ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিবাচক সমালোচনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন

প্রকাশিত: ০৯:২০, ৭ আগস্ট ২০১৯

ইতিবাচক সমালোচনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন

সাম্প্রতিক একের পর এক ঘটনার সূত্রপাতে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার শিরোনাম হয়েছে। মূল গণমাধ্যমের আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিটি ঘটনার সূত্র ধরে ছবি, ভিডিও ভাইরাল করে নানা জনে নানা ধরনের মত প্রকাশ করেছে। আবার সোশ্যাল মিডিয়ার এই মতামতকেও বেশ গুরুত্ব দিয়েছে দেশের প্রধান প্রধান গণমাধ্যম। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ রাজনৈতিক সচেতন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ, জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রতি অনেক মনোযোগী যার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে- এই সোশ্যাল মিডিয়া। অন্যদিকে ভয়ানকভাবে ছড়িয়ে পড়া গুজব আর গণপিটুনিও প্রায় রোধ করা সম্ভব হয়েছে কতিপয় সাহসী অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ও সংবাদকর্মীদের ভাইরাল করা সঠিক তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে। আর এখন লড়াই করছে ‘ডেঙ্গু মশা’র মরণ কামড় থেকে প্রতিটি মানুষকে কিভাবে সাবধান, সচেতন করা যায় নিয়ে। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ প্রায়ই তাঁর হাস্যরসাত্মক কথার জন্য বেশ আলোচিত এবং অনুষ্ঠানের প্রতিটি দর্শক-শ্রোতা মনোমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন, সবার মনোযোগ কেড়ে নেন। শুধু অনুষ্ঠানে উপস্থিত সুধীজনরাই নন, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি দেখার কারণে আমরা অনেকেই তাঁর ভাষণ ‘উপভোগ’ করেছি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশে আসা প্রিয়াঙ্কা চোপড়াকে নিয়ে হাস্যরসাত্মকভাবে ৫১তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে বললাম এবার তো প্রিয়াঙ্কা চোপড়া আসছে। পরে বুঝলাম না, এই কথা বলেছি একদিন আগে। পরে শুনেছি সে নাকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে টেলিফোন করে বলেছে এই প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার বঙ্গভবনে আসার কী দরকার। এটা একটা ষড়যন্ত্র। শেষ পর্যন্ত প্রিয়াঙ্কা চোপড়া বঙ্গভবনে আসেনি।’ পাঠক! কথাগুলো এখানে উল্লেখ করেছি এই কারণে, মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ওই হাস্যরসাত্মক কথাগুলোর বিপরীতেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে সমালোচনা করেছে। অর্থাৎ, বুঝে হোক, আর না বুঝেই হোক- একমাত্র ‘বাংলাদেশ’ যেখানে প্রতিটি মানুষের মতামত প্রকাশ করার, নিজের বিচার-বিশ্লেষণ তুলে ধরার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। আমিও ব্যক্তিগতভাবে অধিকাংশ সমালোচনাকে ইতিবাচক বলেই মনে করি। ফেনীর সোনাগাজীর নুসরাত হত্যার ঘটনা, দায়িত্বপ্রাপ্ত এসপি, ওসি, ওসি তদন্তসহ কতিপয় সংবাদকর্মীর পক্ষপাতদুষ্ট কার্যক্রমকে কেউ সমর্থন করেনি বরং প্রতিবাদ করার পাশাপাশি মাঠে আন্দোলন করার মধ্য দিয়ে এক ধরনের সামাজিক বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। শনিবার (১৩ এপ্রিল, ২০১৯) জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্বর ফেনী সোনাগাজী মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের খুনিদের ৯০ দিনের মধ্যে ফাঁসির দাবি নিয়ে আপীল বিভাগের (অব.) বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক সাহেবকে প্রধান অতিথি করে অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ) নেতৃবৃন্দও মানববন্ধন করেছে। সারাদেশে খুনের বিরুদ্ধে, অপরাধীর শাস্তির দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। এমনি করে বরগুনার নয়ন বন্ড কর্তৃক রিফাত হত্যার ঘটনাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সামালোচনা, প্রতিবাদসহ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আরেকটি ইতিবাচক পটভূমি সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসন তৎপর হয়েছে। গণমাধ্যম সতর্কতার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশ করার ক্ষেত্রে প্রতিটি ঘটনার সূত্রপাত অনুসন্ধান করে দেশ ও জাতির সামনে তুলে ধরেছে। সে সঙ্গে সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের কী করণীয়, অনেক গণমাধ্যম তাদের লেখনি, খবর পরিবেশনসহ নিজেদের মতামত তুলে ধরে পথ দেখানোর দায়িত্বটুকুও যেন গ্রহণ করেছে। কতিপয় সংবাদকর্মী বা সাংবাদিক যেভাবে সরকারের মন্ত্রী, এমপি বা সরকারের উর্ধতন কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করেন, প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন কিংবা জবাবদিহিতার আওতায় আনার এক ধরনের আন্তরিক চেষ্টা করেন- এটিও আমার জানা মতে ‘বাংলাদেশ’ সত্যিই এখানেও এক চমৎকার উদাহরণ। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করার সময় আইনের দিকটি খুব মনে রাখে বলে আমার কাছে তা মনে হয় না। কিছু একটা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার আগেই নিজের মতামতগুলো প্রকাশ করে থাকে, যেখানে থাকে না কোন গবেষণা বা তথ্যনির্ভর কোন গণমাধ্যমের সূত্র! আর এই মতামত অনেক সময় ব্যক্তিগত আক্রমণও হয়ে পড়ে। আবার অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের এখানে কতিপয় গণমাধ্যম আছে যারা হয়তো ভুলে নয়তো ইচ্ছাকৃতভাবেই বিতর্ক সৃষ্টি করে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচার জন্ম দিয়ে থাকে। ১৮ জুলাই, ২০১৯ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে ‘সরকারি কর্মকর্তারা সরল বিশ্বাসে দুর্নীতি করলে অপরাধ হবে না: দুদক চেয়ারম্যান’-এর শিরোনামের সংবাদ নিয়ে মুহুর্তের মধ্যেই তীব্র ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ে। আর চারদিকে সমালোচনা শুরু হয়। আমিও প্রথম অবাক হয়েছি এবং প্রশ্নও করেছি, দুর্নীতির সরল বিশ্বাস কী..? