ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খুররম মমতাজ

সেই রাশিয়া

প্রকাশিত: ১৯:৫৬, ১২ জুন ২০২০

সেই রাশিয়া

পূর্ব প্রকাশের পর সেলিমের বয়স দশ বছর, ওর হাতে জ্বলন্ত তারাবাতি। অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শেষে সে তারাবাতিটা ছুঁড়ে দিল জামগাছের দিকে। গাছের উঁচু ডালে আটকে গেল তারাবাতি। তারপর দেখা গেল অলৌকিক এক দৃশ্য- সারা গাছ থেকে ঝরছে আলোর ফুলঝুরি...! পরদিন চারপাশ বরফে বরফময়! হোস্টেলের সামনে এক হাঁটু বরফ। রাস্তা থেকে বরফ সরানো হচ্ছে। বাকুতে এত বরফ সবসময় পড়ে না, এবার ব্যতিক্রম। ইন্সটিটিউট দু’দিন বন্ধ ঘোষণা হলো। আমরা বরফের ময়দানে ঘুরতে বেরোলাম। ঘোরাঘুরি শেষে নিজেদের মধ্যে বরফের বল ছোঁড়াছুঁড়ি চলছিল, পরে পেরুর কয়েকটা ছেলেমেয়ে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। ওদের মধ্যে তানুশকা নামে একটা মেয়ে ছিল, তাকে দেখতে অনেকটা বাঙালির মতোই লাগে। সে আমাদের সহপাঠি, তার সঙ্গে আমার কিছুটা বন্ধুত্বও হয়েছে। তার আসল নাম ভালেরিয়া, কিন্তু ক্লাসের সবাই তাকে ডাকে তানুশকা। রুশ ভাষা শেখার ক্লাসে টিচার মাঝে মাঝে ছোট ছোট নাটকের মতো করান আমাদের দিয়ে। যেমন, হয়তো শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছে, অথবা দুই বন্ধুতে সিনেমা দেখতে যাওয়ার প্ল্যান করছে। ক্লাসের সবাইকেই এতে অংশ নিতে হয়। এরকম একটা ডায়ালগে আমি আর ভালেরিয়া অংশ নিয়েছিলাম, আমি হয়েছিলাম ইগর, ভালেরিয়া করেছিল তানুশকার পার্ট। সেই থেকে সে তানুশকা। ইগর তানুশকাকে বলছে, ‘তানুশকা, একটা ভালো মুভি চলছে। দেখতে যাবে?’ তানুশকার জবাব, ‘যেতে পারি। মুভিটা কী নিয়ে, নাম কী?’ - ‘ট্রেজার আইল্যান্ড...’ - ও! বইটা আমি পড়েছি। - আমারও পড়া। খুব ভালো বই। - হ্যাঁ সত্যি, ভীষণ ভালো বই। দারুণ অ্যাডভেঞ্চার... - চলো, দেখতে যাই। - আজকে পারবো না, আজকে আমি খুব ব্যস্ত। উইক এন্ডে দেখা যায়। - বেশ, তাহলে উইক এন্ডেই যাবো আমরা। কথা থাকলো। - ঠিক আছে, বাই ইগোর। - বাই তানুশকা। বাস্তবে তানুশকার সঙ্গে আমার মুভি দেখা হয়নি কখনো। তবে আমরা বাঙালিরা ঘরোয়া অনুষ্ঠান করলে দু’একবার এসেছে ও আমাদের অনুষ্ঠানে। ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা শহীদ দিবস পালন করলাম আমরা কাজি শফিকের উদ্যোগে। বাকুতে শহীদ মিনার কোথায় পাবো? আর্ট পেপার কেটে শহীদ মিনারের ছোট একটা মডেল তৈরি করেছিলেন শফিক ভাই, তার সামনেই ফুল দেওয়া হলো। কালো ব্যাজ পরে তানুশকাও ফুল দিলো আমাদের সঙ্গে। শফিক ভাইয়ের রুমেই কবিতার আসর বসলো, খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ছিল, পরে ফুলগুলো মেয়েদের গিফট দেওয়া হলো বিদায়ের সময়। আমিও একটা কবিতা পড়লাম। প্রথম দুটো লাইন ছিল এরকম- ‘নীল শব্দের ঢেউ তুলে একটা অ্যাম্বুলেন্স ছুটে গেল / অথচ ফাল্গুনে অনেক কৃষ্ণচূড়া ফোটার কথা...।’ ভাষা তো মানুষের জন্মের অধিকার, এর জন্য আবার জীবন দিতে হবে কেন! খুব অবাক হয়েছিল তানুশকা। আমাদের রুশ ভাষা শেখাতেন মীরা হাসানোভনা নামে এক মহিলা। এই মহিলাকে আমি আজও ভুলতে পারিনি। তিনি শুধু ভাষাই শেখাননি আমাদের, তাঁর মধ্যে একজন জননীকেও পেয়ে গেলাম আমরা। খাবার-দাবার থেকে শুরু করে হোস্টেলের যে কোনো সমস্যার কথা আমরা তাঁকে বলতাম, তিনি দ্রুত সমাধান করে দিতেন। একদিন ক্লাসে পুশকিন আবৃত্তি করছেন মীরা, মৃদু কন্ঠে। কান খাড়া করে শুনেও কিছুই বুঝতে পারলাম না। তখন কেবলি রুশ ভাষার ক্লাস শুরু হয়েছে। তিনি হেসে বললেন, ‘আমি জানি তোমরা বুঝতে পারবে না। কিন্তু পুশকিন কেউ পড়েছ তোমরা?’ সবাই চুপ। পুশকিন খুব বড় কবি- আমাদের যেমন রবীন্দ্রনাথ, রাশানদের তেমনি পুশকিন- আমি সেটা জানতাম, তবে তার কোনো কবিতা আমার পড়া ছিল না। কিন্তু ঢাকায় আমাদের বাসায় পুশকিনের একটা উপন্যাস ছিল- ‘ক্যাপ্টেনের মেয়ে’। সেটা আমার পড়া। অনেকদিন আগে পড়লেও উপন্যাসটা আমার মনে এমনভাবে দাগ কেটেছিল কিছু কিছু ঘটনা এখনো মনে আছে। আমি হাত তুললাম। মীরা কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী পড়েছ?’ এবার বিপদে পড়লাম- রুশ ভাষায় আমার বিদ্যার যা দৌড়, তাতে কীভাবে উপন্যাসের নামটা বলবো বুঝতে পারছিলাম না। পাশে বসা আলাউদ্দিনের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা...উপন্যাসের নাম ‘ক্যাপ্টেনের মেয়ে’...এটাকে রুশ ভাষায় কীভাবে বলবো?’ এই প্রশ্নের উত্তর আলাউদ্দিনেরও জানা নাই। কিন্তু মীরা কান খাড়া করে ছিলেন। আমি ‘ক্যাপ্টেনের মেয়ে’ উচ্চারণ করা মাত্রই তিনি বুঝে ফেললেন। এক মুখ হেসে ঝট করে বললেন, ‘বুঝেছি। কাপিতানস্কায়া দোচকা...।’ সেদিন থেকে মীরা হাসানোভনার প্রিয় ছাত্র হয়ে গেলাম আমি। কিছুদিন পর আমরা যখন রুশ ভাষা কিছুটা শিখেছি তখন একদিন ক্লাসে ফট করে শক্তি মীরাকে বলে দিল, ‘জানেন ম্যাম, ও ইয়েসেনিনের কবিতা অনুবাদ করছে, বান্ধবীকে পাঠাবে...।’ বলেই আমার দিকে তাকিয়ে খিক খিক করে হাসতে লাগলো। শক্তি ঐরকমই, একটু ফাজিল টাইপ। খুব বকবক করতো, আবার হয়তো ক্লাসের মাঝখানেই কোনো অপ্রাসঙ্গিক কথা হঠাৎ বলে বসলো। তবে ওর একটা গুণ ছিল। ভুল-শুদ্ধ যাই হোক পরোয়া করতো না শক্তি, ফরফর করে রুশ ভাষায় কথা বলতো। মীরা এজন্যই ওকে স্নেহ করতেন। বলতেন নতুন ভাষা শেখার জন্য এটা খুব দরকারি গুণ। শক্তির বকবকানির কারণে মীরা আদর করে ওর নাম দিয়েছিলেন ‘বাচাল’। শক্তি কোনো কারণে অনুপস্থিত থাকলে মীরা বলতেন, ‘আমার বাচাল কই? আজকে আসেনি কেন?’ তবে বান্ধবীর কথাটা পুরোপুরি ঠিক না। আসলে তখন পেনফ্রেন্ড বানানোর একটা হিড়িক ছিল। আমিও ‘বিচিত্রা’ ম্যাগাজিন থেকে একটা মেয়ের নাম-ধাম নিয়ে চিঠি লিখেছিলাম। মেয়েটার নাম ছিল মেগান। সেই সময় নামটা একটু অন্যরকম লেগেছিল, এমন নাম আগে শুনিনি, তাই হয়তো আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল। মেয়েটাও উত্তর দিয়েছিল, এই পর্যন্তই। অনুবাদের কথাটা সত্যি। কিন্তু তখনো রুশ কবি-সাহিত্যিকদের লেখা গল্প-কবিতা-উপন্যাস রুশ ভাষায় পড়তে পারার মতো যথেষ্ট ভাষাজ্ঞান আমাদের হয়নি। সের্গেই ইয়েসেনিনের একটা কবিতার বই পেয়েছিলাম, বাঁদিকের পাতায় রুশ ভাষা, ডানে ইংরেজি- এভাবে সমান্তরাল টেক্সট। সেখানে একটা কবিতা ভালো লেগেছিল। সেটাই অনুবাদ শুরু করেছিলাম। মেগানকে পাঠানোর কথা ভাবিনি- এটা শক্তির ফাজলামি। যাই হোক, এতে আমার লাভ হলো- আমিও শক্তির মতো একটা নাম পেয়ে গেলাম মীরার কাছ থেকে, বাড়তি একটু স্নেহও যোগ হয়ে গেল তাতে। মীরা আমাকে আদর করে ডাকতে লাগলেন ‘গোল্ডেন বয়’। নামটা শুনে আমার হাসি এককান থেকে অন্য কানে গিয়ে ঠেকলো। কাবুস্তানের কুমারী টাওয়ার দেখতে দেখতে শীতের ছুটি এসে গেল। ছুটিতে মীরা আমাদের নিয়ে গেলেন কাবুস্তান নামে একটা জায়গায়। জায়গাটা কাস্পিয়ান সাগরের তীরে। একটা দুর্গ আর প্রাচীনকালের কিছু ঘরবাড়ি আছে সেখানে। দুর্গের উঁচু টাওয়ার দেখিয়ে মীরা বললেন, ‘এর নাম কুমারী টাওয়ার।’ ‘কুমারী টাওয়ার কেন?’ শক্তি প্রশ্ন করলো। ‘কারণ এখানে আত্মাহুতি দিয়েছিল কুমারী এক মেয়ে।’ গল্পের আভাস পেয়ে সবাই একটু চুপ করলে উপকথাটা বললেন মীরা। বহুকাল আগে এখানে বাস করতো কাবুস্তানের রাজা। তার ছিল রূপসী এক মেয়ে লুদমিলা। ভিনদেশি রাজা আক্রমণ করে এই রাজ্য। তুমুল যুদ্ধ শেষে পরাজিত হলেন এখানকার রাজা। বিজয়ী সৈন্যরা দুর্গ লুট করতে শুরু করলে রাজকন্যা এসে আশ্রয় নিল উঁচু ঐ টাওয়ারে, লুকিয়ে থাকলো টাওয়ারের চূড়ায় ছোট্ট ঘরটাতে। একটু পরে সে টের পেল সৈন্যরা উঠে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। রাজকন্যা জানালার ধারে এসে দাঁড়ালো। দেখলো কয়েকশো ফিট নিচে টাওয়ারের গোড়ায় এসে আছড়ে পড়ছে সাগরের ঢেউ। সৈন্যরা দরজা ভেঙে ঢোকা মাত্রই সে জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিল কাস্পিয়ানের নীল জলে। সেই কুমারীর সম্মানেই টাওয়ারের নাম ‘কুমারী টাওয়ার’। ...