ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাহমান ওয়াহিদ

মেঘের ডানায় সমুদ্র ছোঁয়া

প্রকাশিত: ০৮:১৭, ৫ জুলাই ২০১৯

 মেঘের ডানায় সমুদ্র ছোঁয়া

‘কী যে বল? সেই কপাল আমার? প্রথম বাচ্চার পরেই বাবা চলে গেলেন ওপারে। সেই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই স্বামীটির বদলি। আমাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল। যাইনি। রাজশাহীর এই সুন্দর শহর ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করেনি। বাবার হাত ধরে সমুদ্র দেখতে চেয়েছিলাম। হলো না। স্বামীর যা ইনকাম তাতে সংসারের চাকাটাই শুধু ঘোরে। আর কিছু না। বেড়ানো হবে কোত্থেকে? শেষ পর্যন্ত সেই ইচ্ছেটাকেই গলা টিপে মেরে ফেলেছি।’ ‘কেন, গলা টিপে মারতে হবে ক্যানো? আমি আছি না?’ ‘তুমি থেকে কী করবে?’ ‘তেমন কিছু না। অন্তত সমুদ্রকে ছুঁয়ে দেখার কাজটি করতে পারি তোমাকে নিয়ে। দারুণ এক আইডিয়া আছে আমার মাথায়। তুমি শুধু রাজি হলেই হবে। আর কিচ্ছু না।’ ‘কী বলছো এসব পাগলের মতো? মাথা ঠিক আছে তো?’ ‘মাথা টাথা সব ঠিক আছে। তুমি শুধু বল যাবে কিনা। তারপর সব বুঝিয়ে বলছি।’ এই বলাবলির একটা শানে নযুল আছে। এই ফাঁকে সেটি একটু জেনে নেয়া যাক। আমি রাকিব হাসান। এক বেসরকারি কোম্পানির আঞ্চলিক ম্যানেজার। পোস্টিং ঢাকায়। এক সন্তানের জনক। কথা বলছিল যে মেয়েটি, সে শিরিন আখতার। রাজশাহীর পদ্মাপাড়ের মেয়ে। ভালো ছাত্রী হিসেবে ইন্টার পাস করার পর ইচ্ছে ছিল-আরো পড়াশোনা করার। কিন্তু অসুস্থ বাবা সে সময়টুকু তাকে আর দেননি। তড়িঘড়ি করে ওই অল্প বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় শিরিনকে। স্বামী আধা সরকারি এক অফিসের টেকনিক্যাল অফিসার। রাজশাহীতে ছিলেন। এখন ঢাকায়। আমি তাদের পারিবারিক বন্ধু। তবে স্বামীটি বদলি হয়ে যাবার পর বন্ধুত্বটি আর সে পর্যায়ে থাকেনি। ফোনে ফোনে তা জমে উঠেছে শিরিনের সাথেই। তো দুই ছেলেমেয়ের জননী শিরিন এখনও দেখতে দারুণ। স্লিম, সুদর্শনা এবং চোখে আটকে যাবার মতো মেয়ে। এ নিয়ে আরো যা যা বলার আছে তা আমাদের কথোপকথনেই এসে যাবে। সো, যাওয়া যাক শিরিনের কথায়। সে বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে বললাম যাবো। কিন্তু ঘর থেকে বেরোতে পারবো না, বলে দিচ্ছি।’ ‘ওকে ফাইন। ঘর থেকে বেরোনোর দরকার হবে না। ইভেন লেপের মধ্যে শুয়ে থেকেও বেড়াতে পারবে। তুমি শুধু কথা বলার নিরিবিলি সময়টা দেবে। কেউ যেন ওই সময় ডিস্টার্ব না করে।’ ‘তো কত মিনিট, ঘণ্টা বা বছর লাগবে এ ভ্রমণে জনাব?’ ফোনের অন্য প্রান্তে শিরিনের অবিশ্বাসী হাসি। ‘ইয়ার্কি মারছো? ব্যাপারটা মোটেও সে রকম না। মাত্র বাহাত্তর ঘণ্টার, আই মিন তিন দিনের প্লেজার ট্রিপ। ফোনে ফোনে ভ্রমণ। ঘণ্টায় বিশ ঘণ্টাও এগোতে পারি, আবার বত্রিশ ঘণ্টাও যেতে পারি। এভাবে বাহাত্তর ঘণ্টা হলেই শেষ। বুঝেছ?’ ‘বুঝলাম। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো, আর কি। তবে আইডিয়াটা মন্দ না।’ ‘ব্যাপারটা উল্টোও তো হতে পারে। আই মীন ঘোলের স্বাদ দুধে মেটানো। হতে পারে না? ‘সেটা আবার কেমন?’ ‘ক্যানো, প্রাক্টিক্যাল ভ্রমণে ট্রাফিক জ্যাম, অসুখ বিসুখ-এ রকম কত ফ্যাকড়া বাট আমার এ আইডিয়ায় এ রকম কিচ্ছু নেই। আমরা মন উজাড় করে কথা বলতে পারলে হান্ড্রেড পার্সেন্ট আনন্দই পেতে পারি। তবে তোমাকেও কোঅপারেট করতে হবে। রেসপন্স করতে হবে। নিজের থেকেও কথা বলতে হবে। মানে একটু অভিনয়ের মতো আর কি। পারবে না?’ ‘সেটা না হয় পারা যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন ছেলেমানুষি হয়ে যাচ্ছে না?’ ‘হ্যাঁ, ছেলেমানুষিই তো। এই যে আমরা একটু ফাঁক পেলেই দুজন দুজনের সংসার থেকে আলাদা হয়ে দিনের পর দিন কথা বলে যাচ্ছি, নির্জনতার নিঝুম দ্বীপে স্বপ্নের স্বর্গ গড়ে চলেছি-এটা কী? কেউ কাউকে কোনদিন পাবো না জেনেও ইথারে ইথারে কত যে ভালোবাসার রঙ স্পর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছি-এটা কী? ছেলেমানুষি পাগলামিই তো। এটাকে আরেকটু ছড়িয়ে দিয়ে সমুদ্র ছুঁতে গেলে সমস্যা কী?’ ‘কিন্তু আমার যে সত্যি সত্যিই ইচ্ছে করে রাকিব এই বাঁধন ছিঁড়ে কোথাও হারিয়ে যেতে। এই সংসারের টানাটানি আর ভাল্লাগে না। এমন একটা মানুষকে পেলাম যে এসব বেড়ানো, আবেগ ভালোবাসার কিচ্ছু বোঝে না। ভালোবাসাটা যখন বুঝতে শিখলাম, তখন দেখি একটা ভুল মানুষের সংসারে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি।’ মনটা খারাপ হতে থাকে শিরিনের। ‘প্লিজ শিরিন, মন খারাপ করো না। ভুল মানুষ তো জুটেছে আমারও। কোথাও বেড়াতে গেলে সে মানুষটা প্রকৃতির এই অপার সোন্দর্যের কিছুই দেখে না। বোঝে না। তার দুচোখ শুধু সার্চ করে অন্য কিছু। পায়ে পা মিলিয়ে একসঙ্গে হাঁটতেও জানে না। তারপরেও তো তাকে নিয়েই হাঁটতে হচ্ছে এই জগত সংসারে।’ ‘হ্যাঁ, এছাড়া আর উপায় কী? এই কষ্টে আমিও তোমার কোন কাজে আসতে পারলাম না।’ ‘না শিরিন, কাজে আসো নি কে বলেছে? দম ফেলবার মতো ছোট্ট একটা খোলা জানালা তো হয়ে আছো তুমিই। এ পাওয়া কি কম, বল?’ ‘ওই রকম একটা জানালা তো তুমি আমারও। তোমাকে এভাবে না পেলে কী যে করতাম জানি না। থাক সে কথা। তুমি কি এক আইডিয়ার কথা বলছিলে, সেটা একটু শুনি। আর কিছু না হোক- তোমার কথার যাদুর ছোঁয়া তো কিছু পাবো। সেটুকুই বা মন্দ কী? বল।’ ‘ভেরি গুড। এই তো লক্ষ্মী মেয়ের মতো কথা। আইডিয়াটা তো বলবোই, তবে তার আগে বল কখন থেকে শুরু করবে?’ ‘এখন তো রাত সাড়ে আটটা। তোমার বন্ধুটি সাড়ে দশটায় ঘুমিয়ে পড়বে। ছেলে মেয়েরাও বেডে যাবে প্রায় একই সময়ে। এগারোটা থেকে শুরু করতে পারো।’ ‘ওকে।’ ০২. রাত এগারোটা। শিরিনের ফোন বেজে ওঠে। তার মানে আমাদের পরিকল্পিত ভ্রমণের সূচনা হতে যাচ্ছে। চলুন পাঠক, যাওয়া যাক সেই হাওয়াই ভ্রমণে। ‘বল।’ ‘তুমি কি রেডি শিরিন?’ ‘হ্যাঁ। এভরিথিং ওকে।’ ‘ওকে ফাইন। শোন। আমরা এখন থেকেই স্টার্ট করছি। তো আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ ‘রাজশাহী থেকে কক্সবাজার। সমুদ্র সৈকতে।’ ‘না। রাজশাহী থেকে তুমি ভার্সিটির ছুটিতে ঢাকায় এসেছ। নভেম্বরের লাস্ট উইকে। সেকেন্ড সেমিস্টার শেষ। সেই ছুটিতে। উঠেছ তোমার খালার বাসায়। বান্ধবীদের সাথে কক্সবাজারে যাচ্ছো আনন্দ ভ্রমণে। কিন্তু আসলে যাচ্ছো আমার সাথে। আর আমি ভার্সিটি থেকে বেরিয়েই ঢাকার একটা অফিসে মাস ছয়েক আগে জয়েন করেছি। ছুটি নিয়েছি। তোমার সাথে প্রোগ্রাম, তাই। তার মানে সময়টাকে আমরা সাত বছর পেছনে নিয়ে যাচ্ছি। এ্যান্ড নাউ উই আর আনম্যারেড। আমাদের প্লেজার ট্রিপ শুরু হচ্ছে আগামীকাল রোববার সকাল থেকে। এবং শেষ হবে বুধবার সকালে। তার মানে বাহাত্তর ঘণ্টার প্লেজার ট্রিপ। বোঝা গেল?’ ‘বুঝেছি। কিন্তু আনন্দ করতে গিয়ে এতগুলো মিথ্যে বলতে হবে? অন্যকোনভাবে শুরু করা যায় না? ‘না সোনা। বর্তমানকে বেছে নিলে স্বামী সংসার বাচ্চা এসব সামাল দেয়ার ব্যাপারগুলো এসে যাবে। আরো বেশি মিথ্যে বলতে হবে। তারচেয়ে একটু পেছনে ফিরে সেই বন্ধনহীন উচ্ছল তারুণ্যের মজা নেয়াটাই কি ভালো না? পুরোটাই তো কল্পনায় ভেসে চলা। ভিন্ন এক ভুবনে ইচ্ছেমতোন ঘুরে বেড়ানো। নেই শাসন, নেই নিয়ম, নেই বাঁধন বারণ। এর মধ্যে সত্যি মিথ্যে নিয়ে ভাবাভাবির দরকার কী? বাহাত্তর ঘণ্টা পরেই তো আবার সেই বর্তমান। তুমি যেমন ফিরে যাবে সেই চেনা সংসারে, রান্না খাওয়া, ঝুট ঝামেলায়, তেমনি আমাকেও যেতে হবে নিরানন্দ সংসার যাপনে, সেই চেনা অফিস, চেনা চেয়ারে। সো নো আপত্তি। ‘ওকে। নো আপত্তি। বল কী করতে হবে।’ শিরিনের মুখে উচ্ছ্বাসের ধ্বনি ইথারে ছড়িয়ে পড়ে। ‘গুড। এখন তাহলে ট্যুর প্লানটা শোন। সময়টা ধরে নাও কালকের ভোর মানে রোববারের সাড়ে পাঁচটা। সকাল সাতটার আন্তঃনগর ট্রেনে চিটাগাং যাবার জন্য আমরা যার যার ঘরে রেডি হচ্ছি। সাড়ে ছয়টার মধ্যে আমরা দুজনই কমলাপুর স্টেশনে যাবো। দুজনের টিকেট আমার পকেটে। তুমি আসছো নয়াপল্টন থেকে, আর আমি মালিবাগ থেকে। সুটকেসে যা যা নেবার নেবে। তবে আমার দেয়া সেই লম্বা সাদা তোয়ালেটা নিতে ভুলো না। হোটেলে গোসলের পরে ওটা দিয়ে মাথা বাঁধলে চমৎকার দেখাবে তোমাকে।’ ‘হোটেলে! একই রুমে?...’ ‘ক্যানো সমস্যা কি? ম্যারেড ডিক্লেয়ার দিয়ে রুম নিয়ে নেব। না হলে দু’ দুটো রাত কাটাবো কোথায়, গাছতলায়?’ ‘না মানে..কোন আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়িতে...আমার এক কাজিন থাকে চিটগাং এ।...’ ‘কী যে বল না তুমি শিরিন...চুরি করে ভ্রমণ আমাদের...তাছাড়া সত্যি সত্যি তো কোন হোটেলে উঠছি না আমরা..’ ‘তবুও ক্যামোন লাগে না ব্যাপারটা? ম্যারেড বললেই তো এক বেডের একটা রুম, ...আর রুমে ঢোকা মানেই তোমার এক গাদা দুষ্টুমি, জ্বালাতন। এমনিতে ফোনেই পাগলের মতো যা কর তুমি..’. ‘ইশ্, তোমাকে নিয়ে আর পারি না। বারবার ফিরে যাচ্ছো সেই আগের জায়গাটায়। ক্যানো বুঝছো না যে ব্যাপারটা ¯্রফে একটা ইমাজিনারি, নাথিং এল্স। আচ্ছা ঠিক আছে, এ নিয়ে আর কথা নয়। তুমি খাটের ওপর চুপটি করে বসে থেকো আর আমি নাক ডেকে ঘুমাবো। ওকে?’ ‘নো, আমরা দুজনই বসে বসে গল্প করবো। নো শোয়াশুয়ি।’ ‘অচ্ছা ঠিক আছে। তাহাই হইবে ম্যাডাম।’ এরপর ফোনে একটু বিরতি। মিনিট পাঁচেক পরে আবারো... ‘এই মেয়ে শুনছো তো?’ ‘শুনছি। বল।’ ‘আমরা ট্রেনে উঠেছি। এসি কম্পাটমেন্টে দুজনে পাশাপাশি বসেছি। তোমার পরনে চমৎকার থ্রিপিস। মানিয়েছে দারুণ। আর দেখতেও যা হয়েছ না...ওই বয়সে তুমি এ্যাতোটাই সুন্দর ছিলে!’ ‘তুমিও কম কী? একেবারে রোমিও হয়ে বসে আছো। জুলিয়েট টুলিয়েট পেয়েছিলে নাকি কাউকে?’ ‘পেতেও পারি। তবে তোমার মতো না। আমার কালো ট্রাউজারের ওপর তোমার পছন্দের স্কাই ব্লু ফুল স্লিভ শার্ট। টাইটাও ম্যাচিং। কেমন লাগছে আমাকে?’ ‘দারুণ। তবে ম্যাচিং সানগ্লাসটা পরলে আরো ভালো হতো।’ ‘ঠিক আছে। ওটা সী বিচে বা অন্য কোথাও না হয় পরে নেব। তো এখন আরেকটা ম্যাচিং এ গেলে হয় না?’ ‘কী সেটা?’ শিরিনের অবাক চোখ। আর আমার গলায় ফিসফিস- ‘তেমন কিছু না। দুজনের চেয়ারের মাঝখানে হাত রাখার জায়গা মাত্র একটি। তো আমাদের হাত দুটোকে এভাবে আলাদা করে কোলের ওপর রাখার দরকার কি? ওই জায়গাটায় একটু ওপর নিচে করে রাখা যায় না?’ শিরিনের মুখে মৃদু শাসন। ‘তার মানে দুষ্টুমি শুরু হয়ে গ্যালো?’ ‘দুষ্টুমি হবে ক্যানো? বন্ধুত্ব মানেই তো মনে মন, হাতে হাত। তাছাড়া ট্রেনের প্যাসেঞ্জাররাও ভাবছে আমরা নতুন কাপ্ল, হানিমুনে যাচ্ছি কোথাও। হাতে হাত হতেই পারে। ঠিক কিনা।’ শিরিন প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলে, ‘ঠিক বেঠিক জানি না। এখন একটু চা খাবো। ট্রেনের নোংরা চা আমি খেতে পারবো না। তাই ফ্লাস্ক এনেছি। সাথে দুটো কাপও।’ চা খেতে খেতে কথা হয় আমাদের। অনেক অনেক কথা। শিরিনের অস্বস্তি ভাবটা এখন আর নেই। এ রকম একটা বায়বীয় ভ্রমণের সাথে নিজেকে এ্যাড্জাস্ট করে ফেলেছে বেশ ভালো করেই। আমার কথার রেশ টেনে রেসপন্সও করছে বেশ ভালো। ট্রেন চলছে। বেশ দ্রুতই। নন স্টপ সার্ভিস। ফেনী পেরিয়ে এসেছি কিছুক্ষণ আগে। আমাদের জোড়া হাতের দশটি আঙ্গুল আনমনে খেলা করে চলেছে। আঙ্গুলগুলোর ভেতর দিয়ে সঞ্চারিত হয়ে চলেছে রোমাঞ্চকর ভালোলাগা। শিরিনের নীরব প্রশ্রয়ে ভালোলাগাটা ক্রমশ বেড়ে যেতে থাকে। ট্রেনের হালকা দুলুনিতে এক সময় ঘুম পেয়ে যায় শিরিনের। ঘুম ঘুম মাথাটা আলতো করে রাখে আমার কাঁধে। আমার সায় পেয়ে মিষ্টি করে হাসেও একবার। তারপর হাত দুটো দিয়ে কাঁধের দুপাশ চেপে ধরে মাথাটা নিজের সুবিধেমতো করে রেখে ঘুমিয়ে পড়ে শিরিন। তো ভালোই লাগছিল আমার। মনে হচ্ছিল-সত্যিই যেন আমরা হানিমুনে যাচ্ছি। সত্যিই যদি এমনটা হতো! আহা, সত্যিই যদি ফিরে না যেতে হতো সেই অসহ্য সংসারে! ট্রেনটাও যদি কোনদিন কোথাও না থামতো! ০৩. কিন্তু সব কিছুর মতো স্বপ্নের ট্রেনও এক সময় থামে। নেমে যেতেই হয় চট্টগ্রামের বিশাল স্টেশনে। সেখান থেকে রিকশায় চড়ে সোজা এক হেটেলে। তখন বেলা দুটোর কিছু বেশি। চমৎকার টিপটপ একটা রুমে ঢুকে দরোজা লাগাতেই শিরিনের বিস্ময়, ‘এই, এটা কী? দরোজা লাগাচ্ছো ক্যানো?’ ‘ক্যানো, হানিমুনে এসেছি। ওয়াশ রুমে যাবো। তুমিও যাবে। তারপর লাঞ্চ করবো। খাটে শুয়ে রেস্ট নেব। এসব হবে কি দরোজা খুলে রেখেই? হোটেলের লোকজনের কাছে ধরা পড়ে যাবো না?’ ‘ধরা? ও আচ্ছা ঠিক আছে। বাট দুষ্টুমি একদম নয়। তো এরপর আমাদের কী প্রোগ্রাম?’ ‘সন্ধে পর্যন্ত এই রুমেই। তারপর সবুজ পাহাড়ের সান্নিধ্যে, ফয়েজ লেক পার্কে। দারুণ চমৎকার এক চোখ জুড়োনো পার্ক। ওখানে গেলে ঘরে ফিরতেই ইচ্ছে করবে না।’ ‘তারপর?’ ‘তারপর এখানে রাত কাটানো। কাল সকাল আটটার প্লেনে কক্সবাজার। আই মীন তোমার সেই স্বপ্নের সমুদ্র সৈকতে...কী প্লানটা কেমন লাগছে?’ ‘দারুণ...শুধু রাতটুকুই যা প্রবলেম...ক্যামোন য্যানো লাগছে।’ ‘ও...আবার সেই ক্যামোন লাগার ভুতটা? তো ঠিক আছে-আরেকটা রুম বুকিং দিয়ে হোটেল ম্যানেজারকে বলি যে ম্যাডামের ঘুমের একটু সমস্যা...’ ‘না না ওসব কিছু বলতে হবে না। ওরে বাপরে, ওরা সব বুঝে ফেলবে। তাছাড়া একলা রুমে আমি থাকতেও পারবো না।’ ‘তা হলে বলো রুমটা কেমন হয়েছে?’ ‘এক্সিলেন্ট। ঠিক তোমার মতো, আমার স্বপ্নের ঠিকানা।’ শিরিনের মুখে দারুণ এক মুগ্ধতা। সাথে এক ঝলক মিষ্টি হাসি। সে হাসি ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। আমরা এখন সেই পার্কে। ফোনের এ প্রান্তে আমি। ‘দেখছো তো কেমন চমৎকার করে সাজানো পার্কটা? লেকের এ পাড়ে পাহাড়, ওপাড়েও পাহাড়ের মালা। সবুজ ঘাসে ঢাকা পাহাড়গুলোর ভেতর দিয়ে সরু লেকটি থির থির করে বয়ে চলেছে আঁকাবাঁকা হয়ে...প্রকৃতির অপরূপ সোন্দর্য যেন উপচে পড়েছে তার ওপর। লেকটির শেষ মাথার এই পার্কটিও যেন গড়ে তোলা হয়েছে এই সোন্দর্যের সাথে ম্যাচ করেই, তাই না?’ ‘হুঁ, রাকিব। দা-রু-ণ..., দেখছি আর মুগ্ধ হচ্ছি। রাতটা এখানে থেকে গেলেও মন্দ হতো না।’ ‘সেটা চাইলেও হবে না ম্যাডাম। রাত ন’টাতেই বন্ধ হয়ে যাবে সব। চল একটু বসি ওই উঁচু জায়গাটায়। এখান থেকে পাহাড়, লেক, সোন্দর্য পাগল মানুষদের স্পীডবোটে ছোটাছুটি, তাদের নানান এনজয়মেন্ট বসে বসে দেখা যাবে। স্পীডবোটে কি একটু ঘুরতে চাও? তাহলে পাহাড়গুলোকে খুব কাছ থেকে দেখতে পারতে।’ ‘না , স্পীডবোটে আমার ভয় করে। তারচেয়ে বরং চল বসি ওইখানটায়। দূর থেকে দেখতেই ভালো লাগছে।’ ‘ঠিক আছে। তো মনে কর, আমরা এখন ওই উঁচু ঢিবির ওপর পাকা করা চেয়ারে পাশাপাশি বসে আছি। দারুণ লাগছে , না?’ ‘হুঁ। খুব সুন্দর। এটা যে বাংলাদেশের কোন পার্ক -মনেই হচ্ছে না।’ ‘আবার দ্যাখো, চেয়ারটাও দুজনের বসার মতো করে বানানো। প্রেম ট্রেম করার জন্যেই সম্ভবত। কি বল?’ ‘বলার আর কী আছে? প্রেম তো অলরেডি আমরা করছিই। করছি না বল?’ ‘কিভাবে?’ ‘এই যে এভাবে-পারমিশন না নিয়েই আমার হাতটা দিব্যি ধরে রেখেছ।’ ‘তো কী হয়েছে? রাখবোই তো। প্রেম করতে এসে পারমিশন লাগে নাকি?’ ‘লাগবে না মানে? রুমেও কি পারমিশন ছাড়াই...’ ‘আরে না, অতটা বেপরোয়া ছেলে কি আমি বল? তোমার উইদআউট পারমিশন কিচ্ছুটি করবো না। প্রমিজ।’ তো আমরা এখন হোটেলের রুমে। ঢোকার আগে হোটেল বয়কে ফুলদানিতে কিছু রজনীগন্ধার স্টিক ভরিয়ে রুমে রাখতে বলে গিয়েছিলাম। রুমে ঢুকতেই শিরিন তো ভীষণ অবাক। ঘরময় রজনীগন্ধার মিষ্টি মাতাল গন্ধ নতুন এক আনন্দে আবিষ্ট করে ফেলে ওকে। বাচ্চা মেয়ের মতো উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে ও- ‘এ্যা-তো-গুলো রজনীগন্ধা! এ্যাতো সুগন্ধ! দারুণ তো! কোথায় পেলে?’ ‘তুমি এসেছ, আর রজনীগন্ধা আসবে না, সেটা হয়? ম্যানেজ করেছি। কেমন লাগছে সেটা বল।’ (চলবে)
×