ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রায়হান আহমেদ তপাদার

করোনা প্রতিরোধে ফাইজারের টিকা

প্রকাশিত: ২১:১২, ২৬ নভেম্বর ২০২০

করোনা প্রতিরোধে ফাইজারের টিকা

বিশ্বব্যাপী বহু দেশের গবেষক কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন তৈরিতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে প্রশ্ন হলো, ভ্যাকসিন তৈরি হলেও এটি কি বিশ্বের সবাই পাবেন? গবেষক ও এ খাতের বিশেষজ্ঞদের ধারণা হলো, উৎপাদনের পথে নানা সীমাবদ্ধতা এবং ধনী দেশগুলোর মজুদ করার প্রবণতার কারণে বিশ্বের সব আক্রান্ত মানুষ এর সেবা না-ও পেতে পারেন। কিছু মানুষ আশা দেখাচ্ছেন, ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যেই তৈরি হয়ে যেতে পারে কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন। কিন্তু গবেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন, প্রত্যেকের হাতে ভ্যাকসিন তুলে দেয়া আসলে সম্ভব না-ও হতে পারে। কারণটাও তারা বলে দিয়েছেন। ধনী দেশগুলো ভ্যাকসিন নিজেদের জন্য মজুদ করতে পারে। কোন ধরনের ভ্যাকসিন কার্যকর হবে, মূলত তার ওপরই নির্ভর করবে, প্রডাকশনের জন্য কেমন ফ্যাসিলিটিজের প্রয়োজন পড়বে। এছাড়া বিশ্বজুড়ে যেসব টিকার পরীক্ষা চূড়ান্ত ধাপে রয়েছে, তার মধ্যে থেকে ফাইজার-বায়োএনটেকের পক্ষ থেকেই সুখবর মিলল। তবে কোন টিকার চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষার একেবারেই প্রাথমিক খবর এটি। আর টিকাটি কতটা ভালভাবে কাজ করবে তাও জানা যায়নি। চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষায় তাদের টিকা কোভিড-১৯ রোধে ৯৫ ভাগ সক্ষম বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ফাইজার। বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করার মধ্যেই প্রাণঘাতী এই ভাইরাস প্রতিরোধী টিকা নিয়ে সুখবর মিলেছে। বিশেষজ্ঞদের বাইরে পরামর্শকদের সঙ্গে এফডিএর আলোচনা এবং টিকার নিরাপত্তা, কার্যকারিতা ও লাখ লাখ নিরাপদ ডোজ উৎপাদনে কোম্পানিগুলোর সক্ষমতার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। শিশুদের ওপর টিকা কার্যকর হবে কিনা তা নিয়েও অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমদিকে এই টিকার ট্রায়াল ১৮ থেকে তার বেশি বয়সীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। তবে আশার কথা হল, সেপ্টেম্বরে তারা ১৬ বছর বয়সীদের ট্রায়ালে অন্তর্ভুক্ত করে। আর গত মাসে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের নিয়েও কাজ শুরু করেছে। ফাইজার জুলাইতে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অপারেশন র‌্যাপ স্পিডের সঙ্গে। কয়েকটি কোম্পানির মাধ্যমে করোনাভাইরাসের ১০ কোটি ডোজ টিকা বাজারে আনতে এই উদ্যোগ নিয়েছে দেশটির সরকার। এটি হলো টিকার অগ্রিম ক্রয়াদেশ চুক্তি। এর অর্থ হলো- কোন কোম্পানি টিকা সরবরাহ না করলে অর্থও পাবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং অপারেশন র‌্যাপ স্পিড থেকে দূরেই ছিল ফাইজার। কিন্তু গত রোববার কোম্পানির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং হেড অব ভ্যাকসিন রিসার্চ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ক্যাথরিন জ্যানসেন বলেন, ‘আমরা কখনই র‌্যাপ স্পিডের অংশ ছিলাম না। আমরা সরকারের কাছ থেকে কিংবা অন্য কারও কাছ থেকেও অর্থ নিইনি।’ কোভিড-১৯ সংক্রমণের ১৬৪টি কেস না পাওয়া পর্যন্ত চলবে চূড়ান্ত ধাপের ট্রায়াল। এরপরই টিকার পরীক্ষা শেষ হবে এবং ফলাফল বিশ্লেষণ করা হবে। ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা করোনাভাইরাস থেকে বয়স্কদের কতটা সুরক্ষা দেবে, তা নতুন তথ্যে পরিষ্কার নয়। তবে যেহেতু ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ৬৫ বছরের বেশি বয়সীরাও অংশ নিয়েছেন, তাতে করে এই বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলতে পারে। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ১০টি টিকার চূড়ান্ত ধাপের ট্রায়াল চলছে। ফাইজার-বায়োএনটেকের সফলতার খবরে কিছুটা হতাশ হতে পারে টিকা তৈরির দৌড়ে থাকা অন্য কোম্পানিগুলো। ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা প্রয়োগে মানুষের শরীরে এক ধরনের ভাইরাল প্রোটিন তৈরি হবে, যাকে বলা হচ্ছে স্পাইক। অন্যদিকে বেশকিছু টিকার মাধ্যমে শরীরে স্পাইক প্রোটিন বা তার একটি অংশ সরবরাহ করা হয়, যাতে শরীরের ইমিউন সিস্টেম সেটিকে শনাক্ত করতে পারে। এখন যদি স্পাইক প্রোটিন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে শক্তভাবে কার্যকর প্রাণিত হয়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে অন্য টিকাগুলোর বিষয়েও আশা জাগানিয়া খবর মিলতে পারে। কয়েক মাসের মধ্যেও যদি ফাইজারের টিকা ব্যবহারের অনুমোদন মেলে, তারপরও তা শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষই পাবে ধরে নেয়া যায়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সবার জন্য কার্যকর একটি টিকা মিলতে পারে আগামী বছর। তাছাড়া কোন টিকা ভাইরাসটির লক্ষণবিহীন সংক্রমণ রোধ কিংবা মানুষকে মারাত্মক কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষা দিতে পারবে কিনা, তার কোন তথ্য প্রমাণ এখনও মেলেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা সহজলভ্য হলেও জনস্বাস্থ্যোর ওপর থেকে হুমকি না কমা পর্যন্ত মাস্কের ব্যবহার চালিয়ে যেতে হবে। ফাইজার-বায়োএনটেকের প্রাথমিক তথ্যটি যদি ঠিক হয় এবং মাঠপর্যায়ের প্রয়োগে এর সঠিক প্রতিফলন ঘটে, তাহলে তা নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে বেশিই সুরক্ষা দেবে। টিকা প্রস্তুতকারীদের জরুরী অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে টিকা ৫০ ভাগ কার্যকার হবে, এমন একটি বাধ্যবাধকতা ঠিক করে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ কর্তৃপক্ষ-এফডিএ। বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত টিকাগুলোর মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা ৪০-৬০% কার্যকর হয়। কারণ, এই ভাইরাসটি বছরের পর বছর ধরে রূপ বদলায়। অন্যদিকে হামের দুই ডোজ টিকার কার্যকারিতা ৯৭ ভাগ। গত মে থেকে চালানো ছোট আকারে কয়েক ধাপের পরীক্ষা আর চলমান চূড়ান্ত ধাপ- কোন পর্যায়েই টিকা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। ফাইজার-বায়োএনটেক মূলত চার ধরনের টিকা আনার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে শুধু একটির প্রয়োগে জ্বর এবং অবসাদের মতো মৃদু উপসর্গ দেখা গিয়েছিল। তাছাড়া জরুরী অনুমোদন ও লাখ লাখ মানুষকে প্রয়োগের সময় ন্যূনতম ঝুঁকিও যাতে না থাকে, সেজন্য পুরো বিষয়টির ওপর নজর রাখবে এফডিএ এবং সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এ্যান্ড প্রিভেনশন। ট্রায়ালে যারা অংশ নিয়েছেন তাদেরকেও আরও দুই বছর নজরদারিতে রাখা হবে। সবমিলিয়ে এ বছরের শেষ নাগাদ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হতে পারে। কিন্তু সবকিছুই নির্ভর করছে যদি সবকিছু পরিকল্পনা মতো চলে আর অনাকাক্সিক্ষত বিলম্ব না ঘটে। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ফাইজারের টিকা সংরক্ষণ করতে হবে মাইনাস ৮০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায়। অথচ বাংলাদেশে এমন কোনো হিমচক্র ব্যবস্থা নেই, যাতে এই নিম্ন তাপমাত্রার বিষয়টি নিশ্চিত করা যাবে। অনুমোদন পেলে চলতি বছরের শেষ নাগাদ মার্কিন নাগরিকদের জন্য দেড় কোটি ডোজ সরবয়াহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ফাইজার। যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানি ফাইজার ঘোষণা দিয়েছে যে, তাদের উদ্ভাবিত কোভিডের টিকা ৯৫ শতাংশের ওপরে কার্যকর, যা ধনী দেশগুলোর জন্য বিরাট এক আশার সঞ্চার করেছে। এতে অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধারের আশায় পুঁজিবাজার চাঙ্গা হয়ে উঠছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো গরিব দেশগুলোর জন্য খুব আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু নেই, এমন কি ভারতের জন্যও নয়। লেখক : লন্ডন প্রবাসী
×