ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সব শিক্ষা উপকরণ বিনামূল্যে দেয়া হয় ॥ পরীক্ষার ফলে উপজেলায় শীর্ষে

গ্রামে ভিন্ন ধারার নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

প্রকাশিত: ০৯:১২, ২৭ এপ্রিল ২০১৯

গ্রামে ভিন্ন ধারার নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

যে গ্রামের দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা প্রাইমারী স্কুলের গ-ি পেরিয়ে আর লেখাপড়া করতে পারত না সেই গ্রামে নারী শিক্ষার প্রসারে ভিন্ন ধারার একটি কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ২০০৯ সালে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ৩৩ ছাত্রী নিয়ে স্কুলটির যাত্রা শুরু। প্রতি বছর একটি করে ক্লাস বৃদ্ধির পর এখন দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মেয়েরা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে। এই স্কুলে ছাত্রীদের বেতন দিতে হয় না। ছাত্রীদের স্কুল ড্রেস, স্কুল ব্যাগসহ যাবতীয় শিক্ষা উপকরণ, ছাতা স্কুল থেকে বিনা মূল্যে সরবরাহ করা হয়। স্কুলে রান্না করা খাবার টিফিনের সময় ছাত্রীদের দেয়া হয়। ছাত্রীদের নিয়মিত চেকআপসহ চিকিৎসাসেবাও বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। বিভিন্ন প্রকারের খেলায় প্রশিক্ষণ, সঙ্গীত, নাচ, আবৃত্তি, গল্প বলায় ছাত্রীদের তালিম দেয়া হয়। ক্যারাতেও প্রশিক্ষণ নিচ্ছে স্কুলের মেয়েরা। তাছাড়া ছাত্রীদের বার্ষিক শিক্ষা সফরও করা হয়। এসব কিছুই স্কুল পরিচালনা কমিটির উদ্যোগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ে পরিচালিত হয়ে থাকে। পরীক্ষার ফলাফলে উপজেলা পর্যায়ে বার বার শীর্ষ স্থান লাভ করেছে। খেলাধুলায় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে সক্ষম হয়েছে এই স্কুলের মেয়রা। নন এমপিওভুক্ত এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নাম কমরেড রতন সেন কলেজিয়েট গার্লস স্কুল। খুলনার রূপসা উপজেলার শ্রীফলতলা ইউনিয়নের ডোমরা গ্রামে অবস্থিত। যে বাড়িটিকে ঘিরে এই নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়েছে এই বাড়িতে বসবাস করতেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা রতন সেন। ১৯৯২ সালের ৩১ জুলাই সকালে খুলনা শহরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনের সড়কে দুষ্কৃতকারীদের ছুরিকাঘাতে তিনি নিহত হন। মানব সেবায় তার অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০০৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর তাঁর বসতভিটায় ২.০২ একর জায়গায় কমরেড রতন সেন কলেজিয়েট গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রয়াত নেতার স্নেহভাজন, সমাজ সেবক ও শিক্ষানুরাগী স. ম. লিয়াকত হোসেন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ২০১৭ সালে তার মৃত্যুর পর থেকে এই স্কুলের পরিচালনা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাগ্রোটেকনলজি ডিসিপ্লিনের প্রফেসর ড. মোঃ মনিরুল ইসলাম। সংশ্লিষ্টরা জানান, নারীশিক্ষার অগ্রগতির স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটিকে বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। এলাকায় মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় এবং শিক্ষার পরিবেশ ভাল হওয়ায় এখন অসচ্ছল ও সচ্ছল উভয় পরিবারের কন্যা সন্তানেরা এই স্কুলে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া করছে। বিদ্যালয়ের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে শিক্ষানুরাগী মানবতাবাদী সাদা মনের ব্যক্তিবর্গ, রোটারী ক্লাব, দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। সরকারী কিছু সহযোগিতাও মিলছে। তবে শ্রেণীকক্ষসহ অবকাঠামো সঙ্কট ও আর্থিক সমস্যা রয়েছে। একটি একাডেমিক ভবনের নির্মাণ কাজ অর্থসঙ্কটের কারণে থমকে আছে। তিন তলার কাঠামো হলেও দেয়াল তৈরির কাজ বাকি রয়েছে। দেয়াল বিহীন ওই ভবনে ৫টি শ্রেণীর ক্লাস নেয়া হয়। এছাড়া ষষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণীর ক্লাস নেয়া হয় স্কুল অঙ্গনে অস্থায়ীভাবে নির্মিত ঘরে। শিক্ষক-কর্মচরীদের ন্যূনতম যে সম্মানী তা অর্থাভাবে কয়েক মাসের বকেয়া পড়েছে। এলাকায় ব্যাপক সাড়া জাগানো একমাত্র নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্তির দাবি জানানো হয়েছে। কমরেড রতন সেন কলেজিয়েট স্কুলের অধ্যক্ষ লক্ষ্মণ সাহা জানান, এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রী সংখ্যা ৩১২। এদের মধ্যে ২১জন এবার এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসির চারটি ব্যাচ বের হয়ে গেছে। এবার যারা পরীক্ষা দিয়েছে তারা ফল প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। শতভাগ পাসের কারণে প্রতিবছরই উপজেলা পর্যায়ে এই স্কুলটি শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়েছে। তিনি বলেন, এই স্কুলের মেয়েরা জেলা পর্যায়ে ভলিবলে রানার আপ, ফুটবলে ও ব্যাডমিন্টনে উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন, দেশাত্মবোধক গানে উপজেলা চ্যাম্পিয়ন এবং ধারাবাহিক গল্প বলায় জেলায় চ্যাম্পিয়ন ও বিভাগীয় পর্যায়ে রানার আপ। তিনি বলেন, এখানে শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী, কর্মচারী ও প্রশিক্ষক মোট ২৩জন। স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি প্রফেসর ড. মনিরুল ইসলাম বলেন, রোটারি ক্লাব এবং দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে সব সময় সহযোগিতা করে আসছে। সরকারী সহযোগিতা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, এনজিও ব্যক্তি এবং দেশে ও প্রবাসে থাকা শুভানুধ্যায়ীরাও সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। কিন্তু তার পরও অর্থের সমস্যা রয়েছে। যে কারণে শিক্ষক, কর্মচারীদের সামান্য যে সম্মানী তা নিয়মিত দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকারী পর্যায়ে ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই টাকায় স্কুলের কনস্ট্রাকশনের কাজ করা হবে। এটা সম্পন্ন হলে ক্লাসরুমসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সমস্যা বহুলাংশে নিরসন হবে। তিনি জানান, স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রাক্তন কৃতী ফুটবলার ও বিশিষ্ট শিল্পপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী স্কুলের সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। স্কুলটির এমপিওভুক্তির জন্যও তিনি সচেষ্ট থাকবেন বলে জানিয়েছেন। -অমল সাহা, খুলনা অফিস থেকে
×