ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ময়মনসিংহ সিটির উন্নয়নে তৈরি হচ্ছে মাস্টারপ্ল্যান

প্রকাশিত: ০৮:৫০, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ময়মনসিংহ সিটির উন্নয়নে  তৈরি হচ্ছে মাস্টারপ্ল্যান

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ নবগঠিত ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের (মসিক) উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন নগর উন্নয়ন অধিদফতর তৈরি করছে মাস্টারপ্ল্যান। বিলুপ্ত ময়মনসিংহ পৌরসভার জন্য এর আগে তৈরি করা মাস্টারপ্ল্যানকে বেইজ ধরে এটিকে আরও ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে নতুন সম্প্রসারিত ১২টি ওয়ার্ডকে এর আওতায় আনা হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যান তৈরিতে ময়মনসিংহ সিটির জরিপ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন। নয়া এই মাস্টারপ্ল্যানে নগরীর ব্যস্ততম কেন্দ্র বিন্দু থেকে রেললাইন সরিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড অথবা ওভারহেড রেললাইন স্থাপন, একাধিক ফ্লাইওভার, ওভারব্রিজ ও চারলেন সড়ক নির্মাণ, ময়লা আবর্জনার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে নিজস্ব চাহিদার বিদ্যুত জেনারেশন, নগরবাসীর বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন, নগরীর প্রতিটি সড়কে বাতির ব্যবস্থাকরণসহ জলাবদ্ধতা দূরীকরণে সড়ক যোগাযোগ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পানি নিষ্কাশনে আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ লাইন স্থাপন, খাল খনন, চিড়িয়াখানাসহ শিশু পার্ক নির্মাণ, পাটগুদাম মোড় থেকে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল ও ট্রাক টার্মিনাল অন্যত্র স্থানান্তর এবং ২০ তলা বিশিষ্ট আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন ময়মনসিংহ নগর ভবন নির্মাণ কাজ রাখা হয়েছে। এসবের বাইরে থাকছে নগরীর বিউটিফিকেশনসহ নগরবাসীর বিনোদনে পরিবেশবান্ধব ছায়াশীতল পরিবেশের নানা উন্নয়ন কাজ। আগামী এক মাসের মধ্যে নগর উন্নয়ন অধিদফতর মাস্টারপ্ল্যানের খসড়া চূড়ান্ত করার পর ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবে নানা শ্রেণী পেশার মানুষের সঙ্গে এ নিয়ে মতবিনিময়ের জন্য। এসময়ে এর সংযোজন ও বিয়োজন শেষে গেজেট প্রকাশের জন্য পাঠানো হবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। আশা করা হচ্ছে আগামী ৩/৪ মাসের মধ্যে মাস্টারপ্ল্যানের গেজেট প্রকাশ করা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবেলাকে মাথায় রেখে নগর উন্নয়ন অধিদফতর নয়া এই মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করছে বলে জানান ময়মনসিংহ সিটির নগর পরিকল্পনাবিদ মানস বিশ্বাস। ময়মনসিংহের সিটি মেয়র ইকারমুল হক টিটু জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চান পরিকল্পিত নগর উন্নয়ন। আর পরিকল্পিত নগরায়নের লক্ষ্যে এই মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হচ্ছে। এটি বাস্তবায়িত হলে বদলে যাবে ময়মনসিংহ সিটির চিরচেনা চেহারা। