আজ থেকে ৬ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে একটি ধূমকেতু বা গ্রহাণু আমাদের এই পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়েছিল। পতনের স্থানটি ছিল ক্যারিবিয়ান সাগর। কিন্তু এ পতনের কারণে সেখান থেকে পৃথিবীর অর্ধেকটা স্থান দূরে অবস্থিত ভারতে আগ্নেয়গিরির ব্যাপক অগ্ন্যুৎপাতের সূত্রপাত ঘটেছিল। কিন্তু ওই দুটি মহাবিপর্যয় প্রায় একই সঙ্গে ডাইনোসরসহ আরও অনেক ধরনের প্রাণের ব্যাপক বিলুপ্তি ঘটাতে কতটা ভূমিকা রেখেছিল তা পরিষ্কার নয়।
সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর ইতিহাসে মাঝে মাঝে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে লাভার বিপুল প্রবাহ এবং কিভাবে তা বায়ুম-লে বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল ও প্রাণের বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল তার ওপর গবেষণা চালান। গবেষণা থেকে ভারতে আগ্নেয়গিরির ব্যাপক ও তীব্র উদগীরণের এযাবতকালের সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট ও নির্ভুল সময়টা বেরিয়ে আসে। এ সময়ের দিকেই অর্থাৎ ক্রিটেশাস অধ্যায়ের শেষদিকে বিশ্বব্যাপী প্রাণের ব্যাপক বিলুপ্তি ঘটে। ১০ লাখ বছর ধরে থেকে থেকে এই উদগীরণে ভারত উপমহাদেশের কমপক্ষে ৫শ’ কিলোমিটার দূর অবধি লাভার উদগীরণ ঘটে। এর ফলে ডেকান ট্র্যাপ নামে সৃষ্টি হয় লাভাজাত শিলার উপত্যকা যা কোথাও কোথাও ছিল ২ কিলোমিটার পুরু।
বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন স্থানে ডেকান ট্রাপের লাভার প্রবাহের সময় নির্ণয় করে দেখার চেষ্টা করেছেন প্রতিটি জায়গায় তা একই সময়ের দিকে হয়েছে কিনা। তারা অতি নিশ্চিত হয়ে বলেছেন যে এই উদগীরণগুলো ধূমকেতু বা গ্রহাণু এসে পড়ার ৫০ হাজারের মধ্যে কিংবা হয়ত ৩০ হাজারের মধ্যে ঘটেছিল। এতদিন এটা একটা অনুমানমাত্র ছিল যে ওই অভিঘাতের ফলে নতুন করে আগ্নেয়গিরির লাভার উদগীরণ ঘটেছিল। এখন এই গবেষণায় সেই ধারণাটি সুপ্রতিষ্ঠিত হলো। নতুন সময় নির্ণয়ের ফলে আগের হিসাবের সত্যতাও প্রমাণিত হলো যে লাভার প্রবাহ প্রায় ১০ লাখ বছর ধরে চলেছিল।
এখন কথা হচ্ছে ডেকান ট্র্যাপের বেশিরভাগ লাভার উদগীরণ যদি গ্রহাণু বা ধূমকেতুর আঘাতের আগে ঘটে থাকে তাহলে উদগীরণের সময় নির্গত গ্যাসের কারণে ক্রিটেশাস যুগের শেষে ৪ লাখ বছরের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঘটত। এ সময় তাপমাত্রা গড়ে প্রায় ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেত। উষ্ণতা বৃদ্ধির এই অধ্যায়ের প্রজাতিগুলোর বিবর্তন এমনভাবে ঘটত যে তারা উষ্ণ অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিত। এরপর অভিঘাতজনিত ধুলোয় আকাশ ছেয়ে যাওয়ায় কিংবা অভিঘাতের কারণে কিংবা আগ্নেয়গিরির উদগীরণের কারণে সৃষ্ট হিমায়ন গ্যাসে জলবায়ু অতি শীতল আকার ধারণ করায় তাদের আরেক বৈরী পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ত হতে হয়েছিল। অতি শীতল পরিবেশ প্রাণীদের জন্য ছিল এক আঘাত বিশেষ যা বেশিরভাগ প্রাণী কখনই কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ফসিল রেকর্ড থেকেই তারা মুছে গিয়েছিল। তবে ডেকান ট্র্যাপের বেশিরভাগ লাভা যদি গ্রহাণু বা ধূমকেতুর পতনের পর উদগীরিত হয়ে থাকে তাহলে গোটা দৃশ্যপটটি নতুন করে ভেবে দেখার দরকার আছে বলে গবেষকরা মনে করেন।
