ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সাদিক ইসলাম

গানে মুক্তিযুদ্ধের অমর চেতনা

প্রকাশিত: ০৮:০৫, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮

গানে মুক্তিযুদ্ধের অমর চেতনা

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। দেশকে হানাদারমুক্ত করতে মরণপণ লড়াইয়ে অংশ নেয় সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, পেশাজীবী, শিল্পী সংগ্রামী নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ। পাকবাহিনীর আক্রমণ ও গণহত্যা মোকাবেলার জন্য গড়ে তোলে প্রবল মানবিক প্রতিরোধ। সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি গান, নাটক, কবিতার মতো সৃষ্টিশীলতা দিয়েও যুদ্ধকে গতিশীল করা হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গান, কবিতা দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেয় স্বাধীনতর চেতনা সারা দেশে। গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর মনোবলকে উদ্দীপ্ত করতে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিল।। তাদেরই একটি গানের দল বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে ট্রাকে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধের গান গেয়ে শোনাত। এসব জাগরণিয়া গানের মধ্য দিয়ে উজ্জীবিত হতো মুক্তিসেনারা। স্বাধীনতার স্বপ্নভরা চোখে তারা খুঁজে ফিরতো শত্রুর আস্তানা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চেতনা জাগানিয়া গান, আবৃত্তি, খবর, চরমপত্র এগুলো শত্রুর অস্ত্রের চেয়েও অনেক শক্তিশালী ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তাই বলা যায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের মধ্য দিয়ে চলত সাংস্কৃতিক লড়াই। এখানে বসেই গান লিখে, সুর করে গাওয়ার মধ্য দিয়ে চলত সংগ্রামের আরেক অধ্যায়। এখানে বাজানো হতো দেশপ্রেমের অমূল্য সব সঙ্গীত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, সলিল চৌধুরীর লেখা দেশপ্রেম ও দ্রোহের গানের সঙ্গে গণনাট্যসংঘের গানগুলো গাওয়া হতো। এ সময় গোবিন্দ হালদার, আবদুল লতিফ, গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার, অপরেশ লাহিড়ী, সিকান্দার আবু জাফর, ফজল এ খোদা, আপেল মাহমুদসহ বিভিন্ন গীতিকারের লেখা গান গাওয়া হতো। এসব গানের মধ্যে ছিল- ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা; শিল্পীর কণ্ঠে গীত হয়, মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা; বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার দেশ, তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি, জয় বাংলা, বাংলার জয়, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি, কারার ঐ লৌহকপাট, কেঁদো না কেঁদো না মাগো, সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোন, শোন একটি মুজিবরের থেকে, পূর্ব দিগন্তে, সূর্য উঠেছে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, সালাম সালাম হাজার সালাম, জনতার সংগ্রাম চলবেই, বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, নোঙ্গর তোল তোল, ছোটদের বড়দের সকলের ইত্যাদি মন উত্তাল করা সব গানসহ আরও নানা ধরনের দেশপ্রেম আর স্বাধীনতার সুপ্ত বাসনায় আগুন ঝরানো উদ্দীপক গান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এমনি সব দেশাত্মবোধক গান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণে সঞ্চারিত করেছে যুদ্ধের চেতনা, দেশের মানুষের মনে জাগিয়েছে স্বাধীনতার আশার বাণী। একদল মুক্তিকামী শিল্পী