ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপদ কর্মপরিবেশ

প্রকাশিত: ২১:১৯, ১৪ জুন ২০২১

নিরাপদ কর্মপরিবেশ

প্রায় প্রতিবছরই বাংলাদেশে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, মৌসুমী ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা ঘটছে। বস্তুত ভৌগোলিক গঠন ও বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশে এ পর্যন্ত বিপুল প্রাণের ক্ষয়, ফসলের ক্ষতি, সম্পদহানি হয়েছে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সাইক্লোন ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায় কয়েক লাখ লোকের মৃত্যু হয়। ১৯৮৮ সালের বন্যায় প্রায় এক কোটি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০০৭ সালে দেশে বন্যায় ও নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় সোয়া কোটি মানুষ। খেতের ফসল, বাড়িঘর, গবাদি পশু, গাছপালা সবই ধ্বংস হয়ে যায়। ভেঙে পড়ে দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি। ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম কক্সবাজার সমুদ্র-উপকূলে প্রাণ হারায় প্রায় দেড় লাখ মানুষ। আসলে বাংলাদেশ হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প ও খরাপ্রবণ দেশ। ২০১৭ সালের বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকিসূচক অনুযায়ী, জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান সারা বিশ্বে ষষ্ঠ। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩২০ কোটি ডলার বা ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ২ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০১৮ সালে বিশ্ব ঝুঁকি প্রতিবেদনে ১৭২টি দেশের ভূমিকম্প, সুনামি, হারিকেন এবং বন্যার ঝুঁকি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এসব দুর্যোগ মোকাবিলা করার মতো সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সক্ষমতা আছে কিনা তা যাচাই করা হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঝুঁকির মধ্যে থাকা শীর্ষ ১৫টি দেশের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ নবম স্থানে রয়েছে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবচেয়ে কম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে কাতার। ঝুঁকির এই সূচকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কার পাশাপাশি দুর্যোগ মোকাবিলায় সেই দেশ কতটুকু প্রস্তুত সেটাও বিবেচনায় নেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে হিসাব করা সেই দেশগুলোয় নির্মিত ভবনগুলোর পরিস্থিতি বা বিল্ডিং কোড, দারিদ্র্যসীমার মাত্রা এবং দুর্যোগ-পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পরিকল্পনা। এ কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ হওয়া সত্ত্বেও অনেক দেশের নাম ঝুঁকির তালিকায় নেই। যেমন প্রতিনিয়ত ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা জাপান ও চিলি। এই দুই দেশের নাম শীর্ষ ২০ ঝুঁকিপূর্ণ দেশের বাইরে রয়েছে। এ ছাড়া হল্যান্ড, যারা কিনা শত শত বছর ধরে সমুদ্রের স্তর বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, অথচ ঝুঁকির তালিকায় তাদের অবস্থান ৬৫টিতে। আর ২০২০ সালের অন্য এক তথ্যে বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি দুর্যোগের শিকার হওয়া ১০ দেশের ৮টিই এশিয়ার এবং বিগত ২০ বছরে দুর্যোগে প্রাণহানির সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। এছাড়া, ক্ষতি ২ লাখ ৯৭ হাজার কোটি ডলার। চলতি শতকের ২০ বছরে বিশ্বের যে ১০টি দেশ সবচেয়ে বেশি দুর্যোগ-আক্রান্ত হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ নবম। এ সময়ে বাংলাদেশের ১১ কোটি ২০ লাখ মানুষ কোন না কোনভাবে দুর্যোগের শিকার হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্যোগের ঘটনা ঘটেছে ২০০২ সালে। ওই বছর ৬৫ কোটি ৮০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়। ২০১৫ সালে ৪৩ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। গড়ে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ২০ কোটি মানুষ দুর্যোগের কবলে পড়ে। মারা যায় ৬০ হাজার মানুষ। তবে দুর্যোগ মোকাবিলায় বিগত কযেক দশকে বাংলাদেশ বেশ সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ‘গোর্কি’ নামের ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারান ভেসে যায় লাখ লাখ গবাদি পশু ও আবাদি ফসল। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়টি প্রায় ১.