ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণা প্রতিদিন

টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী জমিদার বাড়ি

প্রকাশিত: ০৭:৩২, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী জমিদার বাড়ি

কালের স্রোতে পৃথিবী বদলে গেছে। বদলে গেছে জমিদারি প্রথাও। জমিদার নেই! নেই জমিদারি শাসন ব্যবস্থাও। কিন্তু তাদের বাড়িগুলো আজও রয়ে গেছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্মৃতির মিনার হয়ে থাকা এমনই এক ঐতিহ্যবাহী জমিদারবাড়ি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী। যা স্থানীয়দের কাছে নবাব প্যালেস বা নবাব মঞ্জিল নামে পরিচিত। পর্যটকরা এর নির্মাণশৈলী দেখলে বুঝতে পারবেন কতটা দারুণ সুসজ্জিত জমিদারবাড়িটি। একটু হলেও বাড়তি সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায়। রাজ প্রাসাদের সামনে সুবিস্তৃত বাগানও শুধুই বাগান নয়, শত বছরে হয় তো শত হাজারবার ঝরে গেছে গোলাপের পাপড়ি, কামিনীর পাতা, তবুও আজ পাতায় পাতায় লেখা রয়ে গেছে রাজা-রানীর রোমান্টিকতার কড়চা, পাঁপড়িগুলোয় রাজকুমারীর হাতের স্পর্শ। তাই ভ্রমণ পিয়াসী ও ইতিহাস প্রেমীরা ঐতিহ্যের খোঁজে বারবারই ছুটে চলে জমিদার বাড়িতে। ১৮০০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই জমিদার বংশ বা জমিদার বাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন ব্রিটিশদের কাছ থেকে বাহাদুর, নওয়াব, সিআইই খেতাবপ্রাপ্ত জমিদার খান বাহাদুর সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার প্রথম প্রস্তাবক এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রথম মুসলিম মন্ত্রী। তাঁরই অমর কৃর্তি ধনবাড়ী জমিদারবাড়ি বা নওয়াব প্যালেস। এই জমিদার বাড়িতে রয়েছে একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস। ধারণা করা হয়, মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ধনপতি সিংহকে পরাজিত করে মোগল সেনাপতি ইস্পিঞ্জর খাঁ ও মনোয়ার খাঁ ধনবাড়ীতে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের কয়েক পুরুষ পরের নবাব ছিলেন সৈয়দ জনাব আলী। সৈয়দ জনাব আলী ছিলেন সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর বাবা। তিনি তরুণ বয়সে মারা যান। নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিয়ে করেন বগুড়ার নবাব আবদুস সোবহানের মেয়ে আলতাফুন্নাহারকে। আলতাফুন্নাহার ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁর মৃত্যুর পর নবাব বিয়ে করেন ঈশা খাঁর শেষ বংশধর সৈয়দা আখতার খাতুনকে। নওয়াব আলী চৌধুরীর তৃতীয় স্ত্রীর নাম ছিল সকিনা খাতুন। নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯২৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। নবাব ওয়াকফ নামায় তাঁর তৃতীয় স্ত্রীর একমাত্র ছেলে সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী এবং মেয়ে উম্মে ফাতেমা হুমায়রা খাতুনের নাম উল্লেখ করে যান। সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী পরবর্তীকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পমন্ত্রী নির্বাচিত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৮ সালেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ১৯৮১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এই জমিদারবাড়ির বর্তমান উত্তরাধিকারী তাঁর একমাত্র সন্তান সৈয়দা আশিকা আকবর। নবাবের উত্তরাধিকারীরা জমিদার বাড়িতে গড়ে তোলেন পিকনিক স্পট। যা নবাব সৈয়দ হাসান আলী রয়্যাল রিসোর্ট হিসেবে বেশ খ্যাতি লাভ করেছে। রিসোর্টটি দেখাশোনার দায়িত্বে আছে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান লাইট হাউস গ্রুপ। টাঙ্গাইলের বুক চিরে বয়ে যাওয়া বংশাই ও বৈরান নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এই