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ট নেতৃত্বে দেশের প্রতিটি এলাকায় অভাবনীয় যে দৃশ্যমান উন্নয়ন হচ্ছে তারই ধারাবাহিকতায় ময়মনসিংহ সিটির উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভিশন বাস্তবায়নে ময়মনসিংহ সিটি মেয়র নানা শ্রেণী পেশার নাগরিকদের আন্তরিক সহাযোগিতা চেয়েছেন। মাস্টারপ্ল্যান গেজেট হওয়ার আগ পর্যন্ত নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণে রাস্তাঘাট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ নগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডে সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং প্রতিটি ওয়ার্ডের সড়কে বাতির ব্যবস্থাকরণসহ চলমান উন্নয়ন কাজ অব্যাহত রাখতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে আড়াই হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ চেয়ে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফাইল (ডিপিপি) জমা দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত মাস্টারপ্লানে থাকা বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ অব্যাহত রাখতেই এই বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে বলে জানান মেয়র। ইতোমধ্যে ইউজিপ-২সহ বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় নগরীর বেশ কয়েকটি সড়ক উন্নয়নসহ আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ হয়েছে। আরসিসি প্রযুক্তির সড়ক উন্নয়সহ আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ লাইন স্থাপনের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা বদলে দিয়েছে নগরীর বাণিজ্যিক এলাকাসমূহে জলাবদ্ধতার চিরচেনা ভোগান্তির চেহারা। আরসিসি সড়কের মাঝখান বরাবর মাটির নিচ দিয়ে বড় আকৃতির পাইপ বসিয়ে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদে। ফলে নগরীর নতুন বাজার, রামবাবু রোড, সিকেঘোষ রোড, দুর্গাবাড়ি রোড, গাঙিনাপাড়, ষ্টেশন রোড, মহারাজা রোড, স্বদেশী বাজার, মেছুয়া বাজার, ছোট বাজার ও বড় বাজারসহ বাণিজ্যিক এলাকাসমূহের পানি দ্রুত নিষ্কাশিত হচ্ছে। এমতাবস্থায় নগরীর রেল লাইনের উত্তর পূর্বাংশের বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকায় জলাবদ্ধতার দৃশ্যমান কোন ভোগান্তি নেই বললেই চলে। আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ লাইন স্থাপন ও সড়কের দুইপাশে আরসিসি ড্রেন নির্মাণ কাজের ফলে এসব এলাকার মানুষ চলতি বর্ষা মৌসুম থেকে সুফল পেতে শুরু করেছে। দাবি উঠেছে নগরীর রেল লাইনের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের চরপাড়া, নয়াপাড়া, মাসকান্দা, নওমহল, আকুয়া, কাচিঝুলি, আউটার স্টেডিয়াম, সানকিপাড়া, গুলকিবাড়ি, গোহাইলকান্দি, কাশর আবাসিক এলাকায় আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ লাইন স্থাপনসহ ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন করে জলাবদ্ধতা নিরসনের। ময়মনসিংহের সিটি মেয়র ইকরামুল হক টিটু জানান, জলাবদ্ধতা দূরীকরণে বাণিজ্যিক এলাকার ইতিবাচক সুফল পর্যায়ক্রমে নগরীর সব ওয়ার্ডে পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে। ময়মনসিংহ নগরীর গোড়াপত্তন যেভাবে ॥ প্রয়াত আহমদ তৌফিক চৌধুরীর ‘শহর ময়মনসিংহ’ থেকে জানা যায়, পুরনো ব্রহ্মপুত্র পাড়ের ময়মনসিংহ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৮৭ সালের পহেলা মে। ময়মনসিংহ শহর পদ মর্যাদায় উন্নীত হয় ১৮১১ সালে। শহরের জন্য জায়গা দেন মুক্তাগাছার জমিদার মহারাজ রঘুনন্দন আচার্য। ১৮৬৯ সালের পহেলা এপ্রিল কৃষ্ণপুর, চরপাড়া, ইটাখলা ও কাশর এই ৪টি এলাকা নিয়ে নাসিরাবাদ পৌরসভা স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে ১৯০৫ সালে নাসিরাবাদ নাম