ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষার সংগ্রামে স্বাধীনতা

প্রকাশিত: ২১:০১, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

ভাষার সংগ্রামে স্বাধীনতা

সুমহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে গৌরবদীপ্ত অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২১ জন বরেণ্য ব্যক্তিকে দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক প্রদান উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মূলত ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত সংগ্রামের পথ ধরেই এসেছে বাংলাদেশের অমল ধবল লাল-সবুজ স্বাধীনতা। আর তা অর্জনের জন্য বাঙালীকে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করতে হয়েছে, অনেক রক্ত ঢালতে হয়েছে রাজপথে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ ও সংগ্রামের পর বিজয়ী বীর জাতি হিসেবে বাঙালী বিশ্বে মথা উঁচু করে চলছে আত্মমর্যাদা, সম্মান ও প্রত্যয়ের সঙ্গে। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন ও সংগ্রাম বাংলাদেশ এবং বাঙালীকে বিশ্বের বুকে সেই মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে। ’৫২র ভাষা আন্দোলন শুধু ভাষাভিত্তিক আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সর্বোপরি রাজনৈতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা তথা স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন। সে অবস্থায় বাংলা ভাষার সর্বতো পরিচর্যাসহ স্বাধীনতা সুরক্ষিত ও সমন্বিত রাখার দায়িত্ব দেশ ও জাতির। বাঙালী অথচ বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞা- এমনটি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ করা যাবে সেটি অভাবিত। কিন্তু একশ্রেণীর তথাকথিত ধনী ব্যক্তি এবং তাদের সন্ততিদের মাঝে তেমন প্রবণতাই লক্ষণীয়। এ যেন গর্ভধারিণী জননীকে অস্বীকার করে বিমাতার প্রতি অযাচিত আনুগত্য প্রকাশ। ইংরেজী মাধ্যমে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বাংলা উচ্চারণের দৈন্যদশা নিয়ে হতাশা থাকা স্বাভাবিক। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অভিভাবক ও শিক্ষকদের সহযোগিতা যে আবশ্যক সে কথাটি আমাদের জোরের সঙ্গে বলতে হবে। বিশ্বায়নের এই যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য অন্য ভাষা শেখার প্রয়োজন আছে অবশ্যই। সে ভাষা যে শুধু ইংরেজীই হতে হবে সেটিও বাস্তবসম্মত নয়। এখন ফরাসী, স্প্যানিশ, জার্মান, এমনকি চীনা ম্যান্ডারিন ভাষাও বিশ্ব অর্থনীতির বিচারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সেসব ভাষা বাঙালী শিখবে, চর্চা করবে; তবে সেটা মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে কখনই নয়। স্মরণযোগ্য, একুশে ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়ার পর ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। এই ইনস্টিটিউটে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভাষা শিক্ষার জন্য ফেলোশিপ চালু করার পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। এই উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য। সেইসঙ্গে আমরা ইনস্টিটিউটে যুক্ত সর্বস্তরের কর্মীদের কাছে কাজের গতি আরও বাড়ানো ও আন্তরিকতা প্রত্যাশা করি, যা এখনও তেমন দৃশ্যমান নয়। একুশ এখন বিশ্বের সব ভাষাভাষীর অধিকার রক্ষার দিন। বাঙালীর আত্মত্যাগের দিন এখন শুধু আর বাংলার নয়, প্রত্যেক মানুষের মায়ের ভাষার অধিকার রক্ষার দিন। ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এক আদেশে দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেট, সরকারী দফতরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজী বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা নিতে বলেছিল সরকারকে। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭-এর ৩ ধারায়ও সব কাজে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু এসবের প্রতিফলন আমরা কতটুকু দেখতে পাচ্ছি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখা এবং সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আরাধ্য কাজে সকলকে আত্মনিয়োগ করতে হবে।
×