ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নেতৃত্ব ছাড়ার কারণ হিসেবে মাশরাফি জানালেন পরবর্তী বিশ্বকাপ পরিকল্পনার কথা

‘এক্ষুণি সেরা অধিনায়ক বেছে নিতে হবে’

প্রকাশিত: ১০:৪২, ৬ মার্চ ২০২০

‘এক্ষুণি সেরা অধিনায়ক বেছে নিতে হবে’

স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ আজই সমাপ্ত হবে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার পথচলা। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ওয়ানডেতে শেষবারের মতো বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেবেন তিনি। বৃহস্পতিবার সিলেট আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে সংবাদ সম্মেলনে নিজেই জানিয়েছেন সে কথা। এরপর শুধুই খেলোয়াড় হিসেবে চালিয়ে যাবেন ক্রিকেট খেলা। দেশে-বিদেশে অনেক ভেন্যুতেই বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ৮৭ ওয়ানডে, ২৮ টি২০ ও ১ টেস্টে বাংলাদেশ দলের অধিনায়কত্ব করেছেন। তবে এই সিরিজেই প্রথমবার দলকে নেতৃত্ব দিতে নেমেছিলেন সিলেটে, সেখানেই নেতৃত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিলেন তিনি। কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছেন, আগামী বিশ্বকাপের আগেই যেন বাংলাদেশ দল উপযুক্ত নেতৃত্ব খুঁজে পায় সে জন্যই অধিনায়কত্ব ছেড়েছেন তিনি। আর এই ম্যাচেই একটি দারুণ মাইলফলকের সামনে দাঁড়িয়ে মাশরাফি। আজ জিম্বাবুইয়েকে হারাতে পারলেই একমাত্র বাংলাদেশী অধিনায়ক হিসেবে এবং ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে বিশ্বের ২৫তম অধিনায়ক হিসেবে দলকে ৫০ ওয়ানডে জয়ে নেতৃত্ব দেয়ার বিরল কীর্তি গড়বেন তিনি। ইতোমধ্যে ৮৭ ওয়ানডেতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ৪৯টি জয় দেখেছেন। এবার জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে সিরিজের আগেই মাশরাফির ভবিষ্যত নিয়ে নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। মাশরাফি অবসর নিতে পারেন এমনটা প্রথমে গুঞ্জন উঠলেও পরে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন জানিয়েছিলেন, যে এই সিরিজ শেষে ওয়ানডেতে নতুন অধিনায়ক আনবে বাংলাদেশ দল। অর্থাৎ মাশরাফির এটাই শেষ অধিনায়ক হিসেবে। সে সময় পাপন আরও জানিয়েছিলেন, যদি খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে ফিট ও পারফর্মার হিসেবে প্রমাণ করতে পারেন তবেই খেলার জন্য জাতীয় দলে ডাক পাবেন মাশরাফি। আজ জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে সিরিজের শেষ ম্যাচ। আর এ ম্যাচের আগেই বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে নিজ থেকেই নেতৃত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে দিলেন মাশরাফি। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আজ আমি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের ওয়ানডে দলের অধিনায়কত্ব থেকে সরে যাচ্ছি। আগামীকাল (আজ) জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে আমার শেষ ম্যাচ। খেলোয়াড় হিসেবে অবশ্যই আমি চেষ্টা করব আমার সেরাটা দেয়ার। শুভ কামনা থাকবে আমার পরবর্তী অধিনায়কের জন্য। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ দলকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। যদি আমি দলে থাকি আমিও চেষ্টা করব আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার ভেতরে যতটুকু আছে ততটুকু দিয়ে সহযোগিতা করার। আমার প্রতি দীর্ঘ সময় আস্থা রাখার জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই আমার নেতৃত্বে যত খেলোয়াড় খেলেছে বাংলাদেশ দলে তাদের। সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। শেষ পাঁচ-ছয় বছরের যে সফর ছিল, আমি নিশ্চিত এ প্রক্রিয়াটা এতটা সহজ ছিল না।’ ক্যারিয়ারে অনেকবার বড় ধরনের ইনজুরিতে মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে মাশরাফিকে দীর্ঘ সময়। এমনকি ক্যারিয়ারই পড়ে গিয়েছিল হুমকিতে। সেই ইনজুরিতেই বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্যারিয়ারটা আরও বর্ণাঢ্য হয়নি মাশরাফির। উল্টো ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে নেতৃত্ব ও দলে থাকা নিয়ে নানাবিধ সমালোচনা এবং বিতর্কের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে মাশরাফি বলেন, ‘একটা মানুষকে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য অন্তত কিছুটা সময় দেয়া উচিত। ১৫ বছর ধরে এটা আমার জীবনের অংশ। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ। আমার যত অর্জন বা জীবনে যা কিছু করেছি, সব এ খেলা দিয়ে। আমার জীবনের অন্যতম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এটা। ফলে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে আমার সময় দরকার হতো। আমরা মাঠে নামি বাংলাদেশের জন্য। এটা বড় দায়িত্ব। সবার আবেগ জড়িয়ে থাকে। এটা পারিবারিক কোন ব্যাপার হলে সেটা নিয়ে আলোচনার সুযোগ থাকতো।’ শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছাতেই নেতৃত্ব ছেড়েছেন মাশরাফি। তাছাড়া আগেই বলেছিলেন পরবর্তী ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলবেন না, তাই ২০২৩ বিশ্বকাপের জন্য দলকে সুসংবদ্ধ করে তোলার জন্য এখন নতুন অধিনায়ক প্রয়োজন ওয়ানডে দলের। সে ভাবনা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত মাশরাফির। তিনি বলেন, ‘সামনে বিশ্বকাপ আছে ২০২৩ সালে, যেহেতু সবাই বলছিল যে পরিকল্পনা আমাদের করতে হবে। আমি চাই যে নতুন কেউ এখনই আসুক, দল গুছিয়ে নিক। আমি আশা করব যেটা পরিকল্পনা করা হয়েছে সেটা যেন ঠিক থাকে। ২০২৩ সালের জন্য সেরা অধিনায়ক বেছে নিতে হবে। যদি বাইরের কথা চিন্তা করি তাহলে সবাই চাচ্ছে যে ২০২৩ বিশ্বকাপে এ নতুন অধিনায়ক আনার সময় হয়েছে। কালকে পর্যন্ত কিছু মনে হয়নি, সকালেই মনে হয়েছে।’ অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দেয়ার সময় মাশরাফি আরও বলেন, ‘টিম ম্যানেজমেন্ট যারা ছিল, যাদের তত্ত্বাবধানে আমি খেলেছি, আমি অধিনায়কত্ব করেছি তারা সবাই আমাকে ঘনিষ্ঠভাবে অনেক সহযোগিতা করেছে এবং আমার অধিনায়কত্ব যতটুকু মনে পড়ছে হাথুরুসিংহকে দিয়ে শুরু হয়েছিল। তার আগে হয়তো দুই-তিন দফা পেয়েছি কিন্তু ইনজুরির কারণে করতে পারিনি। কিন্তু চূড়ান্তভাবে শুরু হয় হাথুরুসিংহকে দিয়ে। এরপর খালেদ মাহমুদ সুজন, স্টিভ রোডস এবং ডোমিঙ্গো দিয়ে শেষ হচ্ছে। নির্বাচক এবং বোর্ডের কর্মকর্তা যারা আছেন প্রত্যেক বোর্ড স্টাফ থেকে শুরু করে সবাইকে ধন্যবাদ সবার সহযোগিতার জন্য। ধন্যবাদ দিতে চাই আপনাদের, যারা আছেন মিডিয়ার, আপনারা প্রত্যেকে অত্যন্ত সহযোগিতা করেছেন। সবশেষে অবশ্যই সমর্থক যারা বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রাণ। আপনাদের সহযোগিতা ছাড়া এটা কোনভাবেই সম্ভব হতো না।’ ২০০৯ সালে প্রথমবার তিন ফরমেটের জন্যই দলের অধিনায়ক হয়েছিলেন মাশরাফি। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে প্রথম টেস্টে নেমেই ইনজুরিতে পড়ে ছিটকে যান। পরিবর্তে নেতৃত্বভার চাপে সাকিব আল হাসানের কাঁধে। ইনজুরি থেকে ফিরে ২০১০ সালে ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়ে শুরু করেন অধিনায়কত্ব। তবে আবারও ইনজুরির কারণে দীর্ঘ সময় বাইরে থাকতে হয়েছে তাকে। একেবারে ২০১৪ সালের শেষদিকে আবার অধিনায়ক হিসেবে ফেরেন টি২০ ও ওয়ানডে দলে। কিন্তু ২০১৭ সালে টি২০ থেকে অবসর নেয়ার পর গত আড়াই বছর ধরে শুধু ওয়ানডে ফরমেটেই অধিনায়কত্ব করছেন মাশরাফি। ২৮ টি২০ ম্যাচে ১০ জয়, ১৭ পরাজয় দেখেছেন, ৮৭ ওয়ানডেতে ৪৯ জয় ও ৩৬ পরাজয় দেখেছেন। এবার ৫০ পূর্ণ করেই হয়তো দারুণ এক অর্জনে শেষ হবে তার বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেয়ার। ওয়ানডে ইতিহাসে বিশ্বের ২৫তম আর বাংলাদেশের একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে জয়ের অর্ধশতক পূর্ণ হবে আজ জিম্বাবুইয়েকে বাংলাদেশ দল হারিয়ে দিলেই। এ বিষয়ে মাশরাফি বলেন, ‘৫০তম ম্যাচ জয়ের বিষয়টা আমার কাছে মুখ্য নয়। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে তৃতীয় ম্যাচটাও জিততে চাই।’ অধিনায়ক হিসেবে বাংলাদেশের সফলতম মাশরাফি। তার নেতৃত্বেই গত বছর আয়ারল্যান্ডে হওয়া ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। সেটিই বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা। অধিনায়ক হিসেবে সবমিলিয়ে ১০ বছরের পথচলার সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে আজ। ঘোষণা দেয়ার আগে বিসিবি সভাপতি পাপনের সঙ্গেও কথা বলেছেন তিনি। তবে প্রধান কোচ ডোমিঙ্গোর সঙ্গে কিংবা আর কারও সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেননি। মাশরাফি বলেন, ‘আমি নেতৃত্ব থেকে অবসরের সিদ্ধান্তটা হুট করেই নিয়েছি এবং সেটা বিসিবি সভাপতির সঙ্গে কথা বলে। টিম বাসে ওঠার আগে হোটেল থেকে মুঠোফোনে আমি পাপন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি মনে করি, যেহেতু অধিনায়কের দায়িত্বটা সবসময় বোর্ড নির্ধারণ করে এবং বোর্ডই আমাকে অধিনায়কের গুরুদায়িত্ব দিয়েছিল। তাই অধিনায়কের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তটাও বোর্ড সভাপতির সঙ্গে আলাপ করেই নিয়েছি এবং তাকেই সবার আগে জানিয়েছি।’ অধিনায়ক হিসেবে যে কয়েকটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন, সেখানে তার পারফর্মেন্সও ছিল দারুণ। নেতৃত্ব দেয়া ৮৭ ওয়ানডেতে ১০১ উইকেট শিকারের পাশাপাশি ব্যাট হাতে রান করেছেন ৫৭৮। নেতৃত্ব দেয়া ২৮ টি২০ ম্যাচে ২০ উইকেট নিয়েছেন ও ১৩২ রান করেছেন। আর একমাত্র টেস্টে ব্যাট হাতে ৩৯ রান করলেও বোলিং করতে পারেননি ইনজুরির কারণে।
×