ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

বঙ্গবন্ধু ॥ বজ্রকণ্ঠের মহীরুহ

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ১৮ আগস্ট ২০২০

বঙ্গবন্ধু ॥ বজ্রকণ্ঠের মহীরুহ

(গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর) তিনি একটু হাসলেন আমার কথা শুনে। তারপর আমার চোখে চোখ রেখে বললেন, আমার মনে হয় বঙ্গবন্ধুকে আমি একটা কষ্ট দিয়েছি। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই এরকম একটা অপরাধবোধ আমাকে তাড়া করে চলেছে। আমার কেবলই মনে হয়, আমার এই কাজটা করা ঠিক হয়নি। আমি বললাম, এমন কি কষ্ট আপনি দিয়েছেন তাঁকে, যার জন্য আপনি এখন কষ্ট পাচ্ছেন? তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু খুব জাঁকজমক করে তাঁর চলিশার (চেহলাম) আয়োজন করেছিলেন। আমাকে তিনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁর পিতার মঙ্গল কামনা করে কোরান খতমে অংশ নেবার জন্য। আমি তাঁকে বললাম, তুমি প্রচুর অর্থ খরচ করে তোমার পিতার জন্য যে বিশাল আয়োজন করেছ, এত অর্থ তুমি কীভাবে উপার্জন করেছো, এই নিয়ে আমার মনের মধ্যে কিছু সংশয় তৈরি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমার কথা শুনে একটু ব্যথিত হন। আমি ভেবেছিলাম, তিনি জাতির পিতা, দেশের প্রেসিডেন্ট, তিনি দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, আমার ওপর রাগ হতে পারেন। কিন্তু না। আমার কথা শুনে তিনি একটুও রাগ হলেন না, কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, হালিম, সত্য কথা বলার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তুমি প্রকৃত ইমানদার মুসলমান। অন্য কোন মৌলানা তোমার মতো সাহস করে আমার কাছে তাদের মনে সংশয় থাকলেও তা প্রকাশ করবে না। তোমার সৎ সাহস আছে, তাই তুমি করেছো। মনে সংশয় নিয়া তুমি যদি আমার পিতার মঙ্গল কামনা করে কোরান শরীফ পড়তা, তাতে আল্লাহ নারাজ হতেন। তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছো। আমার প্রিয় পিতার আখিরাতের মঙ্গলের জন্য আমি নিজেই কোরান শরীফ পড়ব। তুমি আশপাশে থাইকো, কোথাও কোন ভুল হইলে আমারে বইল। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, বঙ্গবন্ধু নির্ভুলভাবে, পবিত্র মনে সেদিন কোরান শরীফ পাঠ করেছিলেন। ঘটনাটির কথা বলার সময় মৌলানা শেখ আবদুল হালিমের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। আমি বললাম, আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুর আর্থিক সততা নিয়ে মনে সন্দেহ পোষণ করাটা আমার উচিত হয়নি। আমি সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তাঁর মনে একটা খুব বড় রকমের কষ্ট দিয়েছি। সেই জন্য কাঁদছি। তাঁকে কবর দিয়ে ঘরে ফেরার পর থেকে আমি যখনই তাঁর কথা ভাবি, যখনই আমি তাঁর পিতা, মাতা এবং বঙ্গবন্ধুর কবরের কাছে যাই, পাশ দিয়ে হাঁটি তখনই ঐ ঘটনাটার কথা আমার মনে পড়ে যায়। আমার বুকটা ভারি হয়ে ওঠে। আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। বঙ্গবন্ধুর আর্থিক সততা ও সঙ্গতি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার জন্য আমি পরম করুণাময় আলাহর কাছে মাফ চাই।’ মৌলানা আবদুল হালিম সম্ভবত এখন বেঁচে নেই। কারণ বঙ্গবন্ধুকে যিনি তুমি সম্বোধন করেছিলেন, সম্ভবত তিনি বঙ্গবন্ধুর সমবয়সী হবেন। বেঁচে থাকেলও তিনি আজ শতবর্ষী। এই মৌলানা শেখ আবদুল হালিমই বঙ্গবন্ধুর জানাজা পড়িয়েছিলেন। মৌলানা সাহেবের সঙ্গে কবি নির্মলেন্দু গুণের কথোপকথন থেকে যা আমরা জানলাম, তাতে আবারও আমার বলতে ইচ্ছে করছে মহান হৃদয়বান মানুষ বঙ্গবন্ধুর কাছে মৌলানা হালিম সাহেবের মতো একজন মৌলানা সাহেবেরও যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল। তাঁর নিকট থেকে বঙ্গবন্ধু পরামর্শ নিয়ে নিজেই পবিত্র কোরআন শরিফ পাঠ করেছেন বাবার বিদেহী আত্মার মাগফিরাতের জন্য। কোরআন শরীফ পাঠে নিজের ভুল হতে পারে, এ সম্ভাবনাও বঙ্গবন্ধু উড়িয়ে দেননি। তাই মৌলানা সাহেবকে কোরআন শরীফ পাঠের সময় তাঁর পাশে থাকতে বলেছেন, ভুলত্রুটি হলে যেন মৌলানা সাহেব তাঁকে শুধরে দেন। অসাধারণ এক ন¤্র স্বভাবের দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সত্যিই ফিদেল ক্যাস্ট্রোর ভাষায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন হিমালয় এর প্রতিভূ। নিজ চিন্তায় ভাবনায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন অবিচল। অসীম সাহসের অধিকারী অথচ হিমালয়ের মতো বড় হৃদয়, নম্রতা আর ভদ্রতার এক অপূর্ব সংমিশ্রণে এক মহান নেতাকে মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের মাতৃভূমির স্থপতি ও জাতির পথ প্রদর্শক নেতা বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন, বাঙালীর মুক্তির জন্য। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর শোকের আগস্ট মাসে তাঁর প্রতি আমার গভীর ও বিন¤্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। প্রত্যাশা করছি যেন বাংলাদেশের প্রত্যেক পিতা মাতা তাদের সন্তানদের বঙ্গবন্ধুর চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো জানতে, অনুধাবন, ধারণ বা রপ্ত করার শিক্ষা দেন। আমরা আজ যারা বিচারিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি তাদের উদ্দেশ্যে বলব, বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ দিয়ে গেছেন বলেই আজ আমরা উচ্চতর আদালতে বিচারকের অতি উঁচু আসনে আসীন। যে দুঃখী মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবন দিয়ে গেছেন, আসুন আমরা সেই নিপীড়িত মানুষের সাংবিধানিক ও আইনী অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তথা দেশে ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমি¥লিত ও নির্মোহভাবে কাজ করি। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে। (সমাপ্ত) লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান,আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২
×