ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্গম পাহাড়ের মানিকপুরে শিক্ষার জ্যোতি

প্রকাশিত: ০৯:৩১, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

  দুর্গম পাহাড়ের মানিকপুরে শিক্ষার জ্যোতি

চারদিকে পাহাড়, সবুজ বৃক্ষরাজি আর বনাঞ্চল। প্রকৃতির অপরূপ সৌর্ন্দযে ভরা চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়নের এক ছাঁয়াঘেরা গ্রামের নাম বাইন্যাছোলা-মানিকপুর গ্রাম। এই গ্রামে বাঙালী, চাকমা, মারমা, সাঁওতাল ও ত্রিপুরা মিলে প্রায় আশি হাজার মানুষের বসবাস। পাহাড়ী-বাঙালীর এক সম্প্রতি মেল বন্ধন এখানে। পাহাড়ের উঁচু, নিচু, ঢালু স্থানে ঝুপড়ি ঘর করে বাস করে এই গ্রামের মানুষগুলো। নিতান্তই সাধারণ এবং খেটে খাওয়া মানুষ তারা। হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে যা আয় হয়, তা দিয়েই দু’মুঠো পেটে ভাতে দিন যায় তাদের। ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যাধিক্য ও অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে দারিদ্র্যের কষাঘাতে পিষ্ট হওয়া এই মানুষগুলো শিক্ষা ক্ষেত্রেও রয়েছে অনেক পিছিয়ে। নিকট দুরত্বে কোন বিদ্যালয় না থাকায় তাদের সন্তানগুলোও বেড়ে উঠছে যেন-তেন ভাবে। একদিন এই শিশুগুলো অনগ্রসর মানুষ হিসেবে রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে উঠবে এমন ভয়ে পিছিয়ে পরা শিশুদের আলোর পথ দেখাতে এগিয়ে এলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম সাজাদুল ইসলাম, এফডব্লিওসি, পিএসসি, জি ও লক্ষ্মীছড়ি জোন কমান্ডার লে. মিজানুর রহমান মিজান পিএসসি ও স্থানীয় কাঞ্চনপুর ইউপি চেয়ারম্যান রশিদ উদ্দিন চৌধুরী কাতেব। তাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলো একটি বিদ্যালয়। স্থানীয় সমাজ হিতৈষী ও এলাকার বিত্তবানের সহযোগিতায় ১ শত এগারো দশমিক ৫ শতাংশ ভূমির ওপর টিনের এক চালায় নির্মাণ করা হলো একটি বিদ্যাপীঠ। সেই স্বপ্নের বাতিঘরটির নামকরণ করা হলো বাইন্যাছোলা-মানিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়। গত ১০ জানুয়ারি সকালে বিদ্যালয়টির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের দিন জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন, পতাকা উত্তোলন, পায়রা ও বেলুন উড়ানোর পর কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হলো নতুন বই। বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় করা হলো বৃক্ষরোপণ। এর আগে এই গ্রামের ত্রিশ কিলোমিটার এলাকায় কোন উচ্চ বিদ্যালয় ছিল না। ফলে, এখানকার বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরই প্রাথমিকের পর পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যেত। এই বিদ্যালয়টি নির্মিত হওয়ার মধ্য দিয়ে এই এলাকার বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর সন্তান-সন্ততিরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পেল। বিদ্যালয়টি ইতোমধ্যে ৩ শত সাতাশি জন শিক্ষার্থী, একজন প্রধান শিক্ষক ও ৮ জন সহকারী শিক্ষক নিয়ে তাদের শিক্ষাকার্যক্রম শুরু করেছে। এ বিদ্যালয়ে চট্টগ্রাম পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির সীমান্তবর্তী লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার বাইন্যাছোলা এলাকার সাঁওতালপাড়া, সমুরপাড়া, মহেষকাটা, দ-িপাড়া, হলুদ্দাপাড়া ও ফটিকছড়ি উপজেলার মানিকপুর এলাকার টিলাপাড়া, সাতগড়িয়া পাড়া, নাপিুপাড়া, ফেদুরপাড়া এবং বানতিরপাড়ার শত শত শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার সুযোগ পাবে। বাইন্যছোলার হলুদ্দাপড়ার বাসিন্দা মৃণালী ও স্বর্ণালী চাকমা দুই বোন। তারা এই বিদ্যালয়ের এই ষষ্ট শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। বৃহস্পতিবার সরেজমিনে পরিদর্শনে গেলে কথা হয় তাদের সঙ্গে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে এই প্রতিবেদককে তারা বলে, ‘প্রাথমিকের পড়া-লেখা শেষ করেছি। আশপাশে কোন স্কুল না থাকায় মায়ের সঙ্গে ক্ষেতের কাজে যাওয়ার কথা ছিল আমাদের। কিন্তু এই স্কুল হওয়াতে আমরা পড়তে পারছি। আমরা অনেক খুশি।’ মানিকপুরের বাসিন্দা নৃপেন্দ জনকণ্ঠকে বলেন, এখানে স্কুল না থাকায় আমাদের ছেলেমেয়েদের বেশিদূর পড়াশোনা করাতে পারতাম না। এখন স্কুল হওয়ায় আমাদের ছেলেরাও বড় হবে, মানুষ হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম সাজাদুল ইসলাম, এফডব্লিউসি, পিএসসি বলেন, ‘বিদ্যালয়টির মাধ্যমে এ অঞ্চলের শত শত কোমলমতি ছেলেমেয়েরা আলোর সন্ধান পেল। আমাদের পরিশ্রম তখন স্বার্থক হবে, যখন তারা মানুষের মতো মানুষ হয়ে দেশ সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করবে। প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু এখন পর্যন্ত সেনাবাহিনী স্কুলটি নিয়ন্ত্রণ করলেও এখন তা সম্পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিচালিত হবে। স্থানীয় কাঞ্চন নগর ইউপি চেয়ারম্যান রশিদ উদ্দীন চৌধুরী কাতেব বলেন, ‘আমরা স্বপ্ন দেখেছি, এই পিছিয়ে পড়া শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো জ্বালাতে। আমরা তা বাস্তবায়নে একটা ফ্লাটফর্ম তৈরি করেছি। বিদ্যালয়টিতে ৮ কক্ষবিশিষ্ট শ্রেণীকক্ষ নিয়ে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এখনও অনেক কাজ বাকি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহায়তা পেলে বিদ্যালয়টি পাহাড়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার জ্যোতি ছড়াবে।’ -ইউনুস মিয়া, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম থেকে
×