ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

জাস্টিন গোমেজ

করোনায় শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

প্রকাশিত: ১৯:৩৭, ৭ জুলাই ২০২০

করোনায় শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

দিন দিন জ্যামিতিক হারে মৃত্যু এবং করোনায় সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। যে কোন স্তরের শিক্ষার্থীরা কোভিড-১৯ দ্বারা সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই সরকার শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে কোভিড-১৯ নিয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে। কোভিড-১৯-এর কারণে অনলাইন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি কিছু সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অনলাইনে ক্লাস নেয়া শুরু করছেন এবং কিছু শিক্ষক অনলাইন এ্যাসাইনমেন্ট এবং হোমওয়ার্ক নিচ্ছেন। এ ছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকরা টিভিতে ক্লাস নিচ্ছেন। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা কার্যকর? অনলাইন ক্লাস শ্রেণীকক্ষে সরাসরি ক্লাসের চেয়ে বেশি কার্যকর বলে মনে হয় না। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের। আর্থিক সঙ্কটের কারণে অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে না। অনেকেরই নেই অনলাইন শিক্ষায় অংশগ্রহণের মতো মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ। অন্যদিকে, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃশ্যপট আলাদা। সেখানকার বেশির ভাগ শিক্ষার্থী আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারের। তারা সহজেই ইন্টারনেট সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। সবধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৩ মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীরা ক্লাস এবং পরীক্ষার অনিশ্চয়তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে। অলস সময় পার করছে এবং সেশন-জ্যাম নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা স্কুলে পড়াশোনা না করতে পারায় মানসিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। স্কুল কলেজ কখন খুলবে তা অনিশ্চিত। প্রধানমন্ত্রী বলছেন সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতে পারে। তাই বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চেষ্টা করছে ছাত্র-ছাত্রীরা যেন পিছিয়ে না যায়। তাই তারা সিলেবাস অনুযায়ী অনলাইনে পাঠ দানের ব্যবস্থা করা শুরু করেছে। শিক্ষকরাও বাসায় বসে রুটিন অনুযায়ী পাঠদান করছেন। বর্তমানে করোনার এই সঙ্কটকালে শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশকিছু স্কুলে অনলাইন পাঠদান শুরু হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছে এর রুটিনও পাঠানো হয়েছে। অনলাইনে দুভাবে পাঠদান করা হচ্ছে। একটি হলো ভিডিও কনফারেন্স, আরেকটি ফেসবুক লাইভ। আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত চলে এই ক্লাস। শিক্ষকরা ফেসবুক লাইভে পাঠদান করেন। ফেসবুকে প্রায় সবাই অভ্যস্ত। সেখানে শিক্ষার্থীরা প্রশ্নও করতে পারে। উত্তর দেয়া হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষকরা বাসা থেকে অথবা তার সুবিধামতো জায়গা থেকে অনলাইনে যুক্ত হচ্ছেন। এ বিষয়ে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, ‘এই জরুরী পরিস্থিতিতে আমরা টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের ব্যবস্থা করেছি। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অনলাইন এবং মোবাইল ফোন ব্যবহার করে পাঠদানের জন্য বলেছি। আমরা চেষ্টা করছি যাতে এই সময়ে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে না পড়ে।’ সংসদ টেলিভিশনে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠদান করা হচ্ছে। তবে এর মান নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, ‘উদ্যোগটি ভাল। কিন্তু আমাদের কোয়ালিটি পাঠদানের দিকে নজর রাখতে হবে। মানসম্পন্ন পাঠ তৈরি করতে হবে। আমাদের সমস্যা হলো, আগে আমাদের প্রস্তুতি থাকে না। আমরা হঠাৎ করেই কাজ শুরু করি। টেলিভিশনের পাঠের মান নিয়ে আমার কাছে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন’। অনলাইন টিচিং শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক সহজেই ক্লাস নিয়ন্ত্রণ এবং একইসঙ্গে সব শিক্ষার্থীর কাজ মূল্যায়ন করতে পারেন। শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে কম মনোযোগী শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করতে পারেন এবং তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ক্লাসে আকৃষ্ট করতে পারেন। তদুপরি, শ্রেণীকক্ষে লেকচারের সময় শিক্ষার্থীদের যে কোন প্রশ্ন কোন জটিলতা ছাড়াই সহজে উত্তর দেয়া যায়। কিন্তু শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরাসরি কথোপকথনের অভাবে অনলাইন ক্লাসকে সফল করা কঠিন হবে বলে মনে হচ্ছে। লক্ষণীয় আরেকটি বিষয় হলো, বাংলাদেশে অনেক শিক্ষার্থী এ জাতীয় ই-লার্নিংয়ে অভ্যস্ত নয়। শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের অনেক শিক্ষকই পুরনো পাঠদান পদ্ধতিকে বেশি পছন্দ করেন। এমনকি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও লেকচারে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন (পিপিটি) এবং মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করতে নারাজ। অনলাইন শিক্ষার মূল শর্ত হলো সব শিক্ষার্থীর জন্য ইন্টারনেট এবং অনলাইনে কোর্সের ডকুমেন্ট নিশ্চিত করা। এ সময়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কোর্সের ডকুমেন্ট আরও প্রাণবন্ত করা উচিত। এই সিস্টেমে ছাত্রদের টিমওয়ার্ক গঠন করে ব্রেনস্টর্মিং কঠিন। তারপরও আমাদের এই পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে হবে এবং অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। কর্তৃপক্ষ যদি অনলাইন পাঠদানের বাধ্যতামূলক নির্দেশনা দেয়, তবে অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থী ল্যাপটপ, ইন্টারনেটের অভাবে ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এ ছাড়া গ্রাম ও পার্বত্য অঞ্চলে আধুনিক প্রযুক্তিগত সুবিধার অভাব রয়েছে, যা অনলাইন শিক্ষার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে বিদ্যুতের বিঘ্নিত সরবরাহ অনলাইন শিক্ষার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধক। এখনও কিছু মানুষ বিদ্যুত সংযোগের বাইরে রয়েছে। অস্থিতিশীল বিদ্যুত সরবরাহ এবং দুর্বল বিদ্যুত-ব্যবস্থা অনলাইন শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করে। এটি বাংলাদেশের জন্য সাধারণ একটি চ্যালেঞ্জ। সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষের আন্তরিকভাবে এসব বিষয় বিবেচনা করা উচিত এবং শিক্ষা খাতের জন্য উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ সময়ের দাবি। দেশের উন্নয়নের জন্য মানসম্মত শিক্ষার বিকল্প নেই। লেখক : শিক্ষার্থী : অর্থনীতি (এমএসএস) [email protected]
×