ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দক্ষিণাঞ্চলের সংখ্যালঘুদের আজও তাড়া করে বিএনপি-জামায়াতের দুঃসাশন

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮

দক্ষিণাঞ্চলের সংখ্যালঘুদের আজও তাড়া  করে বিএনপি-জামায়াতের দুঃসাশন

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ ‘সব সময় আতঙ্কে থাকি আবার যদি ২০০১ আসে। আবার যদি...।’ কাঁপা কাঁপা স্বরে কথাগুলো বলছিলেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ধর্ষণের শিকার বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বিল্লগ্রামের এক গৃহবধূ। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর পরই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। ওই নির্বাচনের পর অন্ধকার যুগ দেখেছিল বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসী। সেই একই প্রার্থীরা দীর্ঘদিন পর এবারও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় আবারও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে নির্যাতিত পরিবারসহ গোটা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাঝে। ২০০১ সালে সারাদেশে নির্বাচন পরবর্তী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনসহ আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা অমানবিক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিল। যার মধ্যে বরিশাল-১ আসনের গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলার আওয়ামী সমর্থিত নেতাকর্মীসহ সংখ্যালঘু সস্প্রদায়ের লোকজনের নির্যাতনের নির্মম কাহিনী ছিল বিশ্বব্যাপী আলোচিত। দীর্ঘ ১৭ বছর পরে হলেও ওই সময়কার নির্মম ঘটনার দায় স্বীকার করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তৎকালীন বরিশাল-১ আসনের বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী জহির উদ্দিন স্বপন। গত ১৭ ডিসেম্বর দুপুরে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জহির উদ্দিন স্বপন ক্ষমা চাইলেও তার অনুগত বিএনপির কতিপয় সন্ত্রাসীদের হাতে নিহতদের পরিবার কিংবা সম্ভ্রাব্য হারানো নির্যাতিতরা কিভাবে তাকে ক্ষমা করবেন এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে সচেতন মহলের মাঝে। সূত্রমতে, অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের ক্যাডার বাহিনীর হাতে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার ধানডোবা গ্রামের ৩০টি, বিল্লগ্রামের ২৫টি, চাঁদশী গ্রামের ২০টি, খাঞ্জাপুর গ্রামের ১৫টি, ইল্লা গ্রামের পাঁচটি, গেরাকুল গ্রামের পাঁচটি ও আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার গ্রামের ৫০টি, রামানন্দেরআঁক গ্রামের ২৫টি, বাহাদুরপুর গ্রামের ৩০টি, বাকাল গ্রামের ২৫টি, পতিহার গ্রামের ৩০টিসহ কয়েকশত পরিবার নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। এছাড়া জোট ক্যাডারদের হিংস্র্র থাবা থেকে এসব এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিবারের তরুণী, যুবতী ও গৃহবধূদের রক্ষা করতে অধিকাংশ পরিবার গোপনে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। যারা বাড়িতে ছিলেন বিএনপি সন্ত্রাসীদের হাত থেকে তাদের রক্ষার জন্য পরিবারের সদস্যরা রাতের আঁধারে কলাগাছের ভেলা বানিয়ে নির্জন পুকুর কিংবা দিঘীর মাঝে রেখেছিলেন। ওই সময় গৌরনদীর বিভিন্ন গ্রামের অসংখ্য পরিবার নির্যাতনের শিকার হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিল। চারদলীয় জোট সরকারের হাতে নির্যাতিত হয়ে সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজ নির্বাচনী এলাকা গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার দুর্গম রামশীল গ্রামে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপির চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা আগৈলঝাড়ার বাশাইলের ইউপি সদস্য আলাউদ্দিন মোল্লাকে প্রকাশ্যে অপহরণ করে হত্যা করে। এছাড়া সরকারী গৌরনদী কলেজ ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক সফিকুল ইসলাম বুলেটকে গৌরনদী বন্দরে বসে প্রকাশ্যে দিবালোকে ইট দিয়ে পিটিয়ে ও বরিশাল নগরীর আমানতগঞ্জ এলাকার ছাত্রলীগ নেতা মাসুম সিকদারকে কুপিয়ে হত্যা করে। ওই সময় দেশ-বিদেশের মিডিয়ায় নির্যাতনের ঘটনা ধারাবাহিক প্রচারে জোট সরকার শুরুতেই বড় ধরনের হোঁচট খায়। