ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নুরুন নাহার আঁখি

করোনায় অর্থনৈতিক মন্দা বেকারত্ব ও বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২০:০৫, ৩ ডিসেম্বর ২০২০

করোনায় অর্থনৈতিক মন্দা বেকারত্ব ও বাংলাদেশ

অর্থনৈতিক মন্দা ও বেকারত্ব একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অর্থনৈতিক মন্দা বেকারত্ব সৃষ্টি করে আর বেকারত্ব অর্থনৈতিক মন্দাকে দীর্ঘায়িত করে। করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয় বিশ্ব অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করে তুলেছে, যার ছোঁয়া লেগেছে বাংলাদেশেও। বিশ্বের অপরাপর দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও করোনার সময়ে নানামুখী জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছে। আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল)-এর মতে, কোন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যদি ধারাবাহিকভাবে দুই প্রান্তিক অর্থাৎ, ছয় মাসে ২ দশমিক ৫ শতাংশ বা এর চেয়ে বেশি সঙ্কুচিত হয়, তখন এই পরিস্থিতিকে অর্থনৈতিক মন্দা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে, বেকারত্ব বলতে অর্থনীতির ওই অবস্থাকে বোঝানো হয়, যখন কোন দেশের বহু সংখ্যক সুস্থ, কর্মক্ষম মানুষ সক্রিয়ভাবে কাজের সন্ধান করা সত্ত্বেও প্রচলিত মজুরিতে কাজ পায় না। তবে ২০০২-২০০৩ এবং ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে পরিচালিত বাংলাদেশের শ্রমশক্তি সম্পর্কিত জরিপে, ১৫ বছর বা তদুর্ধ বয়সের এমন ব্যক্তিকে বেকার বিবেচনা করা হয়েছে, যে সক্রিয়ভাবে কাজের সন্ধান করা সত্ত্বেও কোন কাজ করেনি। অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কিনস্রে হাত ধরে যে সামষ্টিক অর্থনীতির পথচলা শুরু, তার প্রেক্ষাপট ছিল যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত ১৯৩০ সালের মহামন্দা। এই মহামন্দা কাটিয়ে অর্থনীতিকে তার স্বাভাবিক রূপে ফিরিয়ে আনতে যে লক্ষ্যগুলো স্থির করা হয়েছিল তার একটি হলো নিম্ন বেকারত্ব ও উচ্চ কর্মসংস্থান অর্জন। কারণ ১৯২৯-১৯৩৩ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেয়েছিল ২০ শতাংশ। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ১৯৩০ সালের পরে বর্তমান মন্দাকালীন সময় পর্যন্ত ছোট-বড় আরও ১৩টি মন্দার সম্মুখীন হয়েছে। তবে, ১৯৩০ সালের পর এবং করোনার সময়ের পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রে যে বড় অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, তা ছিল ২০০৭ সালের অর্থনৈতিক মন্দা। বিশ্বের অনেক দেশেই সেই মন্দার বিরূপ প্রভাব পড়লেও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তা প্রভাবিত করতে পারেনি। আইএমএফের মতে, ‘১৯৩০ সালের পর সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সঙ্কট তৈরি করেছে করোনাভাইরাস।’ বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। গত অর্থবছরে (২০১৯-২০২০) বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ, যা গত ১৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ এর এক বছর আগেই অর্থাৎ, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ১ শতাংশ, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সুতরাং বলা যায় অর্থনৈতিক মন্দা খুব ভালভাবেই আঘাত হেনেছে বাংলাদেশে। ইতোমধ্যে বেকার হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি গবেষণা বলেছে, বেসরকারী খাতে চাকরিরতদের ১৩ শতাংশ ইতোমধ্যে চাকরি হারিয়েছে। ২৫ শতাংশ চাকরিজীবীর বেতন কমে গেছে। এ ছাড়া অনেকেই আছেন যাদের চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেই। ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের (আইএফসি) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, করোনার কারণে দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। যেখানে কাজ করেন দেশের প্রায় ২ কোটি নারী-পুরুষ এবং জিডিপির ২০ শতাংশ আসে এই অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত সেপ্টেম্বরে এক টেলিফোন জরিপে দেখেছে করোনা শুরুর ৩ থেকে ৪ মাসে ব্যাপকভাবে বেকারত্ব বেড়েছিল। যেমন, মার্চ মাসে বেকারত্ব ছিল ২ দশমিক ৩ শতাংশ, যা জুলাই মাসে ১০ গুণ বেড়ে হয়েছিল ২২ দশমিক ৩৯ শতাংশ। তবে, সেপ্টেম্বরে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় অনেকে কাজে ফেরার কারণে এই হার কমে এসেছে ৪ শতাংশে। এটি একটি আশা জাগানিয়া দিক হলেও করোনাকার সময়ে এই হার বজায় রাখাও বাংলাদেশ সরকারের জন্য অনেক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হবে। এদিকে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়ে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ হলেও ইতোমধ্যে সরকার ২০২০-২০২১ অর্থবছরের জন্য জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। করোনার এই সময়ে এত উচ্চ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছে আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর মতো বৃহৎ দাতা সংস্থাগুলো। বৃহৎ এ দাতা সংস্থাগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরকারের এই উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বেকারত্ব হ্রাসের বিকল্প নেই। বিশাল কর্মক্ষম শ্রমশক্তিকে কর্মক্ষেত্রের বাইরে রেখে জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই বেকারত্ব হ্রাসকে সরকারের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের মতো শ্রম প্রচুর অর্থনীতিতে উৎপাদন কর্মকাণ্ডে মূলধনঘন প্রযুক্তির পরিবর্তে শ্রমঘন প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। করোনা সঙ্কটকালীন এই উচ্চ মাত্রার অনলাইন নির্ভরতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে, যা অর্থনীতিকে মূলধনঘন প্রযুক্তি নির্ভরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু এই মূলধনঘন প্রযুক্তির নির্ভরতা বেকারত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই, বেকারত্ব হ্রাস করতে হলে মূলধনঘন প্রযুক্তির নির্ভরতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে, অন্তত যতদিন না আমাদের অর্থনীতি শ্রম প্রচুর অর্থনীতি থাকবে। লেখক : অর্থনীতির শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা
×