ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

ইথিওপিয়া থেকে সৌদি আরব, এক বিপদসঙ্কুল অভিযাত্রা

প্রকাশিত: ১১:৫৬, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 ইথিওপিয়া থেকে সৌদি আরব, এক বিপদসঙ্কুল অভিযাত্রা

‘আরেকটু ধৈর্য ধরো’, মোহাম্মদ ইসা নিজেকে নিজে সান্ত¡না দিলেন। প্রতিনিয়ত মনে মনে বিড়বিড় করেন এবং ভাবতে থাকেন বোধ হয় আর পেরে উঠবেন না। জীবন বোধ হয় এখানেই শেষ হতে চলেছে। প্রখর দীপ্ত সূর্যের তাপে ল্যাক আসাল লেকের লবণাক্ত পানি বাষ্প হয়ে শূন্যে উড়ছিল, আর সমুদ্রের চেয়ে ১০ গুণ লবণাক্ত পানির স্তর শুকনো বাকলের মতো রুক্ষ হয়ে উঠছিল। আলজাজিরা। লেকের চারপাশে সবুজ কিছু নেই, কেবল বিজন মরু প্রান্তর। উড়ন্ত পাখির সূর্যের তীব্র প্রতাপ যেন ঝলসে দেয়ার জন্য সদা প্রস্তত। এদিকে ৩৫ বছর বয়সী ইথিওপিয়ার এক নাগরিক এই সব বিপদসঙ্কুল ও বৈরী পরিবেশকে কোন তোয়াক্কা না করেই সামনের দিকে হেঁটে চলছেন। তিনি সৌদি আরবের উদ্দেশে গত তিন দিন হলো বাড়ি থেকে যাত্রা করেছেন। এর পাশেই অন্তত দুই ডজন কবর ও মাথাছাড়া শিলার স্তূপ অসহায়ের মতো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। এদিকে ইসার মতো যারা অভিবাসন প্রত্যাশায় ইথিওপিয়ার গ্রাম বা শহর থেকে হর্ন অব আফ্রিকার দেশগুলো- ডেজিবুটি বা সোমালিয়া অতিক্রম করে তাদের কয়েক শ’ মাইল অতিক্রম করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। তারপর তারা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ইয়েমেন হয়ে গন্তব্যের পথে যেতে পারে। তবে এই পথে অভিবাসন প্রত্যাশীদের আগমন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য মতে, ২০১৮ সালে হর্ন অব আফ্রিকা হতে প্রায় দেড় লাখ মানুষ ইয়েমেনে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগের বছর এই সংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ দেশটিতে আশ্রয় নিয়েছিল। ২০১৯ সালেও এই একই পরিমাণ অভিবাসন প্রত্যাশী ইয়েমেনে আসে। এই অভিবাসন প্রত্যাশীদের স্বপ্ন হলো সৌদি আরব যাওয়া এবং সেখানে গিয়ে কায়িক শ্রম, চাকর, ড্রাইভার বা অবকাঠামো শ্রমিকের কাজ করে দারিদ্রতা দূর করা। তবে তারা তাদের স্বপ্নের দেশের দেখা পেলেও সেখানে থাকার কিন্তু কোন নিশ্চয়তা পায় না। সৌদি সরকার প্রায়ই এ অভিবাসন প্রত্যাশীদের দেশ থেকে বের করে দেয়। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা জানায়, গত তিন বছরের প্রতি মাসে অন্তত ৯ হাজার ইথিওপিয়ান সৌদি আরবে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এর অনেকেই দেশটিতে একাধিকবার গিয়েছেন কেবল ভাগ্য বদলের আশায়। ইসাও এসব ভাগ্যহারাদের দলে, কেবল ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সৌদির পথে যাত্রা করেন। এই নিয়ে এটি তার তৃতীয়তম যাত্রা। ইসার পকেটে ওরোমো ভাষায় একটি চিঠি লিখে রাখা রয়েছে। ভাষাটি ইথিওপিয়ার নিজস্ব ভাষা। চিঠিতে শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (স) বিষয়ে গল্প লেখা রয়েছে। ইসা বলেন, ‘আমি আল্লাহর ওপর ভরসা করি।’ ইসার মত আরেক অভিবাসন প্রত্যাশী রয়েছে তার দলে, তার নাম মোহাম্মদ ইব্রাহিম। সে আরশি থেকে এসেছে। ওই আরশি থেকেই ইসা এসেছে। ২২ বছর বয়সী ইব্রাহিম এর আগে কোথাও কোন চাকরি করেনি। সে যখন তার মায়ের পেটে ছিল, তখন তার বাবা মারা গেছেন। সে তার মায়ের কাছ থেকে ওই অঞ্চলে যুদ্ধের অনেক গল্প শুনেছে এবং যুদ্ধের কারণে তার বাবার মৃত্যুর কথাও জেনেছে। পাশাপাশি ইব্রাহিমের মা ইব্রাহিমকে দেশে কখনও ফিরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। একদিন ইব্রাহিম তাদের গ্রামে তার এক বন্ধুকে বাইকে করে যাত্রী বহন করতে দেখল। ছেলেটি এভাবে বেশ অর্থ সঞ্চয় করছিল। এরপর সে তার মায়ের কাছে যায় এবং তাকে বাইক ক্রয় করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করে। ইব্রাহিম তার মাকে জানায়, তার ও তার ছোট বোনের দেখা-শোনার জন্য সে রোজগার করতে চায়, এজন্য তার একটি বাইক দরকার। ইব্রাহিমের মা তখনই তাকে জানায়, এটা অসম্ভব। তিনি ইব্রাহিমকে কখনই বাইক ক্রয় করে দেবেন না। এরপর ইব্রাহিম সৌদি আরব যাওয়ার জন্য মনস্থ করে।
×