ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার ॥ নারী নীতি ও সিডও সনদ

প্রকাশিত: ২০:৫১, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

সম্পত্তিতে নারীর উত্তরাধিকার ॥ নারী নীতি ও সিডও সনদ

হিন্দু বিধবারা স্বামীর সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন। উনিশ শ’ ছিয়ানব্বই সালে করা এ সংক্রান্ত একটি মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট এ রায় দেয়। বাংলাদেশের সংবিধান এবং উনিশ শ’ সাতানব্বই সালে প্রণীত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালায় সম্পত্তিতে নারী-পুরুষ সমানাধিকারের স্পষ্ট উল্লেখ থাকার পরও এ নিয়ে পরিষ্কার কোন মীমাংসা হয়নি। শরীয়া আইনের দোহাই দিয়ে নারী নীতির বিরোধিতা করে সে সময় মাওলানা ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বে তুমুল আন্দোলন হয়েছিল। মুসলিম পারিবারিক আইনে বাবার সম্পত্তির কিছু অংশ কন্যাদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে, যা আইনত তার প্রাপ্য। বাংলাদেশের হিন্দু নারীদের সে রকম কোন আইনী অধিকার না থাকায় বাবা বা স্বামীর সম্পত্তি থেকে তারা এতদিন বঞ্চিত ছিলেন। এ আইন বাস্তবায়ন হলে হিন্দু বিধবারা স্বামীর সম্পত্তির আইনী উত্তরাধিকারী হবেন। মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী ‘উত্তরাধিকারের মাধ্যমে ওয়ারিশরা যে মালিকানা লাভ করে তা বাধ্যতামূলক। এতে ওয়ারিশের কবুল করা এবং সম্মত হওয়া জরুরী ও শর্ত নয়, বরং সে যদি মুখে স্পষ্টত বলে যে, সে তার অংশ নেবে না, তবুও আইনত সে নিজের অংশের মালিক হয়ে যায়। এটা ভিন্ন কথা যে মালিক হওয়ার পর শরিয়তের বিধি অনুযায়ী অন্য কাউকে দান, বিক্রি অথবা বিলি বণ্টন করে দিতে পারবে। ... পুুরুষদের যেমন উত্তরাধিকারের হকদার মনে করা হয়, তেমনি নারী ও শিশুদের এ হক থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। কেননা, সন্তানের সম্পর্ক হোক কিংবা পিতা-মাতার সম্পর্ক হোক অথবা অন্য কোন সম্পর্ক, প্রত্যেকটিতেই সম্পৃক্ততার মর্যাদা ছেলে ও মেয়ের মধ্যে সমান। ছেলে যেমন পিতা-মাতা থেকে জন্মগ্রহণ করে, তেমনি মেয়েও পিতা-মাতারই সন্তান। উত্তরাধিকার স্বত্ব সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই ছোট ছেলে কিংবা মেয়েকে বঞ্চিত করার কোনই কারণ থাকতে পারে না’। (‘মাওলানা মুহিউদ্দীন খান- ‘তফসীর মারেফুল ক্বোরান’) নারী নীতির যেসব ধারা নিয়ে সে সময় কুরআন-সুন্নাহ অবমাননার জিগির উঠেছিল। তা এ রকম নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জরুরী বিষয়াদি যথা- স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জীবনব্যাপী শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, আয়বর্ধক প্রশিক্ষণ, তথ্য ও প্রযুক্তিতে নারীকে পূর্ণ ও সমান সুযোগ প্রদান করা (ধারা ২৫.১)। ২৫.২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, উপার্জন উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা। এ ছাড়া জাতীয় অর্থনীতির সকল কর্মকা-ে নারীর সক্রিয় ও সমঅধিকার নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে ২৩.৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেয়া। ২৩.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং নারী-পুরুষের মধ্যে বিরাজমান পার্থক্য দূর করা। ২৩.৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির প্রয়োগে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রতিহত করার লক্ষ্যে নারীর অনুকূলে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা।’ এখানে কি এমন কোন বৈপ্লবিক কথাবার্তা যা নিয়ে রাজপথ দাপিয়ে আন্দোলন করার প্রয়োজন হয়। তারা নারী নীতিতে কুরআন-সুন্নাহর অবমাননা খুঁজে পেয়েছেন, কিন্তু সম্পত্তি বিলি-বণ্টনে কুরআন বর্ণিত বিধান যে প্রতিমুহূর্তে লঙ্ঘিত হচ্ছে সে বিষয়ে নীরবই থেকেছেন। বেশিদূর যেতে হবে না, নিজেদের পরিবারে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে খোঁজ নিলে দেখা যাবে বোনদের প্রাপ্য সম্পত্তি দিতে বেশিরভাগ ভাইয়েরই মুখ ভার হয়। নানা ধরনের টালবাহানা-কূটকৌশল প্রয়োগ থেকে শুরু করে নির্যাতন এমনকি হত্যার ঘটনাও অহরহ। শরীয়া আইনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে- ‘উত্তরাধিকারের মাধ্যমে ওয়ারিশরা যে মালিকানা লাভ করে তা বাধ্যতামূলক। এতে ওয়ারিশরা কবুল করা এবং সম্মত হওয়া জরুরী ও শর্ত নয় বরং সে যদি মুখে স্পষ্টত বলে যে, সে তার অংশ নেবে না, তবুও আইনত সে নিজের অংশের মালিক হয়ে যায়।’ এই মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে তেমন কোন তৎপরতা দেখা যায় না। অথচ এও ইসলামের বিধান, কুরআনের নির্দেশ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন বিধবা বিবাহ প্রচলনের আন্দোলনে নেমেছিলেন তখন আমিনীদের মতো হিন্দু ধর্মের রক্ষকরা ধর্মের কাঁদুনী গেয়েছিল। কিন্তু বিধবা বিবাহ আইন প্রণয়ন ঠেকাতে পেরেছিল? পারেনি। কারণ সব কিছুর পরেও সমাজ সামনে এগোয়। মৌলবাদীদের দাঁত খিঁচানোর ভয়ে সমাজ উল্টো পথে চলবে না। নারী নীতির পূর্বাপর না জেনেই অনেকে লাফঝাঁফ করেছে কিন্তু। নারী নীতি যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে তার মূল ভিত্তি সিডও সনদ। ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এ সনদ গৃহীত হয়। সিডও পরিপূর্ণ একজন মানুষ হিসেবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার দলিল। তিন ধারায় সংরক্ষণ আরোপ করে বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালে সিডও সনদ অনুমোদন করে। পরে ১৯৯৭ সালে দুটো ধারা থেকে সংরক্ষণ তুলে নিলেও ধারা-২ এবং ধারা ১৬-১ (গ) থেকে এখনও সংরক্ষণ তোলেনি। সরকারী বক্তব্য অনুযায়ী মুসলিম শরিয়া আইন পরিপন্থী বলে এ ধারা অনুমোদন করা হয়নি। অথচ অনেক মুসলিম দেশ সংরক্ষণ ছাড়াই সনদ অনুমোদন করেছে। প্রথম নারী নীতিও প্রণয়ন হয় ১৯৯৭ সালে। এরও পূর্ব ইতিহাস আছে। ১৯৯৫ সালে বেজিং নারী শীর্ষ সম্মেলনে নারী উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনায় যে ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়েছিল যা প্ল্যাটফর্ম ফর এ্যাকশন নামে পরিচিত তার আলোকেই নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল নির্যাতিত ও অবহেলিত এ দেশের নারী সমাজের বড় অংশের জীবনমান উন্নত করা। ১৯৯৭ সালের ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবসে এ নীতি ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় এ নিয়ে এক দফা হৈচৈ হয়েছিল। ২০০৪-এ বিএনপি সরকার এসে কিছু শব্দ পরিবর্তন করে আবার নারী নীতি ঘোষণা করে। এতেও সামান্য সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবার নারী নীতি ঘোষণা করে। তখনও বায়তুল মোকাররম এলাকায় এ নিয়ে রক্তারক্তি হয়েছে। অর্থাৎ নীতি যখন নারীদের নিয়ে তখন এর বিরোধিতা করতেই হবে। অথচ নারী নীতি যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে সেই সিডও সনদের গুরুত্বপূর্ণ ধারাতেই শরিয়া আইন পরিপন্থী বলে সংরক্ষণ আরোপ করে রাখা হয়েছে। শরিয়া আইন বলতে সচরাচর মুসলিম পারিবারিক আইনকে বোঝানো হয়। কিন্তু হিন্দু, খ্রীস্টান, বৌদ্ধসহ অন্যান্য ধর্মের নারীদের উত্তরাধিকার সম্পর্কে তেমন কিছু বলা হয়নি। হিন্দু পারিবারিক আইন অনুযায়ী সম্পত্তিতে এতদিন নারীর কোন আইনী অধিকার ছিল না। নীতিতে যেমন উল্লেখ নেই তেমনি সাধারণেও এ নিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্য নেই। সব ধর্মের নারীই সম্পত্তিতে সমান অধিকার থেকে বঞ্চিত। হিন্দু নারী বঞ্চিতদের মধ্যে বঞ্চিততর। খোঁজ নিলে দেখা যাবে ওই ধর্মের ‘রক্ষকরা’ও আমিনীদের সমগোত্রীয়। মানসিকতায় তারা অভিন্ন। মুশকিল হলো নারী সম্পর্কিত কিছু হলে সবাই ভাবে এ নারীদের বিষয় নারীরাই লড়বে। কিন্তু নারী সমাজ বিচ্ছিন্ন নয়, তার সঙ্গে পুরুষ সম্পর্কিত। যে কোন নারী ইস্যু তাই সামাজিক ইস্যু। নারী উন্নয়ন নীতি আসলে কি তা ঠা-া মাথায় বিবেচনা করলে সম্পত্তি হারানোর আতঙ্ক যেমন থাকবে না তেমনি কুরআন-সুন্নাহ অবমাননার ধুয়া তুলে স্বার্থসিদ্ধির অবকাশও থাকবে না।
×