ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ওষুধ পোড়ানোর ঘটনায় তোলপাড়

প্রকাশিত: ১৭:৩৫, ২৬ জানুয়ারি ২০২১

ওষুধ পোড়ানোর ঘটনায় তোলপাড়

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ॥ ঘুষ না পেয়ে ও রোহিঙ্গা নেতাদের ইন্ধনে স্থানীয় এক ব্যক্তির সাত লাখ টাকার জীবন রক্ষাকারী ওষুধ জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনায় তোলপাড় চলছে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওই ক্যাম্প ইনচার্জকে প্রত্যাহার ও ব্যবসায়ীর ক্ষতিপূরণের দাবিতে কাল বুধবার বিকেল ৩টায় কোটবাজার স্টেশনে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচী পালন করবে স্থানীয়রা। রোহিঙ্গা বিষয়কউর্ধতন এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেছেন, ক্যাম্পে আগুন দিয়ে ওষুধ পুড়ানোর ঘটনা তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হবে। সূত্র জানায়, প্রতি দোকান থেকে ২০হাজার টাকা হারে ক্যাম্প ইনচার্জকে মাসোহারা দিয়ে রোহিঙ্গারা ফার্মেসী ও বিভিন্ন দোকানে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় নুরুল হক নামে এক ফার্মেসী মালিক তার দোকানটি ক্যাম্পের বাইরে হওয়ায় তিনি ২০ হাজার টাকা দিতে গড়িমসি করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উখিয়ার কুতুপালং-৭নং ক্যাম্পের ইনচার্জ জেপি দেওয়ান অভিযানের নামে ৭ লক্ষ টাকার জীবন রক্ষাকারী ওষুধ পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার দুপুরে কুতুপালং-৭নং ক্যাম্পের ইনচার্জ নুরুল হকের ফারজানা ফার্মেসীতে (ক্যাম্প সীমানার বাইরে) অভিযানে যান। ওই দোকান থেকে এনে স্তুপ করে রোহিঙ্গাদের সন্মুখে ৭ লক্ষাধিক টাকার ওষুধ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ নুরুল হক বলেন, আমার সহায় সম্বল যা ছিল, সর্বস্ব দিয়ে ওই ফার্মেসীতে বিনিয়োগ করেছিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে এবং বিনা নোটিশে অভিযানের নামে ৭ লক্ষাধিক টাকার ওষুধ আগুনে বিনষ্ট করে ক্যাম্প ইনচার্জ জেপি দেওয়ান ঘুষ না পাওয়ার প্রতিশোধ নিয়েছেন। ওই সময় তার ফার্মেসীতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। উল্লেখ্য ক্যাম্পের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের মালিকানাধীন অসংখ্য ফার্মেসীসহ নানা ধরণের ব্যবসা প্রতিষ্টান রয়েছে। উদ্বাস্তু হয়েও রোহিঙ্গারা কতিপয় ঘুষখোর কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বশে এনে ওইসব দোকানে দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আমি ক্ষতিগ্রস্থ জনগোষ্টির একজন হিসেবে একটি ফার্মেসী করেছিলাম, তাও ক্যাম্পের ভিতরে নয়। আমি এর আইনী প্রতিকার এবং ক্ষতিপুরণ দাবি করছি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, মাসোহারা না পাওয়ার কারণে ব্যক্তিগত ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছেন সিআইসিজেপি দেওয়ান। কারণ ইতোপূর্বে তার নিয়ন্ত্রণে থাকা কমিউনিটি মোবিলাইজার মো: আজিজ, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী (সিপিপি) সদস্য জসিম, রুবেলসহ আরও একজন কর্মচারী নিয়মিত মাসোহারা আদায় করে নিতেন। সিপিপি সদস্য জসিম তার কাছ থেকে ক্যাম্প ইনচার্জের নামে দুই দফায় ১০ হাজার টাকা আদায় করেছে। ঘুষ চাওয়া বিষয়টি সত্য নয় দাবি করে ক্যাম্প ইনচার্জ বলেন, ক্যাম্পে তি প্রকারের দোকান বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশনা এসেছে, তাই অভিযান চালিয়েছি। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ জ্বালিয়ে দেয়ার বিধান রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামদ্দৌজা বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন দিয়ে ওষুধ পুড়ানোর ঘটনা তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হবে। উখিয়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রতিরোধ ও সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী দু:খ প্রকাশ করে জনকণ্ঠকে বলেন, স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কোন কথা না বলে বিনা নোটিশে ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ বের করে পুড়ানোর জন্য গভীর খুব ও নিন্দা জানাচ্ছি। ৭নং ক্যাম্পের সিআইসি জিপি দেওয়ানের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য উচ্চ প্রদস্থ কর্মকর্তাদের