ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

মুখোমুখি এস্থার ও অভিজিত

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ১২ এপ্রিল ২০২০

মুখোমুখি এস্থার ও অভিজিত

অর্থনীতিবিদ অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো। অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন ২০১৯ সালে। স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে নোবেল পাওয়ার ঘটনা বিরল। কোন তত্ত্ব নয় বরং গবেষণা পদ্ধতির উন্নয়ন ও প্রভাব বিবেচনায় তারা নোবেল পেয়েছেন। বর্তমান বৈশ্বিক মহামারী নিয়ে এ দুজন অর্থনীতিবিদের কথোপকথনের অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো- অভিজিত : আমরা এখানে এসেছি বিশ্বের অর্থনীতির উপর কোভিড ১৯-এর প্রভাব, আর তা নিয়ে আমরা কী করতে পারি, সে বিষয়ে কথা বলার জন্য। আমি এস্থারকে কিছু প্রশ্ন দিয়ে শুরু করছি। এস্থার, এখনকার সব চাইতে বড়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা কী? আমি দুটো উত্তর চাইছি। একটা এখনকার জন্য, একটা ভবিষ্যতের জন্য। এস্থার : এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মানুষের জীবন বাঁচানো, অদূর ভবিষ্যতে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে তাদের কাজে ফেরানো। তার পরবর্তী সময়ের সমস্যা, স্বাভাবিক অর্থনীতিতে ফিরে যাওয়া। আজ আমরা প্রাণ বাঁচাতে যা করছি, তার পরিণাম বড় হতে হতে যেন ভবিষ্যতে জীবিকা হারানোর কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, তা দেখতে হবে। অভিজিত : তা হলে এ বিষয়ে কী করা উচিত মনে হয়? এস্থার : এই মুহূর্তে আমরা চিকিতসকের কথা শুনতে পারি, তা বোঝার চেষ্টা করতে পারি। আমরা জানি, পরিস্থিতি খারাপ, আমাদের হাতে নিরাময়ের উপায় নেই, যে বলবে সে এই অসুখ সারাতে পারে সে মিথ্যে বলছে। লোকে নিরাময়ের উপায় খোঁজার চেষ্টা করছে, কিন্তু তা পেতে সময় লাগবে। এখন আমাদের হাতে একটাই উপায়, নিজেদের আলাদা রাখা। আর যা করতে পারি তা হলো বার বার হাত ধোয়া, ভাল পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা, যাতে সংক্রমিত লোকের সংস্পর্শে এলেও রোগ না ছড়ায়। অভিজিত : যত দূর দেখা যাচ্ছে, তাতে এমন একটা অস্বাভাবিক জীবনযাপন করা কি মানুষের পক্ষে সম্ভব? কত দিন এমন চলবে? লোকে কাজ করছে না, রোজগার বন্ধ, বাইরে বেরোচ্ছে না, প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত হচ্ছে না। ৬ মাস ধরে এমন চলবে, তা ধরে নেয়া কি বাস্তবসম্মত? তোমার কি মনে হয় না যে এর বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে? এস্থার : দু’সপ্তাহই চালানো কঠিন। ৬ মাস যে এমন চলতে পারে না তা প্রায় নিশ্চিত। ভাইরাস যে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে, তার উপরে রয়েছে অনিশ্চয়তার দ্বারা তৈরি অনিশ্চয়তা। এ বার আমি তোমাকে প্রশ্ন করি, তুমি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকতে, তা হলে তুমি কবে থেকে কার্ফু শুরু করতে, এত রকম নিষেধ-নিয়ন্ত্রণ চালু করতে? অভিজিত : এটা কঠিন প্রশ্ন। মডেল বলছে পাঁচ মাস, কিন্তু তা দাঁড়িয়ে রয়েছে এমন সংখ্যার উপর, যা লোকে প্রায় হাওয়া থেকে তুলে এনেছে। পাঁচ মাসের সম্পূর্ণ ঘরবন্দী দশা ভাবতেই ভয় লাগে, আরও