ঐ যে সেই জানালা। আঙুল তুলে দেখালেন মীরা। দেখলাম অনেক উঁচুতে ছোট্ট একটা জানালা। তাহলে ওখান থেকে লাফ দিয়েছিল লুদমিলা, অত উঁচু থেকে! ভয় করেনি? নিচে এখানে পানিও তো নাই। এইসব ভাবছি, শক্তিই আবার প্রশ্নটা করলো, ‘এখানে কাস্পিয়ান কোথায়? জল তো বেশ কিছুটা দূরে।’ ‘আগে এখানেই ছিল কাস্পিয়ান,’ মীরা জবাব দিলেন, ‘ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে দূরে সরে গেছে উপকূল।’ উজ্জ্বল একটা দিন, ঝলমল করছে সৈকত। ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই ছড়িয়ে পড়লো এদিক ওদিক। দুর্গের ভিতরে গেল একটা দল। কেউ কেউ দল বেঁধে গোল হয়ে বসলো বালুর উপরে। রোদে তেজ নেই, আছে শীতের আমেজ। আমি দেখলাম একটু দূরে সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটছে তানুশকা। তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করছো এখানে একা একা?’ ‘একা নাতো, এই যে তুমি আছো আমার সঙ্গে। ফ্রেশ বাতাস খাচ্ছি’ বলে হাসলো তানুশকা। ‘কুমারি টাওয়ারের গল্পটা তোমার কেমন লাগলো?’ ‘সুন্দর উপকথা। তবে খুব করুণ।’ ‘ঠিক বলেছো, খুব করুণ।’ সমুদ্রের দিক থেকে বাতাস আসছে। বাতাসে তানুশকার চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ওর মাথায় সবুজ একটা উলের ক্যাপ ছিল, সেটা এখন ওভারকোটের পকেটে গোঁজা। ওভারকোটের কলার উল্টে যাচ্ছে, ওর গালে লেপ্টে যাচ্ছে কালো চুল। বাঁ হাতে বারবার চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছে তানুশকা। আমি বললাম, ‘আমাদেরও এরকম একটা উপকথা আছে, জানো?’ ‘তাই নাকি! বলো তো শুনি।’ বাঁ হাতে চুলগুলো চেপে ধরে ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকালো তানুশকা। ওর চোখ দুটো আমাদের পাহাড়ি মেয়েদের মতো- একটু চেরা চেরা আর উজ্জ্বল। ঈগলের পাখার মতো ভুরু। আমি ওকে মহাস্থানের উপাখ্যানটা বললাম। বগুড়ায় আমার নানিবাড়ি, অনেকবার গেছি মহাস্থানে, নানির মুখে অনেকবার শুনেছি গল্পটা ছোটবেলায়। সেই উপকথাটা আমি বললাম তানুশকাকে। পরশুরামের রাজ্য আক্রমণ করেছিল ভিনদেশি সুলতান শাহ বলখি। পরশুরামের সৈন্যরা প্রাণপন লড়াই করেও হেরে যাচ্ছিল। দলে দলে মারা যাচ্ছিল তারা। কিন্তু মহাস্থানে ছিল অলৌকিক এক কুয়া, কুয়ার ভিতরে ছিল মৃত সঞ্জিবনী পানি, এই পানি মৃতকে জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে। মরা সৈন্যদের পায়ে দড়ি বেঁধে কুয়ার পানিতে চুবানো হতো। চুবানো মাত্রই সৈন্যরা আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠতো, ঢাল-তলোয়ার নিয়ে চলে যেতো যুদ্ধের মাঠে। মৃত্যুঞ্জয়ী এই বাহিনীকে কিছুতেই পরাজিত করতে পারছিল না বহিরাগত সৈন্যরা। (চলবে)
×