ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

সংঘশক্তি দিয়ে রুখতে হবে অপশক্তিকে

নূরুর রহমান খান

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ৬ মে ২০২৪

সংঘশক্তি দিয়ে রুখতে হবে অপশক্তিকে

আমাদের প্রত্যাশা- বুয়েট, ডাকসুসহ সর্বত্র নির্বাচনের মাধ্যমে

আমাদের প্রত্যাশা- বুয়েট, ডাকসুসহ সর্বত্র নির্বাচনের মাধ্যমে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাণের সঞ্চার করা- প্রাণসংহার নয়। ছাত্ররাজনীতি অতীত ঐতিহ্যে সমুজ্জ্বল হয়ে নিজস্ব ধারায় প্রবাহিত হোক। সুতরাং রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়, কিভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রশাসনিক সহায়তায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখা যায় তা ভাবতে হবে

১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট অধিবেশনে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ও অরাজকতা নিরসনের উদ্দেশে ১১টি প্রস্তাব উপস্থাপিত হয়েছিল। প্রস্তাবগুলো কণ্ঠভোটে গৃহীত হলেও বাস্তবায়িত হয় মাত্র একটি। ফলে ১০ বছর পর আমানুল্লাহ আমানের নেতৃত্বাধীন ডাকসু সংসদ বিলুপ্ত করা হয়। এরপর দীর্ঘদিন ডাকসুর নির্বাচন হয়নি।

সংগঠন এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় ও ছাত্রাবাসগুলোর নেতৃত্ব নির্বাচনের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে। তাদের অনেকেই পরবর্তীকালে জাতীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। বঙ্গবন্ধু তার শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ। বঙ্গবন্ধুর সমকালীন এবং অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালে বহু ছাত্রনেতা জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তারা ছিলেন মেধাবী, অকপট। আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকে পথভ্রষ্ট অথবা সুবিধাবাদী হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছেন।

স্বাধীনতা উত্তরকালে কারও কারও চারিত্র্যিক স্খলন হয়েছে। এর পেছনে ক্যান্টনমেন্ট প্রসূত দল এবং এগুলোর প্রতিষ্ঠাতারা অর্থ, অস্ত্র এবং প্রশাসনিক সহযোগিতা দিয়ে তাদের হিংসাত্মক কর্মকা-ে উৎসাহিত করেছেন। তারা মেধার চেয়ে পেশিশক্তিকে উন্নতির সোপান হিসেবে কার্যকর মনে করেছে এবং কলম ছেড়ে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। এভাবেই হিজবুল বাহারে প্রমোদ ভ্রমণের সময় মেধাবী ছাত্র অভির হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে তাকে দুর্বৃত্তে রূপান্তরিত করা হয়েছিল।
ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত এবং সফল পরিণতি ছাত্রনেতাদের কল্যাণেই সম্ভব হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফাকে অন্তর্ভুক্ত করে ১১ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে সংগ্রামী ছাত্রসমাজের দুর্বার আন্দোলনে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ‘আগরতলা মামলা’ প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর সসম্মানে মুক্তির কৃতিত্ব ছাত্রদেরই প্রাপ্য। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অবিশ্বাস্য জয়ের মহানায়ক অবশ্যই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু তার মূল শক্তি ছিল ছাত্রলীগ।

বঙ্গবন্ধুও তাদের বুদ্ধি-পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন। ’৭০-এর প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বঙ্গবন্ধু দুর্গত এলাকায় উল্কার মতো ছুটে বেরিয়েছেন। দাঁড়িয়েছিলেন সর্বস্বহারা দুস্থ মানুষের পাশে- সঙ্গী ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।

শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, সৈয়দ মজহারুল হক বাকি, তোফায়েল আহমদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুর রাজ্জাক, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নুরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ ছাত্রলীগ নেতার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ’৭০-এর নির্বাচনে ভূমিকা না থাকলেও ছাত্র ইউনিয়নের মস্কোপন্থি মতিয়া চৌধুরী, সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, মাহফুজা খানম এবং চীনপন্থি রাশেদ খান মেনন ছিলেন উল্লেখযোগ্য ছাত্রনেতা।
বর্তমানে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে প্রকৃত ছাত্র নেই বললেই চলে। সেখানে স্থান পেয়েছে অছাত্র-কলুষিত ছাত্র রাজনীতি। ক্ষমতাসীন ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল মদতদাতা এবং ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় তাদের অমার্জনীয় অপরাধও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অদৃশ্য সহযোগিতা লাভে বঞ্চিত হয় না। পুলিশের বহু কর্মকর্তা পরিস্থিতির কারণে কর্তব্য পালন করতে গিয়ে অসহায় বোধ করেন। বিবেক এবং বাস্তবের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তাদের রক্তাক্ত করলেও ব্যর্থতার গ্লানি বহন করে একটা অপরাধবোধ নিয়ে জীবনের যবনিকা টানেন। 
কয়েক বছর আগে বুয়েটে প্রতিদ্বন্দ্বী দু’দল ছাত্রের গোলাগুলির মধ্যে সেখানকার শিক্ষার্থী সাবেকুন্নাহার সনি গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রাবাসগুলোতে দীর্ঘদিন নির্বাচন বন্ধ থাকার ফলে ছাত্রনেতৃত্বের বদলে মস্তান বাহিনী আধিপত্য বিস্তার করেছে। প্রশাসন তাদের অনুকূলে, কখনো অসহায়। জিয়া ও এরশাদের ক্ষমতাচ্যুতির পর তাদের সমর্থক ছাত্র সংগঠন দৃশ্যপটে নেই বললেই চলে। বিরোধী সংগঠনের অনুপস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে নিজেদের মধ্যেই উপদল সৃষ্টি ও ক্ষমতা প্রদর্শনের মহড়ায় লিপ্ত।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ বুয়েটে কি অকারণেই ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা হয়েছে? বুয়েটের একাধিক নবীন-প্রবীণ শিক্ষক এবং অন্তত ২০/২৫  শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপচারিতায় সুস্পষ্ট যে, সেখানকার ৯০% শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির ঘোর বিরোধী। সনির মৃত্যু দুর্ঘটনাজনিত হলেও আবরারকে অমানুষিক নির্যাতন করে হলের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে।

বুয়েটের চিহ্নিত দুর্বৃত্তদের হাতে র‌্যাগিং-বুলি এবং নির্যাতনের শিকার ছাত্রছাত্রীরা কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ করেও প্রতিকার পায়নি। সর্বশেষ আবরার হত্যাকা-ের পর তাদের টনক নড়ে এবং শিক্ষার্থীদের দাবির  মুখে বুয়েটে ‘সকল রকম ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ’ করে আইন প্রণয়ন করা হয়। ব্যাপারটা বিসদৃশই বটে।  মাথা ব্যথার দাওয়াই প্রয়োগ না করে গর্দান থেকে কল্লাটাই নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে ছাত্র রাজনীতি ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা সেটা নিষিদ্ধকরণের কথা উঠল কেন?

মুষ্টিমেয় শ্বাপদের  উপস্থিতিতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছে এবং এদের বুয়েট থেকে চিরতরে বহিষ্কার এবং বুয়েটে অবাঞ্ছিত বহিরাগতদের প্রবেশ বন্ধ করতে পারলে ছাত্ররাজনীতি  সুষ্ঠু ধারায় চলতে বাধা হওয়ার কথা নয়। এ ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক রাজনৈতিক দলগুলো। তারা ছলেবলে কৌশলে বুয়েটসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজেদের ছাত্র সংগঠনের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব সেখানেই। 
আবরারের ঘাতক ও সহযোগী দুর্বৃত্তরা বুয়েটে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অনেকে চামড়া বাঁচানোর জন্য হল ছাড়তে বাধ্য হয়। এমনকি বুয়েটে বেশ কিছুদিন এদের ছায়াও দেখা যায়নি। ফলে বুয়েটে শিক্ষা কার্যক্রম নির্বিঘেœ চলতে থাকে। কিন্তু ২৮ মার্চ মধ্যরাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও শীর্ষস্থানীয় কয়েক নেতা তাদের বিশাল কর্মীবাহিনী নিয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে।

উল্লেখ্য, ছাত্রলীগের সভাপতি, নেতা, পাতিনেতারা কেউই বুয়েটের ছাত্র নন। মিছিলের ৮/১০ জন ছাড়া সকলেই ছিল বহিরাগত। তাদের অনেকের ছাত্রত্ব নেই বলে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা দাবি করেছে। বহিরাগতদের অনাকাক্সিক্ষত প্রবেশকে কেন্দ্র করে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং বুয়েটে নিষিদ্ধ তৎপরতা চালানোর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা গত ৩০ ও ৩১ মার্চের পরীক্ষাসহ যাবতীয় শিক্ষা কার্যক্রম বর্জন করে।

