সমুদ্র হক ॥ দেশে এক বছরের বেশি সময় হলো কোভিড-১৯ দেখা দিয়েছে। প্রথম ঢেউ তীরে ধাক্কা খেয়ে দ্বিতীয় ঢেউ চলমান। বিজ্ঞানীগণ বলছেন, তৃতীয় ঢেউ সমাগত প্রায়। মানবজীবনে মানসিক অবস্থাও ঢেউয়ের মতোই ওঠানামা করছে। বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে স্থির হতে পারছে না। গবেষক, বিজ্ঞানী কেউ এখনও কোভিড তাড়াতে পারেননি। ভ্যাকসিনেও (টিকা) সম্পূর্ণ স্বস্তি মিলছে না। তবে বলা হচ্ছে, টিকা শরীরে ইমিউনিটি বাড়াতে কার্যকর- কোন দেশের টিকা ৯২, কোন দেশের ৭৯ শতাংশ।
মানুষ এখনও বুঝতে পারছে না, জানতেও পারছে না মুখের এই ঢাকনা কতদিন রাখতে হবে। ঢাকনা (মাস্ক) ছাড়া কবে মুক্তাঙ্গন পাবে। কবে করোনার আগের সেই দিনগুলো ফিরে পাবে। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পৃথিবী। কোন মানুষ বলতে পারবে না তার মনের অসুখ হয়নি। ব্যাধি-ব্যামোর চিকিৎসা আছে। মনের অসুখের চিকিৎসা কী। মনের অসুখ নানা ধরনের। হরমোনের জাতের মতো। কোন্ হরমোন কোন্দিক থেকে ঠেসে ধরবে কেউ জানে না। মানুষকে দেখলে মনে হবে স্বাভাবিক। ভেতরে মোটেও তা নয়। শরীরে ইমিউনিটি আছে কি নেই তা বোঝা যায় না। তবে ভাবনা যে ইনফিনিটি তা ঠিক ধরা দেয়।
বিশ্ব মনের চিকিৎসা নিজেই নিজেকে দিতে পারে এমন একটি পন্থা আবিষ্কৃত হয়েছে। তার নাম বিবলিওথেরাপি। বলা হচ্ছে, মানুষ মনকে তার মনের ভেতরের হাসপাতালে ভর্তি করে নিজেই চিকিৎসা দিতে পারে। শুধু দরকার চিকিৎসা পদ্ধতি জানা। এ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি, আয়ুর্বেদী ওষুধ- পথ্যের দরকার নেই। বিবলিওথেরাপির মূলমন্ত্র হলো : মনের রোগ বুঝে বই পড়া। বিবলিও অর্থ বই। থেরাপি অর্থ এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি। প্রাচীন গ্রীকরা মনে করত, আত্মার ওষুধ বইপুস্তক। উন্নত দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টির বহুবিধ চর্চা হচ্ছে। প্রয়োগ হচ্ছে থেরাপি। চার বছর আগে একজন লাইব্রেরিয়ান দেশে প্রথম বিবলিওথেরাপি শুরু করেন। তার নাম মোঃ রোকনুজ্জামান (৪২)। বাড়ি নাটোর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর লাভ করেন। ২০১০ সালে বগুড়া উডবার্ন সরকারী গণগ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান পদে যোগ দেন। বর্তমানে জয়পুরহাট সরকারী লাইব্রেরিতে সিনিয়র লাইব্রেরিয়ান। অবসরে বিবলিওথেরাপি দিচ্ছেন। এ জন্য কোন বিনিময় নেই। সামাজিক অবক্ষয়গুলো দূর করে দিতে এই পথে পা বাড়িয়েছেন। কোভিডকালে মানুষ নানা হতাশা-দুশ্চিন্তায় নিমজ্জিত। শিক্ষার্থীরা বিপর্যস্ত। অভিভাবকগণও চিন্তিত। কবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে, কবে লেখাপাড়া শুরু হবে। অনেক কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী ভিডিও গেমে আসক্তি হচ্ছে। এক ক্রশিয়াল ও ক্রিটিক্যাল সময় অতিবাহিত হচ্ছে।
রোকনুজ্জামান বলেন, বিবলিওথেরাপির মূল কথা হলো: ‘টু এ্যাপ্লাই রাইট বুক টু দ্য রাইট পেসেন্ট’। ব্যক্তির মনের রোগ বুঝে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু বই পড়তে দেয়া। অধ্যয়নের সময় তিনি বিবলিওথেরাপি শব্দের সঙ্গে পরিচিত। অতি আগ্রহী হয়ে একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি বিবলিওথেরাপি সম্পর্কে জ্ঞান চর্চা করেন। লক্ষ্য করেন, দেশের মানুষের বড় একটি অংশ নানা কারণে মানসিক কঠিন চাপ,ধকল, একাকিত্ব, স্বস্তি, অশান্তি, হতাশা, অসুখী থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজছেন। করোনাকালে এই সমস্যাগুলো আরও প্রকট হয়ে উঠছে। তারা কখনও কোন না রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন। অথচ বিজ্ঞানেই এই ধরনের অসুখ থেকে রক্ষা পাওয়ার বিবলিওথেরাপি আছে। রোকনুজ্জামান একটি প্রকাশনার প্রস্তÍতি নিচ্ছেন। অভিজ্ঞতায় জানালেন- দেখতে পান কয়েক শিক্ষার্থী একাকিত্ব বোধ করছেন। তরুণ ও মধ্য বয়সী কয়েকজন অসহায় হয়ে অস্থির আচরণ করছেন। তাদের অসুস্থ মন একটি জায়গায় স্থির হয়ে আছে। এ থেকে বের হয়ে আসতে পারছেন না। মানসিক শক্তি ও সাহস হারিয়ে ফেলছেন। প্রশান্তি পাচ্ছেন না। তিনি (মোঃ রোকনুজ্জামান) তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তাদের মনের অবস্থা ও দুর্দশা বুঝে সেই ধরনের বই পড়ার পরামর্শ দেন। মনের অসুখ বুঝে কাউকে পাঁচটি, কাউকে ৭/৮টি বই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পড়া শেষ করে জমা দিতে বলেন। একই সঙ্গে তাদের পছন্দের গান শুনতে বলেন। গানের ধরনও বেছে দেন। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ের কাউন্সিলিংয়ে অগ্রগতি জানতে চান। দেখা যায় ৯০ শতাংশ তাদের পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতে পেরেছেন।
এই বিষয়ে রোকনুজ্জামান বলেন, বেশিরভাগ পরিবারেরর সদস্য নানা কারণে স্ট্রেসড (মনের চাপ) নিয়ে থাকেন। যা মনকে অসুস্থ করে দেয়। সভ্যতার উন্নয়নে মানুষের জ্ঞানভান্ডার ক্রমেই হাজারো তথ্যে ভরে ওঠে। জ্ঞানের চারটি ধাপ ১. উপাত্ত বা ডেটা ২.তথ্য বা ইনফরমেশন ৩. জ্ঞান ৪. প্রজ্ঞা। সভ্যতার শুরু থেকে প্রজ্ঞাবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের প্রজ্ঞা বা মেধানিঃসৃত কথা বাণী বা উক্তির সামষ্টিক রূপ যখন কাগজে মুদ্রিত হয় তখন তা হয় পুস্তক।