প্রাচীন জমিদারবাড়িটি অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী এবং কারুকার্যে সত্যিই মনোরম এবং মনোমুগ্ধকর। তবে রিসোর্ট তৈরির পর নবাব প্যালেসে বেড়েছে চাকচিক্য এবং আধুনিকতা। চার গম্বুজবিশিষ্ট অপূর্ব মোগল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এই শতাব্দী প্রাচীন নবাব প্যালেস। পুরো নবাব মঞ্জিল বা নবাব প্যালেসটি প্রাচীরে ঘেরা। প্রাসাদটি দক্ষিণমুখী এবং দীর্ঘ বারান্দা সংবলিত। ভবনের পূর্বদিকে বড় একটি তোরণ রয়েছে। তোরণের দুই পাশে প্রহরীদের জন্য রয়েছে দুটি কক্ষ। তোরণটি জমিদার নওয়াব আলী চৌধুরী ব্রিটিশ গভর্নরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য নির্মাণ করেন। প্রাচীরঘেরা চত্বর অংশে আবাসিক ভবন দুটি ছাড়া আরও আছে ফুলের বাগান, চিড়িয়াখানা, বৈঠকখানা, নায়েবঘর, কাচারিঘর, পাইকপেয়াদা বসতি এবং দাস-দাসি চত্বর। দর্শনার্থীদের জন্য প্রাসাদের ভেতরের বেশ কয়েকটি কামরা ঘুরে দেখার সুযোগ আছে। তাছাড়া বারান্দাতেও শোভা পাচ্ছে মোগল আমলের নবাবী সামগ্রী, সেগুলো ছুঁয়ে দেখতে পারেন। মোগল আমলের আসবাবপত্র আপনাকে মুগ্ধ করবে। প্যালেসটির পাশেই রয়েছে ৩০ বিঘার বিশালাকার দিঘী, দিঘীর গভীরতা খুঁজে পাওয়া ভার। সুন্দর ও মনোরম শান বাঁধানো ঘাট রয়েছে। ইচ্ছে করলে শৌখিন ভ্রমণপ্রেমীরা এখানে নৌকা ভ্রমণ ও মাছ ধরতে পারেন। সেখানে দর্শনার্থীদের ঘোরার জন্য রয়েছে দুটি সাম্পান, চড়তে পারেন আপনিও। তা ছাড়া নবাবি স্টাইলে পুরো রিসোর্ট ঘুরে দেখার জন্য রয়েছে ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা। ইচ্ছে হলে দেখতে পারেন গারোদের সংস্কৃতি ও নাচ। এজন্য আপনাকে আগেই জানিয়ে রাখতে হবে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষকে। রিসোর্ট থেকে ৩০ মিনিটের দূরত্বে ঐতিহ্যবাহী মধুপুর বন। মধুপুর থেকে ৩০ মিনিটের পথ পেরুলেই রয়েছে আদিবাসী গারোপল্লী। সেখানে উপলব্ধি করা যায় গারোদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবনধারা, যা পর্যটকদের মনের খোরাক জোগায়। রয়েছে মনোমুগ্ধকর রাবার বাগান, আনারস বাগান, বাঁশ বাগান-যা অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। রয়েল রিসোর্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপোর্ট ও গাইড দিয়ে রিসোর্টের গেস্টদের ঘুরিয়ে দেখায় আশপাশের সব দর্শনীয় স্থান। পর্যটকদের সুবিধার্থে নিরাপত্তারক্ষী ও ওয়েটার রয়েছে এ রিসোর্টে। এছাড়া গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থাসহ সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে এই রয়েল রিসোর্টে। রিসোর্টটির আরেকটি বিরাট আকর্ষণ নবাব মসজিদ। রয়েল রিসোর্টের ঠিক পাশেই রয়েছে ৭০০ বছরের পুরোনো এক মসজিদ। মোগল স্থাপত্যের নিদর্শন এই মসজিদের মোজাইকগুলো এবং মেঝেতে মার্বেল পাথরে নিপুণ কারুকার্য অসাধারণ। মসজিদটির পাশে একটি কক্ষ রয়েছে, যা নবাব বাহাদুর সৈদয় নওয়াব আলী চৌধুরীর মাজার। ১৯২৯ সালে নবাবের মৃত্যুর পর থেকে এখানে ২৪ ঘণ্টা কোরআন তিলাওয়াত হচ্ছে, যা এখনও এক মিনিটের জন্য বন্ধ হয়নি। কোরআন তিলাওয়াতের হাফেজ নিযুক্ত রয়েছেন। তাঁরা প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর একেকজন কোরআন তিলাওয়াত করে থাকেন। প্রতিদিন দেশী-বিদেশী বিপুল সংখ্যক পর্যটকের পা পড়ে এই জমিদার বাড়ির আঙিনায়। বিশেষ করে শীত মৌসুমের পুরোটা জুড়েই ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণা থাকে জমিদার বাড়িতে। জনপদের এই ভূ-ভাগে দেখা যায়, বৈচিত্র্যের ঐক্যতান। শত শত পর্যটকের সরব উপস্থিতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে। তারা আসে, দেখে, জানে এবং একরাশ প্রশান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে যায়। এবার শীতে ঘুরে যেতে পারেন জমিদারবাড়িতে। -ইফতেখারুল অনুপম, টাঙ্গাইল থেকে
×