ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পরিচ্ছন্ন মননশীল সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীলতা এমন আড্ডার আসর হৃদযন্ত্রকে সতেজ রাখে এবং ভালো লাগার অনুভবকে অদৃশ্য সুতায় টেনে নেয়

বগুড়ার কৃষ্ণচূড়া চত্বরে কফি হাউসের আড্ডা

প্রকাশিত: ০৮:০১, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০

   বগুড়ার কৃষ্ণচূড়া চত্বরে কফি হাউসের  আড্ডা

সেই চিরন্তন গান-কফি হাউসের আড্ডাটা আজ আর নেই....। তবে সেই আড্ডা কখন যে সীমানা পার হয়ে চলে এসেছে বগুড়ার আকাশের নিচে। বগুড়ায় যিনি সন্ধ্যায় একবার কেন্দ্রস্থল সাতমাথায় এসেছেন এই নেশা কাটাতে পারবেন না। জমজমাট আড্ডায় শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক, পেশাজীবী, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী সকল শ্রেণীপেশার মানুষের নিত্যদিনের আগমন। সাতমাথা থেকে পূর্বে কয়েক পা এগোলেই এক তরুতল। বৃক্ষটি শীর্ণকায়। তবে চারিধার পরিচিতি পেয়েছে কৃষ্ণচূড়া চত্বরে। আর এই চত্বরের নিকুঞ্জের চায়ের দোকান দেখা করার লোকেশন। কেউ কারও সঙ্গে দেখা করতে চাইলে বলা হয় ‘নিকুঞ্জের দোকান।’ যেন কৃষ্ণচূড়া চত্বরে নিকুঞ্জ বন। পরিচ্ছন্ন মননশীল, সৃজনশীল ও সৃষ্টিশীলতার এমন আড্ডার আসর হৃদযন্ত্রকে সতেজ করে রাখে। হৃদয়ের ভাললাগার অনুভবকে অদৃশ্য সুতোয় টেনে নেয়। সাতমাথায় বীরশ্রেষ্ঠ স্কোয়ার। সামনেই টেম্পল রোড ও নবাববাড়ি সড়কের মধ্যবর্তীস্থলে প্রধান ডাকঘরের সামনে এই প্রেমময় ভুবন। টেম্পল রোডের ধারে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, আওয়ামী লীগ, জাসদ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কার্যালয়। এই চত্বরকে ঘিরে পাশের নবাববাড়ি সড়কের ধারে ছড়িয়ে পড়েছে স্ট্রিট ফুডের বাহারি ভ্রাম্যমাণ দোকান। কি নেই এসব স্ট্রিট ফুডে। ফুচকা, চটপটি, বুট সিদ্ধ, পেঁয়াজু, বেগুনি, কলাভাজা, লাউভাজা, চিকেন রোল, ভেজিটেবল রোল, বার্গার, এগফ্রায়েড, চিকেন ফ্রাই, চিকেন গ্রীল, সবধরনের কাবাব, চাপ, বিরিয়ানিসহ বাহারি সকল খাবার মেলে। ফাস্টফুড ও চীনা রেস্তরাঁর খাবার যুক্ত হয়েছে স্ট্রিট ফুডের তালিকায়। দোকানগুলোতে এলপিজি সিলিন্ডারে গ্যাসের চুলায় রান্না হয়। কাঠের বাক্সের সঙ্গে কাঁচে ঘেরা দোকানগুলো চারটি চাকার ওপর তৈরি। দোকান স্থির করে সামনে প্লাস্টিকের চেয়ার ও কাঠের বেঞ্চ পাতা হয়। অল্প দূরে বাদামওয়ালা, চনাচুরওয়ালা, সিদ্ধডিম, ভাপাপিঠাসহ নানা খাবারের পসরা বসে। আশপাশেই আছে চায়ের দোকান। এই দোকানও আপগ্রেড। চারের সঙ্গে যোগ হয়েছে কফি, চিনি ছাড়া কফি, হরলিক্স মিশ্রিত চা, দুধ চা, রুটি (লাল চা), মরিচ মসলা দিয়ে লাল ঝাল চা। অনেক ধরনের বিস্কুট তো আছেই। অনেক দোকানি কফি মেকার বসিয়েছে। স্ট্রিট ফুডের কালচার গড়ে উঠেছে এভাবে- অনেক আগে পোস্ট অফিসের সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকান শুরু করেন প্রফুল্ল চন্দ্র দাস। তারপর নিকুঞ্জ কুমার কিশোর বেলায় হাল ধরে। এই চায়ের দোকান এতটাই জনপ্রিয় যে নিকুঞ্জ বললে বাকিটুকু আর বলতে হয় না। এরপর শুরু হয় কবি সাহিত্যিকদের আড্ডা। এর মধ্যে কোন ফাঁকে চলে আসে শিল্পীরা। কেউ অভিনেতা কেউ নাট্যকার, কেউ গায়ক কেউ আবৃত্তিকার কেউ নৃত্যশিল্পী... সাহিত্য রসসুধার আড্ডায় তারাও যুক্ত হতে থাকে। তারপর তরুণ-তরুণীর আন্তরিকতার পরিধি বেড়ে যায়। বাদ থাকে না মধ্যবয়সী ও অবসরপ্রাপ্তরা। আড্ডায় কতবার কতভাবে যে কথামালার ট্র্যাক পাল্টে যায় ঠাহর করা যায় না। এই কথার মধ্যে কেউ রাজনীতির কথা নিয়ে প্রবেশ করলে ব্যস হয়ে গেল। আড্ডার ষোলোকলা পূর্ণ হলো। তবে রাজনীতির আড্ডায় সুধীজনরা অনেক সতর্ক থাকেন এবং কেউ সহজে চটে যায় না। কেউ কাউকে আক্রমণ ও উত্ত্যক্ত করে না। শৃঙ্খলিত এমন আড্ডা থেকে অনেক কিছু জানাও যায়। কেউ দেশী-বিদেশী মিডিয়ার বিশ্লেষণ খবর নিয়ে আলাপ শুরু করে। পক্ষে-বিপক্ষে নানা মন্তব্যে আড্ডা জমে ওঠে। চারধারের দোকানগুলোতে বেচাকেনা বেড়ে যায়। তখন সূক্ষ্ম কৌশলে অল্প দূরের দোকানিরা তাদের টেনে নেয়ার চেষ্টা করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল হয়। হালে এই আড্ডগুলোতে তরুণ-তরুণীদের পরিচ্ছন্ন ডেটিং শুরু হয়েছে। জায়গাটি উন্মুক্ত। নিত্যদিন এই পথে অনেক পরিচিত মুখের চলাচল। যে কারণে কেউ দেখলেও যেন বলা যায় স্ট্রিট ফুডের কেনাকাটার জন্য এসেছিল। আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে কেউ স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে আসে। যাতে সাক্ষী গোপাল হয়ে রক্ষা করে। রোদ বৃষ্টি ঝড়ে কৃষ্ণচূড়া চত্বরের নিকুঞ্জ বনের মিষ্টি আড্ডা কফি হাউসের আড্ডা হয়ে এগিয়ে যায় সমুখের পানে। চলে ভর বছর। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×