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের অসংখ্য ঘটনা ঘটলেও থানায় কোন মামলা করতে পারেনি নির্যাতিতরা। পরবর্তীতে কয়েকটি আলোচিত ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হলেও তৎকালীন সময়কার সংসদ সদস্যদের চাপের মুখে থানা পুলিশ দায়সারাভাবে আদালতে চার্জশীট দাখিল করায় হত্যার ঘটনাও মিথ্যা প্রমাণ হয়। ফলে অভিযুক্ত আসামিরা সবাই খালাস পেয়ে যায়। সূত্রে আরও জানা গেছে, ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পরেরদিন সকাল থেকেই গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে হামলা চালায় বিএনপির সন্ত্রাসীরা। তাদের অমানুষিক নির্যাতনে অসংখ্য পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। গৌরনদী উপজেলার বিল্লগ্রামের ধর্ষণের শিকার এক নারী জানান, তিনি গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি কালিয়া দমন গুহর রাইস মিলে কাজ করতেন। নির্বাচনের পর বিএনপির চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা চাঁদার দাবিতে মিলটি বন্ধ করে দেয়। কয়েকদিন পর মিলটি চালু করতে গেলে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে তাকে ধর্ষণ করে। স্থানীয়রা মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করে। নির্যাতিত ওই নারী বলেন, পুলিশ তখন তার জবানবন্দী রেকর্ডসহ ধর্ষণের আলামত উদ্ধার করলেও আইনগত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। বিএনপি সন্ত্রাসীদের নির্মম নির্যাতনে পঙ্গুত্ব বরণ করা আগৈলঝাড়া উপজেলার সুতারবাড়ি গ্রামের সঞ্জীব জানান, নির্বাচনের পর তার বাড়িতে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট করে। একপর্যায়ে তাকে ও পরিবারের নারী ও শিশুদের গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে আহত করে। চাঁদশী গ্রামের নির্যাতিত (বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান) কৃষ্ণ কান্ত দে বলেন, ৩ অক্টোবর বিএনপির সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘু অধ্যুষিত তাদের গ্রামটিতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তারা হামলা চালিয়ে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও নারীদের ধর্ষণ করে। কৃষ্ণ কান্ত আরও বলেন, হামলার পরেরদিন তিনি তার ছোট ভাইকে নিয়ে বোরকা পরে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে পাশের রামশীল গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইল্লা গ্রামের নির্যাতিত প্রণব রঞ্জন দত্ত বাবু জানান, বিএনপির সন্ত্রাসীরা তাকে না পেয়ে তার বৃদ্ধ বাবা-মাকে কুপিয়ে জখম করে বাড়িতে লুটপাট চালায়। পরেরদিন রান্না করে খাবার মতো কোন হাঁড়ি-পাতিলও ঘরে রেখে যায়নি সন্ত্রাসীরা। হামলাকারীরা তাদের বাড়ির মন্দিরেও অগ্নিসংযোগ করেছিল। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন সবার কাছে উৎসব নিয়ে আসলেও আমাদের (সংখ্যালঘু) কাছে বিপর্যয়ের শঙ্কা নিয়ে এসেছে’। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ২০০১ সালের তৎকালীন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন দীর্ঘদিন পর এবার আবার পুনরায় বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের মধ্যে ফের নির্মম নির্যাতনের অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। সেই হামলাকারীরাই নির্বাচনী মাঠে ॥ গৌরনদী উপজেলার উত্তর চাঁদশী গ্রামের নির্যাতিত রিপন বাড়ৈ, গৌরাঙ্গ দাস, হরিপদ বিশ্বাস, মঞ্জু রানী, আগৈলঝাড়া উপজেলার পতিহার গ্রামের নিতাই রঞ্জন, বাকাল গ্রামের সুধীর বালা, নলচিড়া গ্রামের অভিজিৎ, রাজিহার গ্রামের কমলা রানী, হরিসেনা গ্রামের দীপঙ্কর ভট্টাচার্য্য রানাসহ নির্যাতিত অসংখ্য ব্যক্তিরা জানান, ২০০১ সালের তৎকালীন বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপনের অনুগত ক্যাডার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের খবর মিডিয়ায় বিশ্বব্যাপী আলোচিত করে। ফলশ্রুতিতে ওই সময় জোটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (বর্তমানে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে পটুয়াখালী-১ আসনের বিএনপি দলীয় প্রার্থী) আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে শপথ নিয়েই প্রথম বরিশাল-১ আসনের আগৈলঝাড়ায় সফর করতে হয়েছিল। আগৈলঝাড়া ডাকবাংলোয় বিএনপির নেতাকর্মীদের নিয়ে এক সভা করে স্থানীয় বিএইচপি একাডেমি মাঠের সভায় আলোচিত নির্যাতিত রাজিহার ইউনিয়নের তৎকালীন সদস্য কমলা রানীকে জোর করে মঞ্চে বক্তব্য দেয়ার জন্য ধরে আনা হয়। স্থানীয় তৎকালীন সাংসদ ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী জহির উদ্দিন স্বপনের শিখিয়ে দেয়া বক্তব্য না বলে মঞ্চে উঠে কমলা রানী নির্মম নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে বক্তব্য দেয়ায় গণেশ উল্টে যায়। বাধ্য হয়ে তার হাত থেকে জহির উদ্দিস স্বপন মাইকের মাইক্রোফোন কেড়ে নিয়ে যায়। পরে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় ফিরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী এলাকায় কোন সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়নি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। কি নির্লজ্জ মিথ্যাচার। সেই ঘটনা অবশ্য এখনও অস্বীকার করে বিএনপি। তবে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে দাবি করে ঘটনার ১৭ বছর পর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কাছে সংবাদ সম্মেলন করে ক্ষমা চেয়েছেন তৎকালীন সাংসদ ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী জহির উদ্দিন স্বপন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সারাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১৭ জন ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। ধর্ষিত হন ৬১ জন। যৌন নিপীড়নের শিকার হন ৬৪ জন। হামলায় আহত হন সাড়ে ছয় শ’। অপহৃতের সংখ্যা ১৩ জন। এছাড়া সংখ্যালঘুদের অসংখ্য দোকানপাট ও বাড়িঘরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করা হয়। কয়েকটি স্থানে আদিবাসী ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকজনও হামলার শিকার হন। প্রায় সব ঘটনাতেই নির্বাচনে জয়ী বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা জড়িত ছিলেন। বেশির ভাগ স্থানেই থানা মামলা নেয়নি। আবার মামলা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি। ২০০২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে এ নির্মম ঘটনা ঘটে। এর কারণ উদ্ঘাটন ও জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ হাইকোর্টে একটি রিট করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে ২০১০ সালে গঠিত হয় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্ত কমিশন। ওইবছরের ১২ এপ্রিল কমিশনের চেয়ারম্যান মোঃ শাহাবুদ্দিন, সদস্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মনোইয়ার হোসেন, সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মীর