সুরকার, গীতিকারের সমন্বয়ে তৈরি গান গাইতেন শিল্পীরা। মুক্তিসেনারা এসব গান শুনে মাতৃভূমি রক্ষায় অকুতোভয়ে শত্রুর প্রাণঘাতী আধুনিক মারণাস্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে নিরস্ত্র অবস্থাতেই দেশের জন্য লড়ে যেত। সেই সব গান আজ ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। বাংলাদেশের জন্ম চিহ্ন যদি মুক্তিযুদ্ধ হয় তাহলে গেরিলা যোদ্ধাদের চেয়ে মুক্তিযুদ্ধে এসব শিল্পী-কুশলীদের ভূমিকাও কোন অংশে কম না। গীতিকার গোবিন্দ হালদারের লেখা এক স্বপ্ন জাগানো গানে সুর দিলেন সঙ্গীত পরিচালক সমর দাস। সে গান ধমনীতে ছড়িয়ে দিলে মুক্তির নেশা: ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল রক্তলাল রক্তলাল জোয়ার এসেছে জনসমুদ্রে রক্তলাল রক্তলাল রক্তলাল।’ শাকপাতা উর্বর মাটিতে মাথা চারা দিয়ে উঠে কিন্তু বট গাছ পাথরে ও তার জন্ম অধিকার সোচ্চার হয়ে জানান দেয়। তেমনি এই দেশ যা ফুলের মতো সুন্দর মায়ের মতো মততাময়ী তার জন্য বেজে উঠলো মধুর সুতীব্র কন্ঠ প্রবল আক্রমণের মুখে : ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি। জাতীয় কবির গানেও খুঁজে পেল বন্ধন ছেঁড়ার প্রত্যয়- ‘মোদের এই শিকল পরা ছল এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল।’ বঙ্গবন্ধুর কিংবদন্তিতুল্য তীব্র কণ্ঠ যেন গান হয়ে গেল সংগ্রামকে উদ্দীপ্ত করতে, মধুর গান উৎসারিত হলো তাই: ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই, জনতার সংগ্রম চলবে’ অপমানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এলো গানেই: ‘হতমানে অপমানে নয়, সুখ সম্মানে বাঁচবার অধিকার কাটতে দস্যের নির্মোক ছাড়তে।’ সেদিনের সেই গানের সুরের তীব্রতায় এমন এক প্রতিবাদ ছিলো যা চেতনার স্ফূলিঙ্গ জ্বালিয়ে সংগ্রামের মশাল প্রজ্বলিত করলো দীপ্তি ছড়িয়ে। দেশের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করার দৃঢ় বাণী ছিলো সেই গানে: ‘প্রয়োজন হলে দেখো এক নদী রক্ত হোক না পথের বাধ প্রস্তর শক্ত।’ কবি শেলি যেমন ‘ঞড় ধ ঝশুষধৎশ’ কবিতায় বলেছেন সবচেয়ে বড় বেদনা যখন গান হয় তখন তা সবচেয়ে মধুর গান হয়ে বের হয়। তেমনি তীব্র বেদনা ছাড়া আবেগের তীব্রতা উপলদ্ধি হয় না। অন্যায়, অত্যাচার, হত্যা আর ষড়যন্ত্রের বিষে যখন পাকিস্তানীরা আমাদের ছিন্নভিন্ন করতে চাইলো তখন প্রথমে তা গান হয়ে নিঃসরিত হলো। তার মাঝে যেমন ছিল বেদনা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ডাক তেমনি প্রদীপ্ত ঝংকার। সেই গানগুলো প্রতিটি রক্ত বিন্দুকে করেছিলো উষ্ণ পশুর হিং¯্র চিৎকারকে রুখে দিয়েছিলো অমর সব প্রত্যয়ী গান। এই গান শুধু একটি দেশের মুক্তির জন্য নয় সারা পৃথিবীর মুক্তির প্রতীক হয়ে উচ্চারিত হয় হৃদয়ে সুমধুর আঘাত দিয়ে: ‘মোরা সারা বিশে^র শান্তি বাঁচাতে আজকে লড়ি মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।’ কিংবা সলিল চৌধুরীর গানে একই বারতা ধ্বনিত হয়: ‘আমার প্রতি নিঃশ^াষের বিষে বিশ্বের বঞ্চনার ভাষা’ কোনো দেশের কোনো মুক্তি সংগ্রাম এতো বেশি গভীর আবেদন নিয়ে গানে বেজে ওঠেনি। সর্বস্তরের মানুষের মহান আত্মত্যাগ গানের আবেগে খান আতাউর রহমান ঐতিহাসিক সাক্ষী করে তুলে ধরেছেন : ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলো যারা তোমাদের এই ঋণ কোনদিন শোধ হবে না।’ যখন পাকিস্তানী ঘাতক আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে আর তাদের এ দেশীয় জাতীয় বেঈমানরা নিরস্ত্র, নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে এর পাল্টা জবাবে অবিচলিত বীর সাহসী মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধারা সেই হিং¯্রতা আর নির্মমতার সামনে খোলা হাতে দাঁড়িতে প্রতিবাদ করে মা, মাটি আর মাতৃভূমি রক্ষা করতে- মধুর গান স্মরণ করে তখন এই অসীম সাহসীকতা : ‘মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাত কোটি মানুষের জীবনের সন্ধান আনলে যারা সে দানের মহিমা কোনোদিন ম্লান হবে না।’ সেই গান আবার প্রকাশ করে কতো শত নাম না জানা দেশপ্রেমী নিভৃতচারী যোদ্ধা, তাদের পরম আত্মত্যাগে প্রিয় ভাই, বোন, সন্তান বা অগণিত নিরস্ত্র মানুষকে রক্ষা করেছিলো শত্রুকে মোকাবেলা করে মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় আলিঙ্গন করে। তাই সেই কাতর স্মৃতি বেজে উঠে গানে: ‘হয়তো বা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না বড় বড় লোকেদের ভিড়ে জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে তোমাদের কথা কেউ কবে না।’ তবুও এ দেশের কোমল খাঁটি প্রাণ আর সজীব মাটি তাদের ভুলে যাবে না : ‘তবু হে বিজয়ী বীর মুক্তিসেনা তোমাদের এই ঋণ কোন দিন শোধ হবে না’ যে মুক্তিসেনাদের মৃত্যু, বীর বেশে শত্রুকে প্রতিরোধ আমাদের পরম আরাধ্য স্বাধীনতা এনে দিয়েছে তাদের ফিরে পেতে চায় এই তৃপ্ত স্বাধীন জীবন। স্মরণ করে গানে আবার সেই চিরস্মরণীয় অতীতের আত্মত্যাগকে: ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না- আমি গাইবো বিজয়ের গান ওরা আসবে চুপিচুপি যারা এই দেশটাকে ভালবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ।’ এই অন্তিম বিসর্জন ছিল চিরন্তন শান্তির জন্যে তাই গানে এক সঙ্গে খুঁজে পাওয়া যায় সান্ত¡না ও আনন্দের প্রকাশ। ‘চোখ থেকে মুছে ফেল অশ্রুটুকু এমন খুশির দিনে কাঁদতে নেই। হারানো স্মৃতির বেদনাতে একাকার করে মন রাখতে নেই।’ কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের এই চরম আত্মত্যাগ ছাড়া আমরা চূড়ান্ত স্বাধীনতা পেতাম না; মুক্ত দেশে মুক্তি আনন্দে স্বাধীন জীবন কাটাতে পারতাম না আর নিরন্ন, অত্যাচারিত, বঞ্চিতদের জীবনে কোনদিন শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হতো না। মুক্তিসেনারা জীবন দিয়ে গেছে এ দেশের অনাগত সুখ, শান্তি আর নিরাপত্তা রক্ষা করতে। তাই সে কথা বলিষ্ঠ সুরে ঝরে পড়ে মৃত্যুতে সান্ত¡না পেতে বলে: ‘কেউ যেন ভুল করে গেয় নাকো মন ভাঙ্গা গান।’ গোবিন্দ হালদার তার হৃদয় গভীরের অসীম সত্যকে উপলদ্ধি করে লিখেন মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় গান। একটি গান সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত অধিকারের সকরুণ ইতিহাস জানিয়ে দেয়। একাত্তরের শোষণের ভয়াবহতা আর দেশকে নিষ্ঠুরতার হাত থেকে বাঁচানোর দলিল হয়ে, থাকে সেই গানের মর্মস্পর্শী কথা মালা: ‘যুগের নিষ্ঠুর বন্ধন হতে মুক্তির এ বারতা আনলে যারা। আমরা তোমাদের ভুলব না দুঃসহ বেদনার কন্টক পথ বেয়ে- শোষণের এ নাগপাশ ছিঁড়লে যারা- আমরা তোমাদের ভুলবো না।’ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মহান সংগ্রাম আর ত্যাগ এ দেশের কেউ কখনো ভুলে যাবে না; যতই অশুভ শক্তি মুক্তিযুদ্ধের অম্লান চেতনা মুছে ফেলতে চাক তা এই দেশের মাটি, মানুষ আর অমলিন প্রকৃতি চিরদিন তার দেহে বহন করে নেবে: ‘কৃষাণ-কৃষাণির গানে গানে পদ্মা- মেঘনার কলতানে বাউলের একতারাতে আনন্দ ঝংকারে তোমাদের নাম ঝংকৃত হবে নতুন স্বদেশ গড়ার পথে তোমরা চিরদিন দিশারী রবে।’ এদেশ এ মাটি, এই শস্য শ্যামল উজলা, উর্বর ভূমি এই কোমল প্রাণ লক্ষ কোটি বীরের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত; তাইতো গাইতে পারি: ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারও দানে পাওয়া নয় আমি দাম দিয়েছি তা লক্ষ কোটি জগত জানে।