সংক্ষিপ্ত একটা পরিসরে সবকিছু বন্ধ রাখা আরও বাস্তবসম্মত মনে হয়, যাতে সংক্রমণের শীর্ষটা অতিক্রম করে ফেলা যায়, আর চেষ্টা করা যাতে শীর্ষেও (সংক্রমণের) সংখ্যাটা খুব বেশি না হয়। সবকিছু বন্ধ রাখার পরিসরকে আরও সংক্ষিপ্ত আর যথাযথ সময়ে রাখা। ক্ষমতার আসনে থাকলে কী সিদ্ধান্ত নিতাম বলা মুশকিল, কারণ তাতে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে কিছু লোককে মারা যেতে দিতে হবে। সব বন্ধ করতে কিছু বিলম্ব করলে বেশি মানুষ মারা যেতে পারে। আবার অন্যদিকে, লোকের ওপর বাড়িতে বসে থাকার, সবকিছু বন্ধ রাখার জন্য চাপ তৈরি করলে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। কারণ পাঁচ মাস সব কিছু বন্ধ থাকলে লোকে মনে করবে, নীতি তৈরির কোন কেন্দ্রই আর কাজ করছে না। এক দিকে মানুষের প্রাণ বাঁচানো, আর অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার বিপুল প্রশাসনিক ব্যয় ও অর্থনীতির প্রবল ক্ষতি, এই দুটোর কোন একটার দিকে পাল্লা ভারি হবে। প্রাণ বাঁচানোর কাজে একটু খারাপ করলে অর্থনীতিকে বাঁচানোর কাজটা হয়ত একটু সহজ হতে পারে। কিন্তু ফিরে গিয়ে প্রশ্ন করা যায়, এখানে যে বিশেষ একটা মডেল কাজ করছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছি কী করে? সবটাই নির্ভর করছে কতজনের সংক্রমণ হলো আর তার কতজনের মধ্যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যদি অনেক সংক্রমিত লোক লক্ষণহীন হয়, তা হলে আমরা হয়ত সমষ্টিগত প্রতিরোধক্ষমতার অনেক কাছাকাছি আছি, যতটা ভাবছি তার চাইতেও। বিশেষত যদি সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা দশ কোটির কম না হয়। এস্থার : সংক্রমিতের সংখ্যা পাওয়া কঠিন। আমরা কি মৃত্যুর সংখ্যাই জানি? আমরা জানি না, কারণ তা নির্দিষ্টভাবে গোনার উপায় নেই। আমি যে দেশের লোক, সেই ফ্রান্সে কেউ বাড়িতে মারা গেলে তাকে সংক্রমণ থেকে মৃতদের মধ্যে গোনা হয় না। হাসপাতালে মারা গেলে তবেই গোনা হয়। অভিজিত : গোনাই হয় না ... ভারতে বৃদ্ধদের রোগ হয়ত নির্ণিতই হবে না। এস্থার : ফ্রান্সেও আমরা জানি না কতজন মারা গিয়েছে, এবং সংক্রমিতের সংখ্যাও আমরা অনেক কম ধরছি। আমরা জানি না সংক্রমিত মানুষদের মধ্যে মৃত্যুহার কত। মৃত্যুহার দেশ থেকে দেশে অনেকটা তফাত হয়ে যায়। ইউরোপের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, সুইডেনে মৃত্যুহার মাত্র ০.৫ শতাংশ, আবার ইতালিতে ১০ শতাংশ। কেন এই তফাত হচ্ছে, তা বোঝার উপরেই সবকিছু নির্ভর করছে। সুইডেনে নমুনা পরীক্ষার দ্বারা গোটা জনসংখ্যায় সংক্রমণের হার পরীক্ষা করা হচ্ছে, যেখানে ইতালিতে যাঁরা আসছেন হাসপাতালে, কেবল তাঁদেরই পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাই এমন হতে পারে যে, ইতালিতে অধিক অসুস্থদের বেশি পরীক্ষার জন্য জনসংখ্যায় সংক্রমণে মৃত্যুহার বেশি আসছে। আবার এমনও হতে পারে যে, এই মৃত্যুহার ইতালিতে মন্দ চিকিতসাব্যবস্থার প্রতিফলন, অসুস্থদের চিকিতসা ভাল হচ্ছে না বলে মৃত্যুহার বেশি হচ্ছে। এই ধারণার মূলে কিছু সত্য আছে ইতালিতে যথেষ্ট হাসপাতাল বা বেড নেই। অভিজিত : ভারতের কী হবে? এস্থার : আমিই তোমাকে জিজ্ঞেস করব ভাবছিলাম। অভিজিত : ভাল খবর হলো, ভারতে খুবই অল্প বয়সী লোকদের দেশ, গড় বয়স আটাশের আশপাশে। তবে