ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশালের করোনা রোগীরা পাচ্ছেন বিনামূল্যে অক্সিজেন

প্রকাশিত: ১৬:১৩, ২১ এপ্রিল ২০২১

বরিশালের করোনা রোগীরা পাচ্ছেন বিনামূল্যে অক্সিজেন

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ করোনায় আক্রান্ত রোগীদের জরুরি সেবায় বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা কার্যক্রম শুরু করেছে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ (বিএমপি)। একই সেবা কার্যক্রম শুরু করেছেন আরও দুটি প্রতিষ্ঠান। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান জনকণ্ঠকে বলেন, করোনা রোগ বর্তমানে দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে। এসময় একজন করোনা রোগীর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় অক্সিজেনের। কিন্তু হঠাৎ করে অক্সিজেন পাওয়া যায়না এবং মুমূর্ষ রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার আগ পর্যন্ত অক্সিজেনের প্রাথমিক সুবিধা দিতে গত ১৫ এপ্রিল নগরীর পুলিশ লাইনস্ বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়েছে। পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, যেকোন সময় যেকোন ব্যক্তি রোগীর জন্য কন্ট্রোলরুমে অথবা পুলিশ লাইনস্ এসে অক্সিজেনের জন্য আবেদন করে সুবিধা নিতে পারবেন। প্রাথমিকভাবে ২২টি সিলিন্ডার দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে রোগীর বাড়িতে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়া এবং নিজস্ব টেকনিশিয়ান দিয়ে রোগীকে সেবা দেওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ডাক পরে বাসদের ॥ নগরীর একটি বাসা থেকে গত ১৬ এপ্রিল ইফতারের কিছুক্ষণ আগে কল আসে মোবাইল ফোনে। ওপাশের কণ্ঠটি অসহায় ও ভয়ার্ত। তার বাড়িতে অসুস্থ্য রোগী, তার অক্সিজেন সাপোর্ট দরকার। ফোনের একপাশ থেকে তাকে অভয় দিয়ে ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী বলেন-কোন চিন্তা করবেন না, আমরা আসছি। সাথে সাথে উপস্থিত টিম ডাঃ মনীষা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে অক্সিজেন নিয়ে হাজির হন ওই বাসায়। সেখানে গিয়ে তারা দেখতে পান পরিবারের দুই সদস্য করোনায় আক্রান্ত। তাদের অক্সিজেন দেওয়া থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপত্র দেন ডাঃ মনীষা। বাসার অপর সদস্যদের পৃথকভাবে থাকার পরামর্শ দেন। এটা একটি রাজনৈতিক দলের করোনাকালীন কর্মকান্ড। দলটির নাম বাসদ। সংগঠনের বরিশাল জেলা শাখার সদস্য সচিব ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী এভাবেই করোনাকালে সাংগঠনিক নেতৃত্ব দিয়ে সচল রেখেছেন তাদের অক্সিজেন ব্যাংক। গত ১৬ এপ্রিল ওই বাড়িতে পৌঁছার একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে “ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী” আইডি থেকে লাইভ করা হয়। মুহুর্তের মধ্যে সেখানে ২৪ হাজার রি-অ্যাক্ট, ২৮ হাজার ভিউ এবং ২৮১জন বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেন। অধিকাংশ মন্তব্যে বরিশাল জেলাবাসীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বাসদের এ কর্মকান্ডকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। পাশাপাশি দেশের সব রাজনৈতিক দল এবং বিত্তবানদের এভাবে এগিয়ে আসার আহবান করেছেন। ডাঃ মনীষা চক্রবর্তীর এই উদ্যোগে সহায়তা করার জন্যও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন অনেকে। ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী জনকণ্ঠকে বলেন, বেশিরভাগ মানুষ করোনা হওয়ার পরেও হাসপাতালে যেতে চাননা। তাদের জন্য অক্সিজেন থেকে শুরু করে সকল ধরনের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে আসছি। এমনকি ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসও দেওয়া হচ্ছে। পরিবারের সঙ্গতির ওপর নির্ভর করে প্রয়োজনে আমরা ওষুধও দিয়ে থাকি। তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রয়োজনীয় জনবল আছে। আমরা প্রশাসনের কাছে নগরীর বগুড়া রোডের আম্বিয়া হাসপাতালটি করোনা চিকিৎসার জন্য চেয়েছিলাম। বর্তমানে বরিশালের ৭০ভাগ টেকনোলজিস্টের চাকরি নেই। এরা বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কর্মরত। আমরা তাদেরকে নিয়ে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু রাজনীতির মেরুকরণে ভালো উদ্যোগের জন্য চাইলেও তা আমাদের দেওয়া হয়নি। ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী বলেন, অনেকেই অক্সিজেনের অভাবে ও বিনাচিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করছেন। আমরা আর কাউকে বিনাচিকিৎসায় মরতে দিতে চাইনা। এ কারণেই অক্সিজেন ব্যাংক চালু করেছি। ধনাঢ্যদের কাছে আবেদন আপনারও এ ধরনের কাজে এগিয়ে আসুন, তাহলে অনেক জীবন বেঁচে যাবে। সূত্রমতে, গত বছর মার্চ মাস থেকে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। নগরীতে করোনার প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে কোটি মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালের বেড থেকে শুরু করে আইসিইউ এবং অক্সিজেন সিলিন্ডারের সংকট দেখা দেয়। এ সংকট মোকাবেলায় সাধ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসে বাসদ। তারা গত বছর জুন মাসে নগরীর ফকিরবাড়ি দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ফ্রি অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহসহ সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পরেও ঘরে থেকে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন তারাই বেশি অক্সিজেনের সংকটে পরেন। তাদের অনেকে বাসদ এর স্বেচ্ছাসেবী কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করে ফ্রি অক্সিজেন সেবা গ্রহণ করে আসছেন। ফ্রি অক্সিজেন সেবা দেওয়ার জন্য বাসদ’র ১২ জন স্বেচ্ছাসেবী ২৪ ঘণ্টা কাজ করছেন। বাসদের একজন স্বেচ্ছাসেবী জানান, নগরীর যেস্থান থেকেই আমাদের অবহিত করা হউক আমরা সাথে সাথে সেখানে চলে যাই। সেখানে গিয়ে আমরা একরকম চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করি। অক্সিজেনের লেবেল থেকে শুরু করে করোনা রোগের সকল আলামত জেনে সেভাবেই চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। এখানে চিকিৎসকেরও পরামর্শ গ্রহণ করা হয়। যতোদিন পর্যন্ত রোগীর অক্সিজেন প্রয়োজন ততোদিন পর্যন্ত তাকে সেভাবে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। ওই স্বেচ্ছাসেবী আরও জানান, যাদের বেশিদিন অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়, সেখানে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত অক্সিজেন কনসেনট্রেটরও ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে আমাদের কাছে চারটি কনসেনট্রেটর রয়েছে। এসব কনসেনট্রেটর বাতাস থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে সার্বক্ষণিক অক্সিজেন সরবরাহ করার ক্ষমতা রাখে। বাসদের জেলা কমিটির আহবায়ক প্রকৌশলী ইমরান হাবিব রুমন জনকণ্ঠকে বলেন, যেসব রোগীর শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে তাদের জন্য প্রথমে অক্সিজেন ব্যাংক থেকে পালস অক্সিমিটার মেশিন পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে পালস অক্সিমিটারের রিডিং দেখে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকসহ অক্সিজেন সিলিন্ডার পাঠিয়ে দেই। প্রাথমিকভাবে পাঁচটি অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ৩০টি পালস অক্সিমিটার নিয়ে এই কার্যক্রম শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে ২৮টি অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ১০০ পালস অক্সিমিটার দিয়ে এই কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে এতো বেশি কল আসছে যে তা সামাল দিলে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এজন্য আরও অক্সিজেনের সিলিন্ডার প্রয়োজন। তাই বিত্তবানদের এগিয়ে আসার জন্য আমরা আহবান করছি। মানবতার ফেরিওয়ালা ॥ শ্বাসকস্টজনিত রোগীর পাশে মানবতার ফেরিওয়ালা নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গত একবছর ধরে মানবতার সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। প্রয়াত যুবদল নেতা এ্যাডভোকেট পারভেজ আকন বিপ্লবের প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠনে কাজ করছেন নয়জন স্বেচ্ছাসেবী। যাদের মুল কাজ হচ্ছে শ্বাসকস্টজনিত রোগীর সন্ধান পেলেই তারা ওই রোগীর সহযোগিতার জন্য অক্সিজেন নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন। করোনা মহামারীর প্রথম থেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিন-রাত ছুটে চলছেন (হিউম্যান ভলান্টিয়ারস) মানবতার ফেরিওয়ালা নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের একঝাঁক তরুণ। সংগঠনের সদস্য আলী হায়দার জনকণ্ঠকে বলেন, ইতোমধ্যে নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের শ্বাসকস্টজনিত সমস্যায় আক্রান্ত প্রায় চার শতাধিক রোগীকে সংগঠনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে অক্সিজেন সাপোর্ট প্রদান করা হয়েছে।
×