৩৮ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। এছাড়া এক কোটি মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১০ লাখ ঘর-বাড়ি। ২০০৭ সালের ১৫ নবেম্বর ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’-এ সাড়ে তিন হাজার মানুষ মারা যায় ঝড়ের প্রভাবে। প্রায় ৯ লাখ ৬৮ হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস এবং ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে আঘাত হানে। আইলায় কমপক্ষে তিন লক্ষ পরিবার ঘর-বাড়ি হারান প্রায় দু’শ’ মানুষ মারা যায়। এই ঝড়ে দক্ষিণাঞ্চলে লবণ পানি প্রবেশ করায় পানীয় জলের তীব্র সঙ্কট তৈরি হয়, যে সঙ্কট এখনো কাটেনি। এছাড়া, ২০১৩ সালের ১৪ মে ঘূর্ণিঝড় মোহসেন আঘাতে কমপক্ষে ৫০ জন, ২০১৬ সালের ২১ মের ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ আঘাতে ২৪ জন, ২০১৭ সালের ৩০ মের ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে ৬ জন, ২০১৯ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে ৯ জন, ২০১৯ সালের ৯ নবেম্বর বুলবুলের আঘাতে ২৪ জন প্রাণ হারায় এবং অতিসাম্প্রতিক ২৫ মে আঘাত হানা ইয়াসের আঘাতে প্রাণহানি খুবই নগণ্য। তবে সবগুলো ঝড়েই ফসল এবং কাঁচা বাড়ি ঘরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশেষকরে ১৯৯১ সালের প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পরেই উপকূলীয় এলাকায় সবুজবেষ্টনী প্রকল্প হাতে নেয়া হয় এবং এ প্রকল্প পরবর্তীতে ব্যাপক বনায়ন এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচীর মাধ্যমে উপকূলবর্তী এলাকায় ভাঙন প্রতিরোধ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। উপকূলবর্তী এলাকায় প্রচুর সাইক্লোন সেল্টারের পাশাপাশি ব্যাপক বনায়ন, বিশেষত ম্যানগ্রোভ জাতীয় বৃক্ষাদি রোপণ করার মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিগত তিন চার দশক আগে এ ধরনের দুর্যোগে যেখানে লাখ লাখ লোক মারা যেত, সেখানে দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতার কারণে এখন প্রাণহানির সংখ্যা খুবই হাতেগোনা কয়েকজন। দুর্যোগ মোকাবেলায় মানুষের সচেতনতা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে দুর্যোগ মোকাবেলার অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও দুর্যোগ প্রস্তুতির তথ্যও দ্রুত সবার কাছে পৌঁছে যাচ্ছে যা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সাফল্য। এজন্য ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যা মোকাবেলায় অনেক সক্ষমতা অর্জন করায় বিশ্বে বাংলাদেশের এই সক্ষমতা বেশ প্রশংসিত ও রোল মডেল হিসাবে কাজ করছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ৭০ কোটি মানুষ দুর্যোগের ঝুঁকিতে এবং উপকূলীয় বদ্বীপ অঞ্চল হওয়ায় একক দেশ হিসেবে আমাদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এমন বাস্তবতায় গ্লোবাল সেন্টার অন এ্যাডাপ্টেশন (জিসিএ) বা বৈশ্বিক অভিযোজন কেন্দ্রের আঞ্চলিক কার্যালয় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে উদ্বোধন করা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে একটি দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই আরেকটি দুর্যোগ হানা দেয়। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, ভূমিধস ও হিমবাহ ধসের মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা দুর্যোগের শিকার দক্ষিণ এশিয়া। বৈশ্বিক তাপমাত্রা আর মাত্র ১ দশমিক ৫ পয়েন্ট বাড়লে আমাদের এ অঞ্চলের বিপদ বেড়ে যাবে বহুগুণ। ফলে দুর্যোগ মোকাবেলায় আঞ্চলিক সক্ষমতা বাড়ানোসহ বিশ্বের দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা ও এ সংক্রান্ত সচেতনতা তৈরিতে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই জলবায়ু মোকাবেলায় আরও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে এবং উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে তাদের কার্বন নিঃসরণের দায়ে আমাদের ক্ষতিপূরণ তথা জলবায়ু তহবিলের প্রতিশ্রুত অনুদানের অর্থ আদায়ে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সব দেশ একসঙ্গে মিলে নিজেদের সৃষ্ট বিপর্যয় থেকে মানুষকে রক্ষা করার পথে এগিয়ে না এলে মানবজাতিকে বড় ধরনের খেসারত দিতে হতে পারে। তবে গবেষকরা বলছেন, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার অন্যতম শক্তি সুন্দরবন ও উপকূলীয় অঞ্চলের সবুজ বেষ্টনীর গাছ ও বনাঞ্চল। সিডর, আইলা, বুলবুল ও সাম্প্রতিক ইয়াসের সময় সুন্দরবন মানববর্মনের ন্যায় রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছে অথচ মানব সৃষ্ট কিছু কারণে সুন্দরবন ও এরকম প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। আর সুন্দরবনের পাশে নির্মিতব্য রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পাওয়া সুন্দরবন। এভাবে চলতে থাকলে একমাত্র প্রাকৃতিক বর্মন সুন্দরবন হারিয়ে যেতে বেশিদিন সময় লাগবে না। এজন্য সকলকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি সুন্দরবন রক্ষায় সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। দুর্যোগ মোকাবেলা সাফল্য ধরে রাখতে হলে এসব বিষয়ে সক্ষমতা ধরে রাখার পাশাপাশি আমাদের আরও সচেতন, সতর্ক ও মনযোগী হতে হবে। প্রকৃতি তার নিজের খেয়ালে চলে। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ করার শক্তি যেমন মানুষের হাতে নেই, তেমনি জানা নেই আত্মরক্ষার কৌশলও। তবে দুর্যোগ মোকাবেলা করার প্রস্তুতি ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অনেক ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এ জন্য গণসচেতনতা যেমন দরকার, তেমনি দরকার ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার মতো অবকাঠামো নির্মাণ, উঁচু বাঁধ তৈরি। রাষ্ট্রীয় সুপরিকল্পনার মাধ্যমে জনস্বার্থে প্রয়োজনীয় আশ্রয়কেন্দ্র, আরও বেশি সবুজ বেষ্টনী তৈরি করা যেতে পারে এবং দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতাকে আরও টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। লেখক : ব্যাংকার [email protected]
×