ভারতে ভেন্টিলেটর নেই। এস্থার : হ্যাঁ, ভেন্টিলেটর নেই, যা ভারতের পক্ষে ভয়ের কারণ। অভিজিত : ভারতজুড়েই। এস্থার : একটা প্রশ্ন, আমাদের পরীক্ষা করার সরঞ্জাম চাই। এগুলি তৈরি করার ভাল জায়গা হতে পারে ভারত। অভিজিত : স্বত্বাধিকারের প্রশ্নের আগে নিষ্পত্তি করতে হবে। কাউকে আগে ওই অধিকার কিনে নিতে হবে। এখানে রইল এক শ’ কোটি ডলার। যে কেউ এটা তৈরি করতে পারে। এটা স্বত্বাধিকার কিনে নেয়ার আদর্শ পরিস্থিতি। এস্থার: ফেরা যাক অর্থনীতির বিশ্বে। আমরা দেখছি, জীবন আর জীবিকায় একটা সংঘাত হচ্ছে। এইটা আমার কাছে সব চাইতে পীড়াদায়ক মনে হচ্ছে। তোমার কী মনে হয়? অভিজিত : আমার মনে একটা সংঘাত কাজ করছে। সব চাইতে জরুরী বোঝায় যে, মানুষ অনির্দিষ্টকালের জন্য এটা মেনে নেবে না। এমনকী সরকার বিনা পয়সায় রেশনে চালগম দিলেও সেই ব্যবস্থা পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হবে না ৬ মাস ধরে বিনা পয়সায় খাবার দিলে মানুষ তা গ্রহণ করবে না। আরও ভাল জীবনযাত্রায় মানুষ অভ্যস্ত। দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবস্থাটা চালিয়ে যাওয়া হলো প্রধান কথা। লকডাউন হয়েছে অল্প সময়ের জন্য, এবং সেটাই বাস্তবসম্মত। আশা করা যায় এর ফলে সংক্রমণ ছড়ানোর গতি কিছুটা কমবে। তারপর মানুষকে মুক্তি দিতে হবে। এবং কৌশলকে আরও সূচীমুখ করতে হবে, রোগের প্রধান কেন্দ্রগুলো চিহ্নিত করা ইত্যাদি উপায়ে। আন্দাজ হয়, ৬ মাস এই যুদ্ধ চলবে, হয়ত খুব বেশি প্রাণক্ষয় হবে না। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির পতন হবে। ধনী দেশগুলো বাইরে থেকে কেনা বন্ধ করে দেবে। এটা একেবারে পরিষ্কার। আমরা এক বিপুল মন্দা দেখব। কারও মনে হতে পারে, এটা কি মন্দা? ধনী তো তার আয় হারাচ্ছে না, মধ্যবিত্ত বাড়ি হারাচ্ছে না, কিছু দিন একটু ঢিলে যাবে তারপর লোকে আবার কেনা শুরু করবে। আমার মনে হয় এটা হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশ কমছে। শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। মধ্যবিত্তের আয় কমেছে। এই সময়ের পরে ক্রেতারা উতসাহের সঙ্গে জিনিসপত্র কিনবে, তার আশা কম। তাই আমাদের প্রয়োজন এমন নীতি যা এই ব্যবস্থাটাকে চালু রাখবে। চাহিদাকে ফের চাঙ্গা করবে। কারণ মানুষের আয় এত কমবে, এত সম্পদ তারা হারাবে, যে হাতে যা আছে তা তারা খরচ করতে চাইবে না। হাতে রেখে দিতে চাইবে। এটাই হলো প্রধান উদ্বেগ। এটা কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের পরিস্থিতি, যখন মানুষ নয়া উদ্যমে কেনাকাটা করবে, না কি ২০০৯ সালের সঙ্কট চলাকালীন পরিস্থিতি, যখন মানুষ খরচ করতে ভয় পাবে? এর উত্তর আমার জানা নেই। কিন্তু আমি তমন আশাবাদী নই। যদি যা ভয় পাচ্ছি তা-ই হয়, তা হলে আরও বেশি করে ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। আমি মনে করি ভারত থেকে আমরা একটু বেশিই সাবধানী, সংরক্ষণশীল থাকছি। তেলের দাম এখন কম। অনেক টাকা ছাপানো হোক, মূল্যস্ফীতির ভয় না করে। এস্থার : প্রশ্ন হলো, টাকাটা কী করে মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়। অভিজিত : সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ হলো একটু বেপরোয়া হওয়ার সময়। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×