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেছি, দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদকে তুলোধুনো করা হচ্ছে। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, দুর্নীতি দমন যার কাজ তিনি কীভাবে দুর্নীতি করতে উৎসাহবোধ করতে এমন বক্তব্য দিলেন? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সেই গ্রামের চায়ের দোকানসহ সব জায়গায় আলোচনার বিষয়- ‘সরল বিশ্বাসে দুর্নীতি করলে অপরাধ না’। সর্বত্রই যখন এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তখন আমি কৌতুহলবশত খোঁজ-খবর নিয়ে দেখি, ডিসি সম্মেলন শেষ করে বের হওয়ার সময় দুদক চেয়ারম্যান সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। সংবাদকর্মীর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘পেনাল কোডেই বলা আছে যে, সরল বিশ্বাসে কৃতকর্ম কোন অপরাধ নয়। এবহবৎধষ ঊীপবঢ়ঃরড়হ বলে এটাকে। তবে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে সরল বিশ্বাসে আপনি এ কাজটি করেছেন।’ অথচ, এখানে কথাটি ভুলভাবে তুলে ধরেছে কতিপয় সংবাদ মাধ্যম যা ক্ষণিকের মধ্যেই সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছে। আমরা অনেকেই জেনেশোনে অথবা অজ্ঞতার কারণে নেতিবাচক বা ইতিবাচক শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় ভুল করে থাকি। আবার প্রতিবাদ করার সময় ব্যক্তিগত আক্রমণসহ ‘হত্যার বদলে হত্যা’ করা উচিত বলেও অপরাধ প্রবণতার দিকে মনের অজান্তেই হয়তো অন্যদের উদ্বুদ্ধ করে থাকি। একজন যুগ্ম সচিবের অপেক্ষায় তিন ঘণ্টা ফেরি না ছাড়ায় এ্যাম্বুল্যান্সে স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে অনেকে ওই যুগ্ম সচিবের পারিবারিক ছবিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে তার ছেলেমেয়ের দিকে ইঙ্গিত করে লিখেছে, ‘তিতাসের বাবা-মা যেমন কষ্ট পাচ্ছে, ঠিক তেমনি এই ভিআইপির এমন ক্ষতি করে কি হিসাব সমান সমান করা যায় না।’ আমি মনে করি, আমাদের ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করতে হবে। ব্যক্তির অপরাধ পরিবারকে জড়ানো মানে ওই পরিবারের অন্য সদস্যদের নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করা। যেখানেই অসঙ্গতি সেখানেই আমাদের মতামতসহ তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সঠিক পথের আহ্বান থাকতে পারে। কারণ, আপনার/আমার আমাদের সঠিক তথ্যের কারণেই পরাজিত হয়েছে কোটা সংস্কারের আন্দোলনের গুজব। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে ইতিবাচক সমালোচনা, সময় উপযোগী আলোচনা এবং প্রযুক্তিনির্ভর স্ট্যাটাস-ছবি ভাইরাল করে সত্য তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছি যেÑ রাজাকার সাঈদীর ছবি চাঁদের বুকে দেখা গিয়েছে- এটি ছিল স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারের পরিকল্পিত মিথ্যাচার। এখানে মনে রাখা দরকার, শেখ হাসিনা কখনও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়নি এবং তিঁনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন, কোন অপরাধী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কিংবা তার সরকারের কোন উর্ধতন কর্মকর্তা হলেও তাকে ছাড় দেয়া হবে না। আর এটির বাস্তবায়নও আমরা দেখেছি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বরখাস্ত পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরের সঙ্গে ঘুষ লেনদেনে জড়ানোর অভিযোগ পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমানকে আইনের আওতায় এনেছে সরকার। অন্যদিকে ৮০ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন্স) পার্থ গোপাল বণিককে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের মামলায় কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। সরকারের পরিচালিত রাষ্ট্রযন্ত্রের উর্ধতন কর্মকর্তা থেকে সরকারী অফিসের পিয়নও অপরাধ করে পাড় পাওয়ার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। আমাদের ইতিবাচক আলোচনা-সমালোচনাকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন, আমলে নিচ্ছেন। নির্দেশ দিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সেটির মনিটরিংও করছেন। আমি মনে করি, আমাদের সবাইকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তথ্যনির্ভর আলোচনা-সমালোচনা করতে হবে। ব্যক্তিগত আক্রমণ, অন্যের ক্ষতি চাওয়া, অপমান-অপদস্ত করা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। যার যতটুকু সম্মান তা প্রদান করাই আমাদের ব্যক্তিত্ব এবং মনুষ্যত্বের প্রকাশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার হতে পারে মানুষের কল্যাণে, জনসাধারণের সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এবং সর্বোপরি শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষা প্রদান করার লক্ষ্য নিয়ে। অন্যদিকে মিথ্যা-গুজবের বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিরোধে আমাদের সবাইকে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরাই হোক প্রকৃত সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)
×