বুয়েটের অশান্ত পরিবেশকে পুঁজি করে ভিন্নতর ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে রাজনীতি ব্যবসায়ী ফেরেববাজরা। বুয়েটে  জঙ্গিবাদের গন্ধ পাচ্ছেন অনেকে। এদিকে অনিবন্ধিত যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশ্য তৎপরতা এবং সোনারগাঁও হোটেলে স্বাধীনতাবিরোধীদের উপস্থিতিতে জমজমাট ইফতার পার্টির আয়োজন করে। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বিগত আট বছর দলের পক্ষ থেকে ইফতারের আয়োজন করতে পারেননি বলে তার মর্মযাতনা প্রকাশ করেন।

একই  সঙ্গে সকৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন ২০১৫ সালের ২৫ জুন হোটেল সোনারগাঁওয়ে জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত ইফতার মাহফিলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার অংশ নিয়ে। দেশ ও দশের কল্যাণে বুয়েটে খুনিদের প্রশ্রয়দানের আগে এদিকে ক্ষমতাসীন দলের মহারথীদের দৃষ্টি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। বুয়েটের বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ডাকসুর সাবেক ভিপি আখতারুজ্জামান এমপি উল্লেখ করেছেন যে, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল না। কর্তৃপক্ষ  নিশ্চয় কোনো বিশেষ কারণে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করেছেন। এটা সাময়িক সিদ্ধান্ত হলেও সার্বিক সমাধান নয়। বিষয়টি পর্যালোচনা করতে হবে। 
ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতা ইমতিয়াজ রাব্বির রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জারি করা বিজ্ঞপ্তি হাইকোর্ট স্থগিত করেন এবং ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে  রুল জারি করেছেন আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার ঘোষণা করেছে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা।

তাদের বক্তব্য, ‘যে রাজনীতি র‌্যাগিং কালচার প্রশ্রয় দেয়, শিক্ষার্থীদের বিপথগামী করে সে রাজনীতি কখনো ফলপ্রসূ হতে পারে না।’ বুয়েটের পরিবেশ ছাত্ররাজনীতিবিহীন অবস্থায়ই সর্বোচ্চ নিরাপদ ও  শিক্ষাবান্ধব। রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলমান থাকবে। 
এ সমস্যার সমাধান কোথায়? শুধু বুয়েট নয়, অনেক প্রতিষ্ঠানই এক ধরনের অরাজকতার সম্মুখীন। বুয়েটের উদাহরণ দিয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার চিন্তাভাবনা অর্বাচীন, বিকারগ্রস্তদের পক্ষেই সম্ভব। যে ছাত্ররাজনীতি প্রতিটি গণমুখী আন্দোলনের সূতিকাগার, এমনকি স্বাধীনতা উত্তরকালে স্বৈরাচার পতনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে সেই ছাত্ররাজনীতি বন্ধের প্রশ্নই আসে না।

সুতরাং ছাত্ররাজনীতিকে স্বীকার করেই বুয়েটসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কিভাবে কলুষমুক্ত করে শিক্ষাসহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়, সে পথই খুঁজে বের করতে হবে। বুয়েটসহ অন্যান্য শিক্ষাঙ্গনেও প্রকৃত ছাত্ররাজনীতি অনুপস্থিত। ছাত্র নেতৃত্বের বদলে কায়েম হয়েছে দুর্বৃত্তের রাজত্ব। মস্তিষ্কের স্থান দখল করেছে পেশিশক্তি। অলক্ষ্যে রয়েছে ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ কখনোবা পরোক্ষ সমর্থন। ক্ষমতাচ্যুত হলে তাদের ছাত্র সংগঠনের পা-াদের হল ছেড়ে উধাও হওয়ার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছি এরশাদ ও খালেদা জিয়া সরকারের পতনের পর। অনুরূপ অবস্থায় ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দও ‘যঃ পলায়তে স জীবতি’ পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল। 
যেভাবেই হোক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বাঁচাতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের জীবন নিরাপদ রাখতে হবে। এর অন্যতম উপায় ছাত্রনেতৃত্বে প্রকৃত শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা। হল থেকে বহিরাগতদের বহিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিতে হবে। এসব প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য অত্যাবশ্যক নির্বাচন। বুয়েটে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ আছে কি না জানা নেই। এক সময় প্রায় নিয়মিত ডাকসু এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর নির্বাচন হতো। তারপর অনিয়মিত হতে হতে নির্বাচন এখন প্রায় বন্ধ।