কোর্টনি স্প্রেইন নামে এক গবেষক বলেন, ‘ডেকানের অগ্ন্যুৎপাত হয় কোন ভূমিকা পালন করেনিÑ যেটা ঠিক নয় বলে আমরা মনে করিÑ অথবা উদগীরণের পরিমাণটা সবচেয়ে যখন কম ছিল সে সময় জলবায়ু পরিবর্তনকারী প্রচুর পরিমাণ গ্যাস নির্গত হয়েছিল। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময়ই শুধু নয়, অন্য সময়ও ভূ-গর্ভস্থ ম্যাগমার কক্ষগুলো থেকে জলবায়ু পরিবর্তনকারী গ্যাস আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ দিয়ে প্রায়শ : বেরিয়ে আসে এই ধারণাটা বর্তমান সময়ের আগ্নেয়গিরির আচরণ দিয়েও প্রমাণিত হয়েছে বলে গবেষকরা উল্লেখ করেন। তারা এ প্রসঙ্গে ইতালির সাউন্ট এটনা এবং মেক্সিকোর পোপোকাটেপেটল আগ্নেয়গিরির দৃষ্টান্ত দেন। আগ্নেয়গিরির উদগীরণ না হলেও ভূপৃষ্ঠের নিচ থেকে উত্তপ্ত ম্যাগমার ভাপ থেকে গ্যাস বায়ুম-লে গিয়ে মেশে। প্রফেসর পল রেপি মনে করেন যে ম্যাগমা থেকে যে বিপুল পরিমাণ গ্যাস বেরিয়ে আসে তা অগ্ন্যুৎপাতের আগেই ঘটে। অগ্ন্যুৎপাতের সঙ্গে যে এদের সম্পর্ক থাকতেই হবে এমন কোন কথা নেই।
ক্রিটেশাস যুগে বিপুল সংখ্যক প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে আগ্নেয়গিরির উদগীরণ তুঙ্গে পৌঁছার আগেই জলবায়ুর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল।
প্রফেসর রেপি ও তার সঙ্গী গবেষকরা ক্রিটেশাস যুগের শেষ ও টারশিয়ারি যুগের শুরুতে মহাবিপর্যয়কর ঘটনাগুলোর পরম্পরা ব্যাখ্যা করার জন্য কখন গ্রহাণু বা ধূমকেতুর পতন ঘটেছিল এবং কখন ডেকান ট্র্যাপের আগ্নেয়গিরির উদগীরণ ঘটেছিল তা নির্ণয়ে আরগনÑআরগন ডেট্রিং নামে একটি সুনির্দিষ্ট কাল নির্ণয় পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছিলেন। ২০১৩ সালে মন্টানার শিলারাশি বিশ্লেষণ করে তারা গ্রহাণু পতনের সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট যে কালটা লাভ করেন তা হলো ৬ কোটি ৬০ লাখ ৫২ বছর আগের। এর চেয়ে ৮ হাজার বছর কম কি বেশি। এরপর ২০১৫ সালে তারা ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে আগ্নেয়শিলা বিশ্লেষণ করে দেখেন যে সেই অগ্ন্যুৎপাতও ঘটেছিল পূর্বোক্ত ঘটনার। অর্থাৎ গ্রহাণু পতনের ৫০ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ ভৌগোলিক সময়ের বিচারে দুটো ঘটনা মূলত একই সঙ্গে ঘটেছিল। এ থেকে গবেষকদের অনুমান গ্রহাণুর আঘাতে পৃথিবীর বুকে অতি ভয়াবহ সব ভূমিকম্প হয়েছিল এবং সেগুলোর প্রভাবে ভারতে আগ্নেয়গিরির প্রবল উদগীরণ হয়েছিল। ভারতে এই উদগীরণস্থলটি ছিল গ্রহাণু বা ধূমকেতুর পতনের স্থান ক্যারিবিয়ান সাগরের চিকসুলুব ক্রেটারের প্রায় সরাসরি বিপরীত দিকে।
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুদগীরণে নানা ধরনের গ্যাস সৃষ্টি হয়। কার্বন ডাই অক্সাইড ও মিথেনের মতো কিছু কিছু গ্যাস পৃথিবীকে উষ্ণ করে তোলে। অন্যদিকে সালফার এ্যারোসল পৃথিবীকে শীতল করে। গ্রহাণু বা ধূমকেতুর পতনজনিত আঘাতে ভূপৃষ্ঠ থেকে বিপুল ধূলিকনা বায়ুম-লে গিয়ে আকাশ ঢেকে ফেলেছিল। ফলে সূর্যরশ্মি পৃথিবীতে আসতে না পারায় ধরিত্রী শীতল হয়ে উঠেছিল- যদিও এ অবস্থা কতদিন ছিল তা কেউ জানে না।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: