঙালী। গর্জে ওঠেন বাঙালী জাতির ত্রাণকর্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ তার কণ্ঠে অনুরণিত হয় বাঙালীর মুক্তির আহ্বান। বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তির এই দিনে আজও বাতাসে ভেসে বেড়ায় সেই বলিষ্ঠ কণ্ঠ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুত্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাঙালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৭ মার্চ একটি অনন্য দিন। সুদীর্ঘকালের আপোসহীন আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। রেসকোর্স ময়দানে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ছিল চরম উৎকণ্ঠায়। বাঙালী জাতি ছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষায়। লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে এই মহান নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ ২৪ বছর পাকিস্তানী শাসনের দুঃসহ চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘কী পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।’ তিনি তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা এবং পরবর্তী নির্দেশনায় বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেয়ার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাছারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না পায়, সেজন্য রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে; শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রীমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দফতরগুলো, ওয়াপদা-কোন কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোক কাউকে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, প্রত্যেক ইউনিয়নে, প্রত্যেক সাবডিভিশনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো। মনে রাখবা- রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব; এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি আসন, বাকি দুটি আসন পেয়েছিল পিডিপি। নির্বাচনের পর তৎকালীন সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়হিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের পিপিপি নেতা জেড এ ভুট্টো এবং পাকিস্তান সামরিক চক্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এরই প্রেক্ষিতে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিয়েছিলেন। ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে পাকিস্তানী সেনাদের কামান-বন্দুক-মেশিনগানের হুমকির মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ওই দিন বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেনÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ যা বাঙালীর অধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলনের মূলমন্ত্রে পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালের পর সুদীর্ঘ ২৩ বছরের শোষণের চূড়ান্ত পর্যায়ে বাঙালী জাতির জাতিসত্তা, জাতীয়তাবোধ এবং জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে ভিত রচিত হয় তারই পরবর্তী দিকনির্দেশনা ছিল জাতির জনকের ভাষণে। পূর্বাপর এ ঘটনার প্রেক্ষিতে ভাষণটি যদি মিলিয়ে দেখি তাহলে দেখা যায় কী নিখুঁতভাবে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ সাজিয়েছিলেন। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে ১০টি অধ্যায় চিহ্নিত করা যায়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১- ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনা ও বাঙালীর অধিকার অস্বীকারের ইতিহাস। ১৯৭০-এর নির্বাচনের গণরায় বানচালে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার পাকিস্তানী ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানের নয়া চক্রান্ত ১০ মার্চের গোলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। বঙ্গবন্ধুর পাল্টা প্রস্তাবÑ সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফেরত যাওয়া, হত্যার তদন্ত, জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। সর্বাত্মক অসহযোগ-হরতালের ঘোষণা। প্রয়োজনে সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক। পূর্ব বাংলা পরিচালনার রাজনৈতিক কর্তৃত্বভার গ্রহণ। পূর্ব থেকে পশ্চিমে অর্থ চালান বন্ধ ও পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ বিছিন্ন করা। সশস্ত্র প্রতিরোধের আহ্বান ও জাতীয় মুক্তি, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার নির্দেশ। মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা। এই ভাষণের ফলাফলে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, কী অপূর্বভাবে তিনি স্বশাসন এবং স্বাধীনতা, গণআন্দোলন, নির্বাচন ও সশস্ত্র সংগ্রামের সমন্বয় সাধন করেছেন। একটি ভাষণ একটি জাতিকে স্বাধীনতা পেতে কিভাবে দাঁড় করিয়ে দিল পৃথিবীর ইতিহাসে তা অবিস্মরণীয়। টাইম ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ওই ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের কৌশলও ছিল।’ বিবিসির সংবাদভাষ্যে বলা হয়, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে জন আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ ভাষণের সঙ্গে তুলনীয় এই ভাষণটি, যেখানে তিনি একাধারে বিপ্লবী ও রাষ্ট্রনায়ক।’ থমসন রয়টার্সের মতে ‘বিশ্বের ইতিহাসে এরকম আর একটি পরিকল্পিত এবং বিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সঙ্গে বিপ্লবের রূপরেখা দেয়া হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশ পরিচালনার দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।’ এএফপি বলেছে, ‘৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালীদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। আসলে ওই দিনই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।’ দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের এক ভাষ্যে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমনের ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়েছে ওই ভাষণেরই আলোকে।’ লেখক : গবেষক
×