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র একটি দেশ বা ভূ-খ-ে মুক্তি বা স্বাধীনতার জন্য নয় এর পরিধি ছিলো ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। পাকিস্তানী শোষণ, অত্যাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে মুক্তি সংগ্রাম হয়েছিলো তার বঞ্চনার দিকটি ছিলো আরো ব্যাপক। এটি একটি জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়, অধিকার, স্বকীয়তা আত্ম-পরিচয়, বোধ ও শেকড়কে উৎপাঠনের জন্য যে দূরভিসন্ধি পাকিস্তান ও তার দোসর শক্তিগুলো চালিয়ে যাচ্ছিলো তা থেকে মুক্তিলাভ করে দেশ বা ভূ-খ-, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, জাতিগত সত্তা সংরক্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ধীরে ধীরে রাজনৈতিক বঞ্চনা থেকে যখন প্রশাসনিক, সামরিক, শিল্প, শিক্ষা, সঙ্গীত এবং ভাষার ওপর পাকিস্তানী স্বৈরাচারী প্রভুত্ব ঘৃণ্য আকার ধারণ করতে শুরু করে ও আমাদের মূল চেতনা তথা জাতি হিসেবে আমাদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার পাঁয়তারা পাকিস্তানীরা নিষ্ঠুর স্বৈরচারী কায়দায় চাপিয়ে দিতে শুরু করে তখন বঙ্গবন্ধু আসেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রগণ্য নেতা হয়ে পাকিস্তানী জঘন্য নীতিহীনতা আর অবৈধ বল প্রয়োগের বিরুদ্ধে এই মহানায়ক পুরো শোষিত জাতিকে একসূত্রে গেঁথে পাকিস্তানী সামরিক দমন নিপীড়নের পাল্টা জবাব দিয়ে নয় মাসের রক্ত¯œাত মহাবাহ্যিক এক লড়াইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ১৯৪০ সালের লাহোড় প্রস্তাবে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কায়েদে আযম জিন্নাহ, ইয়াহিয়া, ভুট্টো জেনারেল টিক্কা খানের অর্ধ-শতাব্দীর দীর্ঘ ষড়যন্ত্র হতে বাংলাদেশকে মুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন যা বিশে^র স্বাধীনতা ইতিহাসে কিংবদন্তি আর বিস্ময় হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বাংলাদেশের আপামর জনগণের শুদ্ধ চেতনা, শুভ ইচ্ছা, অদম্য স্বাধীনতাকামী আপোসহীন মনোভাব, জীবনবোধ, সাহসীকতা, উদারতা, অকুতোভয় মনোভাব, নিজেকে অন্যের জন্য বিলীন করার অনন্য মানসিকতা সমস্ত বিষয়গুলো যেমন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে নানা মুক্তিকামী গান দিয়ে জাগরিত করেছিলো লক্ষ প্রাণ তেমনি স্বাধীনতা লাভের পরও আমাদের লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত চির অরাধ্য স্বাধীনতা স্মরণ করার গেছে- মধুর বেদনাময় কালজয়ী অনেক গান দিয়ে। অনেক সাংস্কৃতিক কর্মী দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো। নিরাপত্তাহীনতা আর ভয় উপেক্ষা করে নির্ভীকভাবে নিঃশঙ্কচিত্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গান প্রচার করে গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতে। কোনো দেশের মুক্তি সংগ্রাম এতো রক্ত, এতো আত্মত্যাগ, এত বড় প্রত্যয়ী, প্রবল, পরাক্রম সংগ্রাম আর ক্ষয়ের বিনিময়ে আসেনি যে মহীমাপূর্ণ বীরত্ব গাঁথা বাঙালী জাতি দেখিয়েছে। এই চির ভাস্বর, চির জাগরুক, চির অম্লান স্বাধীনতার জন্য জীবন দান আর শত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতা তাই গানের গভীর বেদনা ভরা মূর্ছনায় সুরের সুমধুর ব্যঞ্জনায় অনন্য মাত্রা পেয়েছে। বাংলাদেশের যুদ্ধ নাড়া দিয়েছিলো সারা পৃথিবীর অসংখ্য শিল্পী হৃদয়কে। সবাই জানি ‘ঈড়হপবৎঃ ঋড়ৎ ইধহমষধফবংয’ কী ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিলো সারা বিশ্বে। বিপ্লবী শিল্পীদের মন কেঁদেছিলো বাঙালীদের জন্য। তাদের গানগুলো বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষের কানে পৌঁছে দিয়েছিলো বাংলাদেশের রক্তাক্ত জন্মের কাহিনী। জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’ গানটি এর গভীর আবেদনে সারা বিশে^র কোটি কোটি মানুষের হৃদয় কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। তার কণ্ঠে বিলাপ বেজে ওঠে: ‘প্রাণের বন্ধু চলে এসো কান্না ভরা চোখে তারা বাঁচতে চায় দেশ মৃত্যুর আগে নিজের মৃত্যু চায়।’ লক্ষ লক্ষ মানুষকে যখন পাক বাহিনী গাছপালার মতো নিধন করছিলো তখন তার কণ্ঠ আবার সকরুণ গেয়ে উঠে: ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ কত মানুষ মরে যাচ্ছে নির্বিচারে এমন ভয়াবহতা দেখিনি কখনও নিকষ কালো অন্ধকারে’ মুক্তিযুদ্ধের যেই গানগুলো প্রচারিত হতো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। সেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে অনভিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী তুখোড় কমান্ডার, ঘরে বাতি নিভিয়ে পরিবার নিয়ে লুকিয়ে থাকা অসহায় বাঙালী আর কনসার্টে আসা শ্রোতাদের যেন একসূত্রে গেঁথে ফেলেছিলো এই অসাধারণ শিল্পকর্মগুলো। কিছু গান যেমন অস্ত্রহাতে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে দাঁড় করায়, তেমনি কোন গান নিয়ে যায় অসহায় শরণার্থী শিবিরে। আবার কোন গান মুক্তিযুদ্ধে একেবারেই হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর কথা বলে। এই অসাধারণ সব গানই ছিল বাঙালীর সাহস। এই গানগুলোই অস্থির মনকে সান্ত¡না দিয়েছে যে বাঙালীরা বেঁচে আছে, যুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে, মুক্তি একদিন আসবেই! তাইতো হাজার আতঙ্কের মধ্যেও লুকিয়ে রাখা রেডিও কানে লাগিয়ে মনে সাহস সঞ্চার করতো সবাই। আর এ কারণেই এই গানগুলো আজীবন বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িয়ে থাকবে। যুগ যুগ ধরে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকেরা কঠিন কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা পাবে। আমরা জানি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের শুধু নয় আপামর জনসাধারণকে উদীপ্ত করেছিল প্রবলভাবে। সারা দেশের সাত কোটি মানুষ এক হয়ে সেই গানের চেতনায় যেন এক হয়ে গিয়েছিলো: ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম মুক্তি ছাড়া তুচ্ছ মোদের এই জীবনের দাম সংকটে আর সংঘাতে আমরা চলি সব একসাথে।’ ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে’ গানটি আমাদের আত্মপ্রত্যয় এবং পুরোজাতির একাত্বতা প্রকাশ করে: ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে, আমরা ক’জন নবীন মাঝি হাল ধরেছি শক্ত করে রে॥’ ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি যেন বাংলাদেশর মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক হয়ে গিয়েছে। এটি যেমন মুক্তিযুদ্ধে সবাইকে জাগিয়ে তুলেছিলো, তেমনি এখনও আমাদের শিহরিত করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন এই গানটি মুক্তি সংগ্রামকে বেগবান করেছিলো দারুণভাবে। গানটি যেমন চরম বেদনার কথা বলে, তেমনি এই গানটি আমাদের প্রাণের, তারুণ্যের এবং জীবনের অমিয় বাণী হয়ে রয়ে গেছে। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য গানটি আমাদের এখনও আমাদের চেতনার, বাঙালী জাতি সত্তার নিরেট চিন্তা প্রকাশ করে: ‘বাংলার প্রতিঘর ভরে দিতে চাই মোরা অন্নে॥ আমাদের রক্ত টগবগ দুলছে। অশথের ছায়ে যেন রাখালের বাঁশরি হয়ে গেছে একেবারে স্তব্ধ, চারিদিকে শুনি আজ নিদারুণ হাহাকার আর ঐ কান্নার শব্দ॥’ এতো বিপর্যয়, এত রক্তক্ষয়, এতো গ্লানী, শত্রুর এত ভয়াবহতা কিন্তু তবুও বাঙালী মাথা নোয়াবার জাতি নয়। তাই এই গানে আবার ফিরে আসে দৃপ্ত অঙ্গীকার: ‘শাসনের নামে চলে শোষণের সুকঠিন যন্ত্র, বজ্রের হুংকারে শৃঙ্খল ভাঙতে সংগ্রামী জনতা অতন্দ্র। আর নয়- তিলেতিলে বাঙালীর এই পরাজয় (আর) করি না করি না করি না ভয়॥’ কালজয়ী আর একটি গানটি পাকিস্তানী শাসন ও শোষণের ভয়ংকর বঞ্চনা প্রকাশ করে যার সঙ্গে আছে শত্রুর প্রতি সাবধান বাণী: ‘ভুখা আর বেকারের মিছিলটা যেন ওই দিন দিন শুধু বেড়ে যাচ্ছে। রোদে পুড়ে জলে ভিজে অসহায় হয়ে আজ ফুটপাথে তারা ঠাঁই পাচ্ছে। বার বার ঘুঘু এসে খেয়ে যেতে দেব নাকো আর ধান, বাংলার দুশমন তোষামোদি চাটুকার সাবধান সাবধান সাবধান।’ গানে পাকিস্তানী কুচক্রের বিরুদ্ধে জ¦লে ওঠার যে ইঙ্গিত ছিল তা স্বাধীনতা সংগ্রামে শিখা শেষ অবধি জ¦ালিয়ে রেখেছিলো। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ গানে আমাদের রক্তবিন্দু স্বাধীনতা পিয়াসী চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো যোজন যোজন দূর: ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল। জেয়ার এসেছে জনসমুদ্রে রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল। বাঁধন ছেঁড়ার হয়েছে কাল, হয়েছে কাল, হয়েছে কাল, হয়েছে কাল।’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সেই ভাষণ পুরো বাঙালী জাতিকে যে সাহসে সাহসী করে তুলেছিলো তা সুরে আন্দোলিত করে তুলেছিলো প্রতিটি হৃদয়: ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি, আকাশে বাতাসে উঠে রণি’ মুক্তিযুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি আমাদের শত্রুরা নানা মুখি অশুভ তৎপরতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে দেশে নানা বিভাজনে অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা এখনো আমাদের নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণামূলক গান লিখতে উৎসাহ দিয়ে যায়: ‘মাগো ভাবনা কেন আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে যুদ্ধ এলে অস্ত্রহাতে ধরতে জানি তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’ মুক্তিযুদ্ধের গান আমাদের শত বছরের বঞ্চনা ও গ্লানি থেকে আমাদের মুক্তি দিয়ে মুক্ত, স্বাধীন, কল্যাণময়, সফল, উন্নত জীবন যাপনে দুয়ার খুলে দিয়েছে। আমরা এখনও শূন্যতায়, না পাবায়, অপরাধী রুখতে মুক্তিযুদ্ধের সেই অমর গানগুলো থেকে আবার সত্য, সুন্দর, মুক্ত, নিরাপদ দেশ, সমাজ পেতে চাই। খুঁজে পেতে চাই সেই নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধাদের মতো আত্মত্যাগীদের কখনো কলুষিত সময়ে; তাই আবার বেজে উঠে: ‘একাত্তরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তি সেনার দল যারা অস্ত্র হাতে ধরেছিলো মাগো তোমার তরে মরেছিলো ও মা যাদের ভয়ে পালিয়েছিলো শত্রু সেনার দল’ সহ¯্র বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পাই। তিনি আমাদের জন্য স্বাধীন দেশ রেখে গেছেন কিন্তু এদেশেরই কিছু বিপথগামী, নরপশু জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো। তাই এখনো আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের গানের চেতনাতেই খুঁজে পেতে চাই: ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই তবে বিশ্ব পেত এক মহান নেতা, আমরা পেতাম ফিরে জাতির পিতা।’ (সূত্র: সহায়ক গ্রন্থ ও ইন্টারনেট)
×