বর্তমানে হল নিয়ন্ত্রণ করছে ক্ষমতাসীনদের প্রশ্রয়ে ছাত্র নামধারী মস্তান গ্রুপ। তাদের হাত থেকে মুক্তি লাভের জন্য ডাকসু, বুয়েটসহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ও হল সংসদের নির্বাচন জরুরি। এতে একদিকে ছাত্রনেতৃত্ব গড়ে উঠবে, অন্যদিকে দুর্বৃত্তদের প্রস্থানও নিশ্চিত হবে। সরকার ও প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ না হয়, তাহলে সকলি গরল ভেল। সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কি চায়। 
এক সময় ডাকসু নির্বাচন কিছু ব্যত্যয় ব্যতীত প্রায় নিয়মিত হতো। প্রাক-স্বাধীনতা আমল থেকে নির্বাচন অনিয়মিত হয়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর থেকে তা কলুষিত হতে থাকে। এর সূচনা ১৯৭৩-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগ মনোনীত আ ফ ম মাহবুবুল হকের নেতৃত্বাধীন প্যানেলের জয়লাভের সুনিশ্চিত সম্ভাবনা দেখে হলে হলে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা হয়।

আমানুল্লাহ আমান প্রায় ৮/১০ বছর সপার্ষদ ডাকসুতে জেঁকে বসেছিল এবং তখন তারা নিয়মিত ছাত্রও ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনে প্রস্তাবের মাধ্যমে সেই সংসদ বাতিলের সম্ভবত ২৮ বছর পর উপাচার্য ড. আখতারুজ্জামানের সময় ডাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনও যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না, তার প্রমাণ ছাত্রতাড়িত ধাবমান ভীতসন্ত্রস্ত নির্বাচন কমিশনারের ভয়ার্ত মুখাবয়ব। তবু ড. আখতারুজ্জামানের কৃতিত্ব, বিতর্কিত হলেও নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি অচল ডাকসুকে সচল করতে চেয়েছিলেন। 
আমাদের প্রত্যাশাÑ বুয়েট, ডাকসুসহ সর্বত্র নির্বাচনের মাধ্যমে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাণের সঞ্চার করা,  প্রাণসংহার নয়। ছাত্ররাজনীতি অতীত ঐতিহ্যে সমুজ্জ্বল হয়ে নিজস্ব ধারায় প্রবাহিত হোক। সুতরাং রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়, কিভাবে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রশাসনিক সহায়তায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখা যায় তা ভাবতে হবে। এ জন্য নিম্নোক্ত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক-
১. কোনো বহিরাগত বা অছাত্র হলে থাকতে পারবে না।
২. নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারিসহ কোনো কাজকর্মের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা জড়িত হবে না।
৩. আটাশোর্ধ্ব কোনো ছাত্র ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে। কিন্তু নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না। একজন নিয়মিত শিক্ষার্থীর ১৭ বছর বয়সে মাধ্যমিক, ১৯ বছরে উচ্চ মাধ্যমিক, ২৩ বছরে স্নাতক সম্মান এবং ২৪ বছর বয়সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের কথা। নানা কারণে শিক্ষাজীবনে ছেদ পড়তে পারে। সে জন্য অতিরিক্ত আরও চার বছর ছাড় দেওয়া হলেও আটাশ বয়শোর্ধ্ব কারও ছাত্রত্ব থাকার কথা নয়।

নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার উদ্দেশে নৈশ কোর্স অথবা অন্য কোনোভাবে শুধু নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে ৬/৯ মাস অথবা ১ বছরের কোনো সার্টিফিকেট কোর্সে নাম লেখানো পেশাদার ছাত্র অর্থাৎ ‘আদু ভাই’দের হাত থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে হবে।
৪. কোনো শিক্ষার্থীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভয় দেখিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে জোর করে মিটিং-মিছিলে নেওয়া যাবে না। 
৫. নির্বাচিত সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কার্যক্রম স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্থগিত হয়ে যাবে।
৬. সর্বশেষ পরীক্ষা সমাপ্তির এক মাসের মধ্যে হল ছাড়তে হবে। অকৃতকার্য হলে পুনরায় ভর্তি হয়ে নিয়মানুযায়ী হলে সিট লাভের জন্য আবেদন করতে হবে। 
লেখক : প্রাক্তন অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

×