শহীদুল ইসলাম সরেজমিনে গৌরনদী ও আগৈলঝাড়াসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পরিদর্শন করে নির্যাতিতদের কাছ থেকে ঘটনার বর্ণনা ও লিখিত অভিযোগ গ্রহণ করেছিলেন। আগৈলঝাড়ার রাজিহার গ্রামের আলোচিত নির্যাতিতা কমলা রানী রায় আক্ষেপ করে বলেন, তদন্ত কমিশন গঠনের পরেও যখন তারা বিচার পাননি, তখন কমিশন গঠনেরই বা কি দরকার ছিল। একই উপজেলার শেফালী রানী সরকার, পাশবিক নির্যাতনের শিকার রেনুকা অধিকারী ওরফে কালা বউ, গৌরনদীর বিল্লগ্রামের কালিয়া দমন গুহ, চাঁদশী গ্রামের কৃষ্ণ কান্ত দে, ইল্লা গ্রামের প্রণব রঞ্জন দত্ত বাবু, গেরাকুল গ্রামের হেলাল মিয়া, নিহত ছাত্রলীগ নেতা সফিকুল ইসলাম বুলেটের বৃদ্ধা মা মঞ্জুআরা বেগমসহ অসংখ্য নির্যাতিতরা জানান, ২০০১ সালের নির্মম নির্যাতন, হত্যা, হামলা, মামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও লুটের ঘটনায় ওইসময় তারাসহ অন্য নির্যাতিতরা জোট ক্যাডারদের বিচারের আশায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ব্যর্থ হয়েছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে উল্লেখিত অভিযোগকারীরা ২০০১ সালের ন্যায় আবারও নির্মম নির্যাতনের আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, হামলাকারীদের মদদদাতা তৎকালীন সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন দীর্ঘদিন পর এবার আবার বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। তৎকালীন সময়ের তার সেই অনুগত হামলাকারীরা দীর্ঘদিন পর তার সঙ্গে আবার এলাকায় ফিরেছে। কেউ কেউ আবার প্রভাবশালী কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতার ছত্রছায়ায় লোকদেখানো ভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করছে। সদ্যযোগদানকারীদের সঙ্গে বিএনপি প্রার্থীর গভীর সখ্যতা থাকার আশঙ্কা করে নির্যাতিতরা বলেন, আগামী ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মুজিব কোট গায়ে পরে ওইসব যোগদানকারীরা ২০০১ সালের ন্যায় ভোট ডাকাতি করতে পারে। রেহাই পায়নি লর্ড হার্ডিঞ্জের আট বছরের শিশু ॥ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনাদের অত্যাচারকে হার মানিয়ে নতুন করে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছে ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট ক্যাডারদের নির্মম নির্যাতনের কাহিনী। তাই নির্বাচন আসলেই চরম আতঙ্কের মধ্যে থাকেন সেইদিনের নির্যাতিতরা। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পরেরদিন বরিশাল বিভাগের দ্বীপ জেলা ভোলার লালমোহন উপজেলার লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের চর অন্নদাপ্রসাদ, পিয়ারীমোহন ও ফাতেমাবাদ গ্রামের সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায় ওই এলাকার বিএনপির চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা। হামলা থেকে বাঁচতে ভেন্ডারবাড়ী গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীরা। বিএনপির সন্ত্রাসীরা সেখানেও হানা দিয়ে রাত ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত নিপীড়ন ও লুটপাট চালায়। সেইদিন বিএনপির সন্ত্রাসীদের কু-নজরে চর অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের আট বছরের যে মেয়েটি ধর্ষিত হয়েছিল সে এখন আর বাড়িতে থাকে না। বাড়িতে থাকা তারা বৃদ্ধা ঠাকুরমা বলেন, সেইদিনের কালিমার কথা তারা কোনদিন ভুলতে পারবেন না। লর্ড হার্ডিঞ্জের সব নির্যাতিত সংখ্যালঘু পরিবারের মনোভাবই প্রায় একই রকম। তারা একটি নিরাপদ, আশঙ্কামুক্ত জীবন দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। অন্নদাপ্রসাদ গ্রামের মেন্টর বাড়ির বিনোদ চন্দ্র দাস বলেন, আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি আবার যদি ২০০১ আসে। সূত্রমতে, বিএনপি