ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান

রবীন্দ্রনাথের সহযোগী কালীমোহন ঘোষ

প্রকাশিত: ১২:৪৯, ২৬ এপ্রিল ২০১৯

রবীন্দ্রনাথের সহযোগী কালীমোহন ঘোষ

রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, শান্তিনিকেতনের শিক্ষক, সংগঠক কালীমোহন ঘোষ বাংলাদেশের অন্যতম কীর্তিমান মানুষ। তাঁর জন্ম ১৮৮৪ সালে চাঁদপুর শহরের ৬ মাইল দক্ষিণে বাজাপ্তি গ্রামে। বাবা দীননাথ ঘোষ, মা শ্যামাসুন্দরী। অল্পবয়সে কালীমোহন তাঁর পিতাকে হারান। ফলে তাঁর শৈশব কাটে আর্থিক টানাপড়েনে। মা শ্যামাসুন্দরী ফসল, ফলমূল, পুকুরের মাছ বিক্রিসহ নানাভাবে সংসার চালাতেন। অভাব-অনটনের মধ্যেও কালীমোহনের পড়াশোনা বন্ধ হয়নি। তিনি ঢাকার তৎকালীন ইমপেরিয়াল সেমিনার স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ১৯০২ সালে এনট্রান্স পরীক্ষার পর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯০৫ সালে ‘অনুশীলন সমিতি’ নামে একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দেন কালীমোহন। ১৯০৬ সালের দিকে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য কোচবিহারের রাজ কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানে তাঁর পড়াশোনা আর বেশিদূর এগোয়নি। স্বদেশি আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়ে কালীমোহন পড়াশোনা ছাড়েন। ওইসময় এ আন্দোলনের প্রচারণার অংশ হিসেবে তিনি গ্রামগঞ্জে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন। তাঁর মাধুর্যপূর্ণ বক্তব্য গ্রামের সাধারণ নারী-পুরুষকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করত। এ কারণে কালীমোহন যেখানে যে-গ্রামেই যেতেন, গ্রামের নারীরা তাঁকে ঘরের ছেলের মতই সমাদর করতেন। বরেণ্য সংগ্রাহক গবেষক ক্ষিতিমোহন সেনের স্মৃতিকথায় এর কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘‘...শুনিলাম, একদল স্বদেশী প্রচারক গ্রামে আসিয়াছেন। বৈকালে গ্রামের সভামধ্যে তাঁহাদের দেখিলাম। তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ বক্তা, আর কেহ কেহ গান করেন। সকলের মধ্যে দেখিলাম কালীমোহন ঘোষই যেন প্রাণস্বরূপ। শরীরে কিছুই নাই, অথচ উৎসাহ-পরিপূর্ণ চিত্ত, তাহারই সাক্ষ্য দিবার উপযুক্ত দুইটি চক্ষু। গ্রামের পুরন্ধ্রীরা এই প্রিয়দর্শন যুবকটিকে স্নেহে ও বাৎসল্যে একেবারে ঘরের ছেলে করিয়া লইয়াছেন।’ অন্যদিকে তৎকালে অনেকের ধারণা ছিল কালীমোহন ঘোষ সশস্ত্র বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন। সে কারণে তাঁর ওপর পুলিশের সজাগ দৃষ্টি ছিল। ১৯০৬-১৯০৯ সাল পর্যন্ত কালীমোহন ঘোষের রাজনৈতিক কর্মকা- নিয়ে দক্ষিণ বাংলা ও আসাম পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ একটি গোপন রিপোর্ট তৈরি করে। পুলিশ এ রিপোর্টে স্পষ্ট করেন : কালীমোহন সশস্ত্র বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত নন। কালীমোহন ঘোষের জীবনের আদ্যপ্রান্ত জুড়ে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। ১৯০৪ সালে কবির ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধটি পড়ে তিনি রবীন্দ্র-অনুরক্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে ক্ষিতিমোহন সেনের সান্নিধ্য তাঁর রবীন্দ্রকাব্যের চিন্তাকে আরও সমৃদ্ধ করে। স্বদেশী আন্দোলন নিয়ে কালীমোহনের কিছু জিজ্ঞাসা ছিল। সেসব প্রশ্নের উত্তর জানতে তিনি রবীন্দ্র-সান্নিধ্য লাভের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে যান এবং বঙ্গভঙ্গ, স্বদেশী আন্দোলন ও এর কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে কবিকে প্রশ্ন করেন। প্রথম সাক্ষাতেই রবীন্দ্রনাথ কালীমোহনের স্বদেশ চিন্তা ও আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন। তিনি তাঁর পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচীর জন্যে উপযুক্ত সহযোগী খুঁজছিলেন। কালীমোহন ঘোষ কবির সেই অভাব পূরণ করলেন। কবি তাঁকে পল্লীউন্নয়ন কাজে শিলাইদহে নিয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ স্মৃতিচারণে বলেছেন, ‘আমাদের স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্র হচ্ছে কৃষি পল্লীতে তার চর্চা আজ থেকেই শুরু করা চাই, তখন কিছুক্ষণের জন্যে কলম কানে গুঁজে এ কথা আমাকে বলতে হলোÑ আচ্ছা, আমিই এ কাজে লাগব; এই সঙ্কল্পে সহায়তা করবার জন্য সে দিন একটিমাত্র লোক পেয়েছিলুম, সে হচ্ছে কালীমোহন।’ ১৯০৭ সালে কালীমোহন ঘোষ সর্বপ্রথম শান্তিনিকেতনে আসেন। শান্তিনিকেতনের পরিবেশ ও কর্মকা- দেখে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে শিশুবিভাগে শিক্ষকের দায়িত্ব দেন। রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ ও সহযোগিতায় ১৯১২ সালে কালীমোহন ইংল্যান্ডের লন্ডন বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। উদ্দেশ্য ইংরেজী সাহিত্য ও শিশুদের শিক্ষাপদ্ধতি অনুশীলন। একই বছরের মে মাসে রবীন্দ্রনাথ লন্ডনের একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। কবি কালীমোহন ঘোষকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ডব্লিউ বি ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, এইচ জি ওয়েলস, আর্নেস্ট রীস, ঈভলিন আন্ডারহিল, এ্যালিস মেনীল, রটেনস্টাইনের কাছে পাঠাতেন। সে-সুবাধে এই বরেণ্য মানুষদের সঙ্গে কালীমোহন ঘোষের বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইংলান্ডে এজরা পাউন্ডের সঙ্গে সন্ত কবীরের দোহার ইংরেজী অনুবাদ করা কালীমোহন ঘোষের অন্যতম প্রাপ্তি। ‘ঈবৎঃধরহ ঢ়ড়বসং ড়ভ শধনরৎ’ গ্রন্থে ঞৎধহংষধঃবফ নু কধষর গড়যধহ এযড়ংব ধহফ ঊুৎধ চড়ঁহফ মুদ্রিত হয়েছিল। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ কালীমোহন ঘোষকে দেশে নিয়ে আসেন। এবার তাঁকে শান্তিনিকেতনের শিশু বিভাগের সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কালীমোহন ঘোষ বিভিন্ন সফরে যেতেন। ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ ঈশ^রগঞ্জের আঠারবাড়িতে যান। সে সময় কবির সঙ্গে তাঁর পুত্রবধূ, নাতনি, ভ্রাতুষ্পুত্রসহ কালীমোহন ঘোষও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকার আহসান মঞ্জিল ও কুমিল্লা সফরকালে কালীমোহনও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাঁর উদ্যোগেই শ্রীনিকেতন গড়ে ওঠে। তিনি কবিগুরুর লেখা অনুলিখনও করতেন। বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে কালীমোহন আমৃত্যু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে কালীমোহন চাঁদপুরের প্রখ্যাত উকিল দীননাথ বসুর কন্যা মনোরমা দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯০৬ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। তিনি ৬ ছেলে ১ মেয়ের জনক ছিলেন। বিখ্যাত রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য শান্তিদেব ঘোষ ও দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তাঁরই কৃতী সন্তান। রবীন্দ্রনাথের অন্যতম সহযোগী কর্মবীর কালীমোহন ঘোষ ১৯৪০ সালের ১২ মে অমৃতালোকে পাড়ি জমান। তাঁর মৃত্যুর সময় রবীন্দ্রনাথ কালিম্পঙে ছিলেন। দীর্ঘদিনের সহযোগী হারিয়ে স্বাভাবিকভাবে কবিগুরু ভীষণরকম শোকাহত হয়ে পড়েন। তিনি ১৯ মে কালীমোহন পুত্র শান্তিদেব ঘোষকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘তোমার পিতার মৃত্যুসংবাদে গুরুতর আঘাত পেয়েছি। শান্তি নিকেতনে আসবার পূর্বে থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার নিকট সম্বন্ধ ঘটেছিল। কর্মের সহযোগিতায় ও ভাবের ঐক্যে তাঁর সঙ্গে আমার আত্মীয়তা গভীরভাবে বিস্তার লাভ করেছিল। অকৃত্রিম নিষ্ঠার সঙ্গে আশ্রমের কাছে তিনি আপনার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ...তাঁর মূর্তি আমাদের আশ্রমে এবং আমার মনের মধ্যে চিরদিনের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে রইল। লোকহিতব্রতে তাঁর যে জীবন ত্যাগের দ্বারা পুণ্যোজ্জ্বল ছিল, মৃত্যু তার সত্যকে খর্ব করতে পারে না। এই সান্ত¡না তোমাদের শান্তি দান করুক।’ কালীমোহন ঘোষ তাঁর কর্মের মাধ্যমে এখনও ভারতবর্ষের মানুষের মনে অম্লান হয়ে আছেন এবং আগামীতেও যে থাকবেন-এ কথা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়।
×