পরিবর্তন করে এর নাম হয় ময়মনসিংহ মিউনিসিপালিটি। শুরুতে এর লোকসংখ্যা ছিল ৮৫০০ জন। ১৯০১ সালে এই লোকসংখ্যা বেড়ে দাড়ায় ১৪ হাজার ৬৬৮ জন। ১৯৮৩ সালে ময়মনসিংহ পৌরসভার লোকসংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৮৬৩ জন। বর্তমানে এই জনসংখ্যা আট লাখ। এর প্রথম ইংরেজ ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন ও, এম, স্ট্রাক, প্রথম হিন্দু ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন শ্রী চন্দ্রকান্ত ঘোষ, প্রথম মুসলিম ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন খান সাহেব আলী। শুরুতে ময়মনসিংহ পৌরসভার নিয়ন্ত্রণে রাস্তা ছিল মাত্র ২৫ মাইল। তৎকালীন কালেক্টর মি. গ্রস জেল খানার কয়েদীদের দিয়ে শহরের মধ্যভাগ ও ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় বরাবর দুইটি প্রধান সড়ক তৈরি করেন। রাস্তাঘাট ও ময়লা পরিষ্কারের জন্য সর্বপ্রথম ১৮৭০ সালে ভারতের সীমান্ত প্রদেশ থেকে ৬ জন ও পরে ১৮৭৬ এলাহাবাদ থেকে আরও ১৬ জন সুইপার আনা হয়। ১৮৮৪ সালে রাস্তায় প্রথম কেরোসিন বাতি জ্বালানো হয়। ১৯৩৫ সালে জমিদার মহারাজ শশীকান্ত আচার্য্য চৌধুরী নিজ প্রয়োজনে ডিসি পাওয়ার হাউস চালু করেন। মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরী শহরবাসীর সুপেয় পানির জন্য স্ত্রীর নামে চালু করেন রাজ রাজেশ্বরী ওয়াটার ওয়ার্কস। ১৮৯৩ সালে ময়মনসিংহ মিউনিসিপালিটি এর দায়িত্ব গ্রহণ করে। প্রথম শ্রেণীর ময়মনসিংহ পৌরসভা থেকে সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হয়েছে গত ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে। দুই দশমিক ১৫ বর্গমাইলের ময়মনসিংহ পৌরসভা সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হয়ে এর আয়তন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯০ বর্গ কিলোমিটার। ওয়ার্ড সংখ্যা ২১ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩টি। আর লোকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে আট লক্ষাধিক। ২৫ মাইলের রাস্তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১০০ কিলোমিটার। জলাবদ্ধতা দূরীকরণে আন্ডারগ্রাউন্ড প্রকল্পের সাফল্য ॥ একসময় ব্রহ্মপুত্র নদ ময়মনসিংহ শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হলেও নবগঠিত সিটি কর্পোরেশনকে এখন অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে। ব্রহ্মপুত্র পাড়ের ময়মনসিংহ নগরী উত্তর পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে ঢালু। ফলে বর্ষায় বৃষ্টির পানি ব্রহ্মপুত্র নদে না গড়িয়ে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে খাল দিয়ে নিষ্কাশিত হয়ে আসছে। এতে পানি সরে যেতে সময় লাগায় নগরীতে জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নেয়। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে নগরবাসীকে চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। প্রাচীন নগরী ময়মনসিংহের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় জলাবদ্ধতা। এমতাবস্থায় ময়মনসিংহ নগরকে জলাবদ্ধতা মুক্ত করতে মেয়র ইকরামুল হক টিটু ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নেন। সিটির নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মিঞা জানান, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন করে জলাবদ্ধতা দূরীকরণে আরবান