ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায়বিচার প্রয়োজন বহুপক্ষীয় উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৯:১১, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯

রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যায়বিচার প্রয়োজন বহুপক্ষীয় উদ্যোগ

গুলি-বোমা-আগুন, খুন-ধর্ষণ, চোখের সামনে স্বামী-স্বজনের ওপর বীভৎসতা, হাজার হাজার মানুষের প্রাণহরণÑমৃত্যুর বিভীষিকা পেছনে ফেলে বলপূর্বক লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিক নিকটজন ও সর্বস্ব হারিয়ে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে নিতান্ত প্রাণের দায়ে বাংলাদেশে শরণার্থী হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ দরাজ দিলে ব্যথিত রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানিয়েছে। সদাশয় সরকার নানাবিধ ঝুঁকি নিয়ে মরণাপন্ন এই মানুষদের আশ্রয় দিয়েছে। শিকড়চ্যুত এই সকল অসহায় মানুষের মুখে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বর নিষ্ঠুরতার কাহিনী, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের আবাস পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ছবি বিশ্ববাসী দেখেছে। ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে চলেছে। এই সংখ্যা বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশে আশ্রিত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর অতিরিক্ত। ফলে বিশে^র মোট শরণার্থীর ৪.৭ ভাগ এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার, জাতিসংঘ, অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তাকারী সংস্থা এই লাখ লাখ আপাত রাষ্ট্রবিহীন মানুষের সুরক্ষায় এগিয়ে আসে। হাজারও সমস্যা আক্রান্ত বাংলাদেশের আশ্রয়দানকারীর ভূমিকা সারাবিশ্বে নন্দিত হয়েছে। শরণার্থীদের আশ্রয় গ্রহণের দুই বছর ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত হয়েছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, কানাডাসহ পৃথিবীর অনেক দেশ শরণার্থীদের সসম্মানে ফেরত পাঠানোর নানা উদ্যোগ নিয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক আদালতসহ কয়েকটি জবাবদিহির উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বল প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আর্জি, যা শুনানি শেষে রায় ঘোষণার অপেক্ষায় রয়েছে। গাম্বিয়া এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগ বিশ্বে নতুন নয়। রুয়ান্ডায় গণহত্যার বিচারে আন্তর্জাতিক উদ্যোগের কথা বিশ্ববাসীর জানা আছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের প্রবল অনীহায় রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কোন উদ্যোগ এখন পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি। অত্যন্ত দুঃখজনক হলো বাংলাদেশের দীর্ঘকালের পরীক্ষিত মিত্র প্রতিবেশী ভারত, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পরাশক্তি চীন ও রাশিয়া শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদ্যোগকে তেমন আমলে নিচ্ছে না। এই পটভূমিতে রোহিঙ্গাদের স্বার্থে বিষয়টির সুবিচার ও জবাবদিহির ওপর আলোকপাত করার জন্য ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস্ এ্যান্ড জাস্টিস্ (সিপিজে) ‘রোহিঙ্গাদের জন্য সুবিচার ও জবাবদিহিতা’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক কনক্লেভ বা বিশেষ সভার আয়োজন করেছে। গত ১৮ অক্টোবর নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে ইরাসমুস বিশ^বিদ্যালয় রোটারডামের অন্তর্ভুক্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল স্টাডিজে (আইএসএস)-এ এই বিশেষ সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এশিয়া জাস্টিস্ কোয়ালিশন এবং আইএসএস এ আয়োজনে সহযোগিতা করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শতাধিক বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, গবেষক, নীতিনির্ধারক, খ্যাতনামা মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধি এবং বিশিষ্ট আইনবিদগণ এই সভায় যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মিয়ানমারে কানাডার বিশেষ দূত বব রে, গণপ্রজাতন্ত্রী গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবুবকর ম্যারি টাম্বাডো, আইএসএসের রেক্টর ইঙ্গে হুটার, নেদারল্যান্ডসের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ও মিয়ানমার সংক্রান্ত কফি আনান কমিশনের সদস্য লেটেশিয়া ভ্যান ডেন আছুম, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর গ্লোবাল পলিসির বাস্তুচ্যুতি ও দেশান্তরী কর্মসূচীর পরিচালক আজিম ইব্রাহিম, জুরিস্ট গ্লোবাল এ্যাকাউন্টিবিলিটি ইনিশিয়েটিভের সমন্বয়কারী কিংসলে এ্যাবোট, এশিয়া প্যাসিফিক রিফিউজি রাইটস্ নেটওয়ার্ক রোহিঙ্গা ওয়ার্কিং গ্রুপের সভাপতি লিলিয়ান ফ্যান, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক বিরাজ পাটনায়ক, যুক্তরাজ্যভিত্তিক বর্মী রোহিঙ্গা সংস্থার সভাপতি ও রোহিঙ্গা নেতা তুন কিন, নেদারল্যান্ডসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ মোহাম্মদ বেলাল, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মোঃ শহীদুল হক, ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য ভিনসেন্ট চ্যাং, সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ, নারীপক্ষের ‘রোহিঙ্গা নারীদের পাশে আমরা’ কর্মসূচীর সমন্বয়কারী শিরীন হক, এ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির, কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, ব্র্যাকের এ্যাডভোকেসি পরিচালক কেএএম মোর্শেদ, আইএসএসের অধ্যাপক সৈয়দ মানসুব মোর্শেদ প্রমুখ। সভার মূল বিবেচ্য বিষয় ছিলÑ নৃশংসতা, জবাবদিহিতা ও এ্যাডভোকেসি। উদ্বোধনী অধিবেশন ছাড়াও দিনব্যাপী সভার তিনটি প্যানেল আলোচনায় রোহিঙ্গা সঙ্কট ও মিয়ানমারের সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, রোহিঙ্গাদের জন্য সুবিচার ও জবাবদিহিতা, টেকসই সমাধানের জন্য বহুমুখী সুনির্দিষ্ট কাজ বিষয়ে আলোচনা উত্থাপন করা হয়। সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে পরবর্তী করণীয় বিষয়ে কৌশলগত দিকনির্দেশনা প্রস্তুত করা হয়। রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কটের সুবিচার ও জবাবদিহির স্বার্থে এ আয়োজনের পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত প্রধান উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে রয়েছে- ১) বিশ^ব্যাপী সুবিচার এবং জবাবদিহির লক্ষ্যে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ এবং একটি টেকসই সমাধানের বহুমুখী উপায়ের ওপর আলোকপাত করা; ২) সামাজিক ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক সমাজের একটি নেটওয়ার্ক সুসংহত করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগের পক্ষে নীতিগত সমর্থন জোগাড় করা ও জনমত গড়ে তোলা এবং ৩) রোহিঙ্গাদের জন্য সুবিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। ভবিষ্যত এ্যাডভোকেসি কৌশল নির্ধারণের জন্য এই সঙ্কটের মূল কারণ ও নীতি সংক্রান্ত চলমান বাধাসমূহ পরীক্ষা করা। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিপুল জনসংখ্যার ক্ষুদ্র ভূখ- বাংলাদেশের পক্ষে বাড়তি অন্তত ১১ লাখ মানুষের ভরণপোষণ, শিক্ষাদানসহ অন্যান্য দায়িত্ব গ্রহণ অত্যন্ত কঠিন। বাংলাদেশের জন্য এ কাজ একই সঙ্গে প্রকট এক সমস্যা, অন্যদিকে বিবিধ অসুবিধারও। কূটনেতিক উদ্যোগ, ব্যবস্থাপনাগত দিক, সসম্মানে শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোসহ রোহিঙ্গা সঙ্কট কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিম-লে প্রশংসাসহ, বহু দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সুদৃষ্টি আকর্ষণ এবং নানাবিধ সুবিধা পেতে পারে। আপাত এই দেশহীন বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা নাগরিকদের নাগরিকত্বসহ নিজ দেশ রাখাইনে নিরাপদে প্রত্যাবাসন এবং মর্যাদার সঙ্গে বসবাসের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন ভারত, চীন, রাশিয়ার সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় এবং অন্যান্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বহুপক্ষীয় আলাপ-আলোচনার জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা। লেখক : নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পিস্ এ্যান্ড জাস্টিস্ (সিপিজে), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
×