জামায়াতের সন্ত্রাসীরা ১ অক্টোবর রাতে অন্নদাপ্রসাদ গ্রামে আক্রমণ করে হামলা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। নির্বাচনের পরেরদিন ২ অক্টোবর অন্নদাপ্রসাদ গ্রামসহ পার্শ¦বর্তী গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীরা নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিল গ্রামের চারপাশের ধানক্ষেত ও জলাভূমি পরিবেষ্টিত ভেন্ডারবাড়ী। অর্ধশতাধিক নারী তাদের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু সে বাড়িটিও সন্ত্রাসীদের নজর এড়ায়নি। শত শত বিএনপির সন্ত্রাসীরা ৮-১০টি দলে বিভক্ত হয়ে পরিকল্পিতভাবে ওই রাতে হামলা চালায়। একের পর এক দল হামলা চালিয়ে অসহায় হিন্দু পরিবারের মেয়েদের ধর্ষণ করতে থাকে। শত চেষ্টা করেও নারীরা তাদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারেনি। এভাবে ধর্ষিত হয় আট বছরের শিশু, মা, মেয়ে, শাশুড়ি, পুত্রবধূকে ধর্ষণ করা হয় একসঙ্গে। ওই সময় ছেলের চেয়েও ছোট বয়সী সন্ত্রাসী ধর্ষণ করে মায়ের চেয়েও বেশি বয়সের নারীকে। সন্ত্রাসীরা ছাড়েনি এক পঙ্গু নারীকেও। সন্ত্রাসীদের পাশবিক অত্যাচারের একপর্যায়ে ওই পঙ্গু নারী জ্ঞান শুন্য হয়ে পরে। পরবর্তীতে স্থানীয়রা তাকে হাসপাতালে ভর্তিও করেছিলেন। সন্ত্রাসীদের তা-বে পালাতে গিয়ে অন্তঃসত্ত্বা এক মা বাধ্য হয়ে ধানক্ষেতেই সন্তান প্রসব করছে। পরবর্তীতে সম্ভ্রম হারিয়ে অনেকেই লোকলজ্জায় দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। অন্নদাপ্রসাদ, ফাতেমাবাদ ও পেরীমোহন গ্রামের একটি হিন্দু পরিবারও ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের হাত থেকে বাদ যায়নি। এসব ঘটনার পর জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের পক্ষ থেকে ভোলায় এক হিন্দু মেয়ে ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী হওয়ার ঘটনাটি উপস্থাপন করা হয়। তখন সংসদে বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতেই বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব সালাম তালুকদার ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন ‘মেয়েটার মনে হয় ফারটিলিটি খুব বেশি।’ ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখেছে তাদের ভূমিতে ইতিহাসের ভয়াবহ এক সন্ত্রাসী হামলার দৃশ্য। তার বিশ দিন পর পৃথিবীর আরেক প্রান্তের বাংলাদেশ দেখেছে মানবতাকে হত্যা করার দৃশ্য। ২০০১ সালের ভোলা আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই লজ্জার স্বাক্ষী হয়ে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সেই দিনকার বিএনপি ও জামায়াতের সেই সন্ত্রাসীরা নির্বাচনী মাঠে থাকায় ফের অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাঝে। সেদিনকার নির্যাতিতদের মতে, স্বাধীন বাংলাদেশে আর যেন কোনদিন ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ের হামলাকারী সন্ত্রাসীদের মদদদাতা স্বাধীনতা বিরোধী বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসতে না পারে। সেজন্য তারা সচেতন ভোটারদের প্রতি জোর আহ্বান করেন। এ বিষয়ে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বরিশাল-১ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার প্রার্থী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিহিংসার রাজনীতিকে বিশ্বাস করেন না। তাই আমরা ক্ষমতায় এসে কোন ঘটনার প্রতিবাদ করিনি বিধায় বিগত দশ বছর বিএনপি ও জামায়াতের সেইদিনের হামলাকারীরা নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করেছে। তিনি (আবুল হাসানাত) আরও বলেন, বাংলাদেশের মাটিতে আর কোনদিন ২০০১ সাল আসবে না। এজন্য তিনি সর্বস্তরের ভোটারদের বিবেককে জাগ্রত করে ৩০ ডিসেম্বর নৌকা মার্কার প্রার্থীদের বিজয়ী করার আহ্বান করেছেন।
×