গভর্নেন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট-ইউজিপ-২ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। দাতা সংস্থা জার্মানের কেডিএফ ও বাংলাদেশ সরকারের ২২ কোটি টাকা ব্যায়ে ড্রেন ও সড়ক উন্নয়নসহ মেছুয়া বাজারের পেয়াজের আড়ত উন্নয়ন করা হয় এসময়। প্রকল্প বাস্তবায়নে জলাবদ্ধতা দূরীকরণে তেমন কোন দৃশ্যমান উন্নয়ন না হলেও মেয়রের প্রচেষ্টার পাশাপাশি কাজের মান দেখে দাতা সংস্থা ইউজিপ-৩ প্রকল্পে নতুন করে অর্থায়ন করে। ড্রেন ও সড়ক উন্নয়ন ছাড়াও ফুটপাথ নির্মাণ ও পানি সরবরাহ প্যাকেজে ১১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। গত ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে আগামী ২০২১ সালে। প্রকল্পে রিজিট পেভমেন্ট চরিত্রের আরসিসি ১১৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন, ৩৮ কিলোমিটার আরসিসি ড্রেন নির্মাণ, ৩ কিলোমিটার ফুটপাথ ও ১১ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ লাইন নির্মাণ কাজ রয়েছে। নগরীর নতুন বাজার, রামবাবু রোড, সিকেঘোষ রোড, দুর্গাবাড়ি রোড, গাঙিনাপাড়, স্টেশন রোড, মহারাজা রোড, ট্রাঙ্কপট্টি, ছোট বাজার, বড় বাজারসহ রেললাইনের উত্তর পূর্বাংশের বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণে সড়কের দুইপাশে আরসিসি ড্রেন নির্মাণের পাশাপাশি সড়কের মাঝখান বরাবর আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ লাইন স্থাপন করা হয়। আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ ও আরসিসি ড্রেনের মাধ্যমে এসব এলাকার পানি ফেলা হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদে। ফলে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পর পরই বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকার পানি সহজেই নেমে যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদে। চলতি বর্ষা মৌশুম থেকেই এর সুফল পাচ্ছে নগরবাসী। তবে রেললাইনের দক্ষিণ ও পশ্চিমাংশের চরপাড়া, নয়াপাড়া, মাসকান্দা, ধোপাখলা, আরকে মিশন রোড, আকুয়া, নওমহল, কাচিঝুলি, কলেজ রোড, গুলকিবাড়ি, জিলাস্কুল, সানকিপাড়া, গোহাইলকান্দি ও আউটার স্টেডিয়াম এলাকায় এখনও রয়ে গেছে জলাবদ্ধতার সমস্যা। নতুন বাজার-গাঙিনাপাড়-স্টেশন রোডসহ আশপাশের বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকায় যেভাবে আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ স্থাপন ও আরসিসি ড্রেন নির্মাণ করে জলাবদ্ধতা দূর করা হয়েছে নগরীর দক্ষিণ পশ্চিমাংশের আবাসিক এলাকাতেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমস্যা সমাধানে দাবি উঠেছে। নয়া মাস্টারপ্ল্যানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জব্বারের মোড় থেকে ক্যাম্পাস হয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপের সাহায্যে পানি ফেলা হবে নদীতে। একইভাবে কলেজ রোড, হামিদ উদ্দিন রোডে আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ বসিয়ে কাচিঝুলি সঙ্গে সংযোগ করে কাটাখালি হয়ে পানি ফেলা হবে নদীতে। জলবায়ু পরিবর্তন তহবিল থেকে ইতোমধ্যে এ নিয়ে কাজ হয়েছে। কাঠগোলা ও কাশর এলাকার জলবদ্ধতা দূরীকরণে আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ বসিয়ে জেলখানা গেট হয়ে পানি ফেলা হবে ব্রহ্মপুত্র নদে। নগরীর পানি নিষ্কাশনে দক্ষিণ অংশে যে খাল রয়েছে সেটি দখলমুক্ত ও ড্রেজিং করে পানির প্রবাহ সচলসহ খালের দুইপাশে ওয়াকওয়ে তৈরিসহ খালের ওপর দৃষ্টিনন্দন কৃত্রিম ব্রিজ নির্মাণ করে নগরবাসীর বিনোদনের ব্যবস্থা করা হবে। ময়মনসিংহের সিটি মেয়র ইকরামুল হক টিটু জানান, পুরো নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণে মেগা প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সেভাবেই তৈরি হচ্ছে মাস্টারপ্ল্যান। ময়মনসিংহ সিটির এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন হলে নগরীতে জলাবদ্ধতার কোন সমস্যা থাকবে না বলে দাবি মেয়রের। ময়মনসিংহ সিটির মাস্টারপ্ল্যানে যা রয়েছে ॥ ময়মনসিংহের সিটি মেয়র ইকরামুল হক টিটু জানান, ময়মনসিংহ নগরীর উন্নয়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চান পরিকল্পিত নগরায়ন। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রত্যাশাকে মাথায় রেখে মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। নগর উন্নয়ন অধিদফতর ময়মনসিংহ সিটির মাস্টারপ্ল্যান তৈরির জন্য ড্রোনের সাাহয্যে একাধিকবার সার্ভে করেছে। আট লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ৯০ দশমিক ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যানের মধ্যে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র পাড়ের পৌর সুপার মার্কেট এলাকায় আধুনিক স্থাপত্য শৈলীর ২০ তলা বিশিষ্ট ময়মনসিংহ নগর ভবন নির্মাণ, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, নগরীর বাদেকল্পা এলাকায় ২৫ একর জমিতে চিড়িয়াখানাসহ শিশু পার্ক নির্মাণ এবং পাটগুদাম রেলব্রিজ থেকে ব্রহ্মপুত্র ব্রিজ পর্যন্ত ১০ একর জমিতে আলাদা শিশু পার্ক নির্মাণ, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, সড়ক বাতি স্থাপন, কবরস্থান, ঈদগাহ মাঠ, শ্মশানঘাট উন্নয়ন, পাটগুদাম ব্রীজ মোড় থেকে চায়না মোড়ের সাত একর জমিতে বাসটার্মিনাল স্থানান্তর এবং নগরীর শিকারীকান্দার আমলীতলায় ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ। পানি সরবরাহ ব্যবস্থার আধুনিকায়নে খাকডহরে ওয়াটার টিট্রমেন্ট প্লান্ট স্থাপন, চুরখাই, চরজেলখানা, শম্ভুগঞ্জ চায়না মোড়ের ময়লাকান্দা ও খাকডহর বাইপাস এলাকায় বর্জ্যরে ডাম্পিং স্টেশন, এই বর্জ্য থেকে ১০ মে.ও বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ, ব্রহ্মপুত্র নদের বেড়িবাঁধ বরাবর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে খাকডহর ঘুন্টি পর্যন্ত চারলেন সড়ক নির্মাণ, নগরীর মাঝখান থেকে রেললাইন সরিয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দীঘারকান্দা, আকুয়া বাদেকল্পা হয়ে খাকডহর ঘুন্টির সঙ্গে সংযোগ, নগরীর চরপাড়া মোড়, পাটগুদাম ব্রিজ মোড়, গাঙিনাপাড় ট্রাফিক মোড় ও কাচারি জিরো পয়েন্ট মোড়ে এসকেলেটরসহ ওভারব্রিজ নির্মাণ, চরপাড়া থেকে মালগুদাম হয়ে থানারঘাট এবং চরপাড়া থেকে পাটগুদাম ব্রিজ মোড় পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে মাস্টারপ্ল্যানে। এসবের বাইরে নগরীর ব্যস্ততম প্রাণকেন্দ্র থেকে রেললাইন সরিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ড অথবা ওভারহেড রেললাইন স্থাপন,নগরীর ভেতর সড়ক ও জনপথ বিভাগের আওতাধীন সিকেঘোষ রোড, আরকে মিশন রোড, রামবাবু রোড, গাঙিনপাড়, স্টেশন রোড, সাহেব আলী রোড, গার্লস ক্যাডেট কলেজ রোড, কংগ্রেস জুবলি রোড সম্প্রাসারণ করারও পরিকল্পনা রাখা হয়েছে মাস্টারপ্ল্যানে। ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী উপসচিব আনোয়ার হোসেন জানান, সিটি কর্পোরেশনের চাহিদামতো নগর উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ এই মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট প্রকাশের আগে নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষসহ স্থানীয় নানা শ্রেণী পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করবে। নতুন কোন প্রস্তাবনা থাকলে সেটি সংযোজন ও নেতিবাচক কিছু থাকলে সেটি বিযোজন করা হবে। সম্প্রসারিত ১২টি ওয়ার্ডে কর্মপরিকল্পনা ॥ গত ২০১৮ সালের অক্টোবরে ময়মনসিংহ সিটি ঘোষণার সময় পুরনো ২১টি ওয়ার্ডের সঙ্গে সিটি সম্প্রসারণ করে আরও নতুন ১২টি ওয়ার্ড যুক্ত করা হয়েছে। এসব ওয়ার্ডে নাগরিক কোন সুবিধা এসময়ে গড়ে উঠেনি। বিশেষ করে সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামো, সড়ক বাতির মাধ্যমে আলোর ব্যবস্থা, ময়লা আবর্জনার বর্জ্য অপসারণ, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ ও বিনোদনের কোন ব্যবস্থা নেই নয়া ১২টি ওয়ার্ডে। অথচ সিটি ঘোষণার পর থেকে সম্প্রসারিত ওয়ার্ডে সিটির কর যুক্ত হয়েছে। মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে সম্প্রসারিত ওয়ার্ডগুলোতে নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর দাবি করেছেন ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার নুরুল আমিন কালামসহ নগরবাসী। পানি, বিদ্যুত, বর্জ্য ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ॥ নগরবাসীর মধ্যে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহসহ সড়কে পর্যাপ্ত বাতির মাধ্যমে আলোর ব্যবস্থার পাশাপাশি বর্জ্য এবং ট্রাফিক ব্যস্থাপনা ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। এসব ব্যবস্থার বেশ কিছু উদ্যোগ ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ ইউজিপ-৩ প্রকল্পের আওতায় নগরীতে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের জন্য মাসকান্দা এলাকায় ৬ লাখ ৮০ হাজার লিটার ক্ষমতা সম্পন্ন ওভার হেড ট্যাংক নির্মানসহ ১৫টি প্রডাকশন টিউবওয়েল স্থাপন ও ২৪ কিলোমিটার সরবরাহ লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। পুরনো ২১টি ওয়ার্ডে ১৭০ কিলোমিটার এলাকায় ১৮ হাজার ২০০ সড়ক বাতির সংযোগ রয়েছে। সম্প্রসারিত ১২টিসহ ৩৩টি ওয়ার্ডেও আরও ৬০০ কিলোমিটার সড়কে ৫০ হাজার ৮০০ এলএডি বাতির সংযোগ দেয়ার পরিকল্পা রয়েছে। পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকায় নগরীর এসব ওয়ার্ডে চুরি ছিনতাইসহ ছোটখাটো অপরাধের মাত্রা কমে আসছে বলে দাবি সিটি কর্তৃপক্ষের। সিটি কর্পোরেশনের সহকারী প্রকৌশলী জিল্লুর রহমান জানান, নগরীতে পানির চাহিদা রয়েছে ৩ কোটি ৭৫ লাখ লিটার। বিপরীতে সরবরাহ করা হচ্ছে ২ কোটি ১৫ লাখ লিটার। সাত হাজার ৮৫৫ জন গ্রাহকের কাছে ১৬৩ কিলোমিটার পাইপ লাইনের সাহায্যে প্রতিদিন এই পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। ৩টি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান স্থাপন করে আরও ১৫০ কিলোমিটার পাইপ লাইন স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। নগরীতে প্রতিদিন ২৮০ টন ময়লা আবর্জনার বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। দৈনিক অপসারণ করা হচ্ছে ২০০ টন ময়লা আবর্জনার বর্জ্য। বাড়তি ৮০ টন ময়লা আবর্জনার বর্জ্য অপসারণসহ পরিচ্ছন্ন নগরী গড়তে সিটি মেয়র পরিচ্ছন্ন কর্মী নিয়োগের পাশাপাশি নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছেন। দিনের বদলে রাতের বেলায় ময়লা আবর্জনা অপসারণের