নিকট জোর দাবি জানিয়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আরও বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেশির ভাগ সিআইসি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আঁতাত করে দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা নেতাদের নিকট থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নিয়ে রোহিঙ্গাদের ওষুধের দোকান চালানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এ পর্যন্ত কোন রোহিঙ্গা ডাক্তাদের বিরুদ্ধে বা ওষুধের দোকানে অভিযান চাপলানো দূরের কথা, কোন রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীকে ভ্রাম্যমান আদালত গঠন করে জরিমানাও করা হয়নি। কতিপয় ক্যাম্প ইনচার্জ স্থানীয়দের সঙ্গে যে আচরণ করেছে, তা ভবিষ্যতে স্থানীয়দের মাঝে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। ওইসময় আমরা কখনও সিআইসিদের কর্মকান্ডে পক্ষ অবলম্বন করতে পারব না। জনগণ ক্ষেপে উঠলে ওই সিআইসিদের ভবিষ্যৎতে অঘটনের সম্মুখীন হতে পারে। ক্যাম্প ইনচার্জরা তখন পালিয়ে যাবার পথও খোঁজে পাবে না। অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দৌজ্জা আরও বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে সকল ফার্মেসী, ইলেকট্রনিক্স, জুয়েলারি শপ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ওষুধ জব্দ করে পুড়িয়ে ধ্বংসের বিষয়টি তিনি খোঁজ ও ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান। উখিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, শরণার্থী আইনে না থাকা সত্বেও ক্যাম্পের অভ্যন্তরে আশ্রিত রোহিঙ্গারা বিভিন্ন ব্যবসা করে আসছে। অথচ ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে স্থানীয় কয়েকজন যুবক কিছু ব্যবসা করলে তাদের প্রতিহত করা হচ্ছে। অন্য কোন প্রতিষ্টানে অভিযান পরিচালনা না করে শুধুমাত্র স্থানীয় ব্যক্তির ফার্মেসীতে অভিযানের নামে ওষুধ পুড়িয়ে দেয়ায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে তার যে ক্ষতি হয়েছে, ওই ক্ষতিপূরণ দেয়ারও দাবি জানাচ্ছি। অধিকার বাস্তবায়ন কমিটি উখিয়ার সভাপতি শরীফ আজাদ বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ৭ এর দুর্নিতিবাজ ওই সিআইসিকে স্ট্যান্ড রীলিজ ও ব্যবসায়ীর ক্ষতিপূরণের দাবিতে আজ বিকেলে কোটবাজার স্টেশনে অবস্থান কর্মসুচী অনুষ্টিত হবে। স্থানীয় এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ঘটনার সময় আমি ওখানেই ছিলাম। সব কিছু আমার চোখের সামনেই করেছে সিআইস ও তার কার্যালয়ের কর্মচারীরা। স্থানীয় নুরুল হকের ফার্মেসীতে অভিযানের সময় ছিল জনৈক যুবক। কোন কথা ছাড়াই সিআইসির নির্দেশে ওই ফার্মেসী থেকে ওষুধগুলো এনে স্তুপ করা হয় টেকনাফ সড়কের পাশে খোলা জায়গায়। তারপর ভলান্টিয়াররা অকটেন ঢেলে অমানবিকভাবে পুড়িয়ে দেয় জীবনরক্ষাকারী ঐ ওষুধগুলো। ক্যাম্পইনচার্জ জেপি দেওয়ানকে উদ্দেশ করে স্থানীয় যুবকরা বলেন, আপনি রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৭ এর নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। কর্তব্যরত এলাকার যেকোন অসঙ্গতিতে আপনার কথা বলার সুযোগ আছে। সিদ্ধান্ত প্রদানের এক্তিয়ার আছে। কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড সবই দিতে পারেন। কিন্তু একটি অসহায় মানুষের রুজিরোজগারের একমাত্র মাধ্যম ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পণ্যগুলো আগুনে জ্বালিয়ে দিতে পারেন না। এ অধিকার সরকার ও জনগণ আপনাকে দেয়নি। যেখানে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় নাগরিকদের মূল্যায়ন করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। সেখানে আপনী রোহিঙ্গাদের ইন্ধনে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ফার্মেসী থেকে বের করে জীবনরক্ষাকারী দেশীয় ওষুধগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গা নেতাদের (চাঁদা আদায়কারী) খুশি করেছেন, তা কোনভাবে মেনে নেয়া যায়না। তারা আরও বলেন, যদি ওষুধগুলো অবৈধ হয়ে থাকলে আপনী জব্দ করে শুল্ক দফতরে জমা দিতে পারেন। মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে প্রচলিত আইন অনূসারে ফার্মেসী মালিককে অর্থদন্ড দেয়ার বিধান রয়েছে। তবে জীবন রক্ষাকারী ওষুধগুলো জ্বালিয়ে দিয়ে আপনী স্থানীয়দের কী বুঝাতে চেয়েছেন বোধগম্য হচ্ছেনা।
×