কাজ চলছে এখন। তবে সমস্যা হচ্ছে ময়লাবাহী যানবাহনের সঙ্কট। ফলে নগরীর প্রধান সড়ক ও বাণিজ্যিক এলাকাসমূহ কিছুটা পরিচ্ছন্ন দেখা গেলেও অলিগলির চেহারা এখনও আগের মত। তবে পরিচ্ছন্ন নগরী গড়তে নগরবাসীর আন্তরিক সহযোগিতা চেয়েছেন সিটি মেয়র। চিরচেনা যানজটের নগরী বলে খ্যাত ময়মনসিংহের ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নেও নানামুখী পদক্ষেপের কথা জানান সিটি মেয়র। ময়মনসিংহে বিএনপি নেতা এ্যাডভোকেট আব্দুল হান্নান খান জানান, যানজট নিরসনে নগরীর প্রধান সড়কগুলো সম্প্রসারণ ছাড়া বিকল্প নেই। নগরীর বিউটিফিকেশন ও বিনোদনেও নতুন মাত্রা ॥ নগরীর সৌন্দর্য বর্ধনে মোড়ে মোড়ে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন সুন্দর স্থাপত্যশৈলীর নানা শিল্পকর্ম। সিটি কর্পোরেশন মোড়ে ‘৫২ থেকে ৭১’ স্মৃতি অম্লান, পাটগুদাম র‌্যালি মোড়ে বিজয় একাত্তর, জিলা স্কুল মোড়ে বর্ণমালা, ফুলবাড়িয়া পুরাতন বাসস্ট্যান্ড মোড়ে শিক্ষা শেকড়, কাচারি মসজিদ মোড়ে আলোর দিশারি, চক বাজার বড় মসজিদ মোড়ে ইকরা, টাউনহল প্রাঙ্গণে ভাষা সৈনিক শামছুল হক মঞ্চ, টাউনহল মোড়ে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্কয়ার, চরপাড়া মোড়ে টাইম স্কয়ার, কাচিঝুলী মোড়ে আলোক বর্তিকা, মহারাজা রোডে তিন সত্য, মহিলা ডিগ্রী কলেজ মোড়ে আলোকিত বাংলা, সার্কিট হাউস পার্কে ক্রীড়াঙ্গন, গাঙিনাপাড় ট্রাফিক মোড়ে শাপলা চত্বর ও নতুন বাজার মোড়ে নির্মাণ করা হয়েছে পায়রা চত্বর। এসব স্থাপত্যশৈলীর বাইরে নগরীর পুরনো ব্রহ্মপুত্র পাড়ের ছায়াশীতল জয়নুল উদ্যানের ভেতর শিশু কিশোরদের বিনোদনে করা হয়েছে মিনি চিড়িয়াখানা, ট্রেন জার্নি, ম্যাজিক বোট, নাগরদোলাসহ বিনোদনের নানার আয়োজন। নৈসর্গিক পরিবেশের জয়নুল উদ্যানকেও সাজানো হয়েছে নতুন করে। সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার ছুটির দিনসহ বাংলা নববর্ষ এবং বিশেষ দিনগুলোতে হাজারো মানুষের ঢল নামছে এই উদ্যানে। নাগরিক নেতৃবৃন্দ যা বলেন ॥ ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান খান জানান, নগরবাসীকে স্বস্তি দিতে সিটি মেয়র নানামুখী উদ্যোগ নিলেও এখনও রয়েছে হাজারো সমস্যা। অপ্রশস্ত বেহাল দশার রাস্তাঘাট, ময়লা আবর্জনার বর্জ্য, যানজটের অসহনীয় যন্ত্রণা ও জলাবদ্ধতাসহ ফুটপাথ-সড়ক জবরদখলের মতো সমস্যা নগরবাসীর ভোগান্তি বাড়িয়ে তুলছে। সম্প্রসারিত নতুন ১২টি ওয়ার্ডে নাগরিক সুবিধা নেই বললেই চলে। মাস্টারপ্ল্যান করে দ্রুত এসব সমস্যা সমাধানের দাবি জানান এই নাগরিক নেতা। সিটি মেয়র উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে যা বলেন ॥ নবগঠিত ময়মনসিংহ সিটির প্রথম মেয়র ইকরামুল হক টিটু জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ট নেতৃত্বে দেশের প্রতিটি এলাকায় অভাবনীয় যে দৃশ্যমান উন্নয়ন হচ্ছে তারই ধারাবাহিকতায় ময়মনসিংহ সিটির উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভিশন বাস্তবায়নে ময়মনসিংহ সিটি মেয়র নানা শ্রেণী পেশার নাগরিকদের আন্তরিক সহাযোগিতা চেয়েছেন। বিশেষ করে জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, ময়লা আবর্জনার বর্জ্য অপসারণ, যানজটমুক্ত পরিবেশবান্ধব গ্রীন সিটি গড়তে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নের পাশাপাশি নাগরিকদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় করে সকল সমস্যা সমাধানে প্রস্তাবনা গ্রহণ করা হবে বলে জানান সিটি মেয়র।
×