ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একাত্তরের গণহত্যার সাক্ষী কালীগঞ্জ রেলসেতু

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮

 একাত্তরের গণহত্যার সাক্ষী কালীগঞ্জ রেলসেতু

উপজেলার শুভখিলায় অযত্ন, অবহেলা আর উদাসীনতায় মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমিটি চিহ্নিতের দাবি উঠেছে। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পার হলেও এখনও সেই স্থানটিতে স্মৃতিফলক স্থাপন তো দূরের কথা, বধ্যভূমি হিসেবে আজও তা চিহ্নিত পর্যন্ত হয়নি। ফলে ’৭১-এ পাকবাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে বহু বাঙালীর শহীদ হওয়ার ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে অজানাই রয়ে যাচ্ছে। নান্দাইল উপজেলার মুশুলী ইউনিয়ন এলাকায় ময়মনসিংহ-ভৈরব রেলপথে নরসুন্দা নদীর ওপর কালীগঞ্জ সেতুটি অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী স্বাধীনতাকামী নিরীহ লোকজনকে ধরে এনে এই ব্রিজের কাছে হত্যা করা হতো। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও এদের দোসর রাজাকার, আলবদররা দূর-দূরান্ত থেকে লোকজনকে ধরে ট্রেনে করে নিয়ে আসত। এরপর ব্রিজের পাশে তৈরি করা বাংকারে নির্যাতন শেষে হাত, পা বেঁধে ওই ব্রিজের ওপর দাঁড় করিয়ে গুলি করে লাশ নদীতে ফেলে দিত। এখানে কতজনকে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে এলাকাবাসীর ও মুক্তিযোদ্ধাদের অনুমান প্রায় দশ হাজার নিরীহ মানুষকে এখানে এনে হত্যা করা হয়। এলাকার বৃদ্ধ সুজন পাঠান জানান, তিনি নিজ চোখে সেই সময়ের ভয়াবহ হত্যাকা-ের চিত্র দেখেছেন। সুজন বলেন, যদি স্থানটিতে স্মৃতিফলক নির্মাণ না হয় তা হলে আগামী এক দশক পরে নতুন প্রজন্মের কাছে এই ভয়ানক স্মৃতি হারিয়ে যাবে। স্থানীয় বাসিন্দা বাবর আলী জানান, ’৭১ সালে দেশপ্রেমিক জনগণ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর যাতায়াতে বিঘœ সৃষ্টি করতে এ সেতুটি ভেঙ্গে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাকিস্তানী বাহিনী আশপাশের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। আর কিছুদিন পর মানুষ এই স্মৃতি ভুলে যাবে। তাই এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা প্রয়োজন। খামারগাঁও গ্রামের মজুমদার বাড়ির সদস্য শিক্ষক প্রবাল মজুমদার বলেন, তার বাবা ও দুই চাচাকে এ সেতুতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সেতুটির স্মৃতি ধরে রাখতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ প্রয়োজন। তিনি বলেন কি কারণে যে স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও সেতুটিতে কোন ফলক নির্মাণ হয়নি তা বুঝতে পারি না। অবসরপ্রাপ্ত সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল মজিদ বলেন, আমি ও আমার স্ত্রী খাদিজা পাকিস্তানী হানাদারদের গুলিতে আহত হয়ে এখনও তার স্মৃতিচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি। নান্দাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ আশরাফ উদ্দিন ভুঁইয়ার বাড়ি সেতুর কাছেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। আশরাফ উদ্দিন ভুঁইয়া জানান, তারের ঘাট ও শুভখিলা রেলসেতু ধ্বংস করেও পাকিস্তানীদের প্রবেশ রোখা যায়নি। মুক্তিকামী ও সাধারণ মানুষ ভর্তি ট্রেনগুলো থামার পর মানুষ বাঁচার জন্য আর্তচিৎকার শুরু করতো। কিন্তু নিমিষেই গুলির মুহুর্মুহু শব্দে মিলিয়ে যেত সেই চিৎকারের আওয়াজ। তিনি হতাশ হয়ে বলেন, স্বাধীনতার দীর্ঘ দিন পেরিয়ে গেলেও বধ্যভূমিটিতে কোন স্মৃতিফলক নির্মিত হয়নি। সেতুটির পাশে দাঁড়িয়ে আব্দুল কুদ্দুছ বলেন, তার বাবা পাকিস্তানী ভাষায় কথা বলতে পারতেন। নদীতে নৌকা দিয়ে পারাপারের কাজ করতেন তার বাবা। সেই কারণে বাবার সঙ্গে সেতু এলাকায় প্রায়ই অবস্থান করতেন তিনি। ট্রেন এসে থামার পর মানুষকে সেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে বলা হতো। একে একে পেছন দিক থেকে হাত বাঁধা মানুষকে সেতুর ওপর পাঠিয়ে পেছন থেকে গুলি করে নদীতে লাশ ফেলে দেয়া হতো। সেই হত্যাযজ্ঞের স্মৃতি মনে করে এখনও আঁতকে ওঠেন আব্দুল কুদ্দুছ। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডার গাজী আব্দুস ছালাম (বীরপ্রতীক) বলেন, স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও নৃশংসতা চালিয়ে অসংখ্য মানুষকে হত্যার স্থানটি আজও চিহ্নিত করা হয়নি। স্থাপিত হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ভ। স্থানটিতে যাওয়ার জন্য ভাল কোন রাস্তাও নেই। নান্দাইল পৌর মেয়র রফিক উদ্দিন ভূইয়া বলেন, রেলসেতুটিতে যুদ্ধকালীন পুরো সময় ধরে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ট্রেনযোগে বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এনে হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হতো। হাজার হাজার মানুষের হত্যাযজ্ঞ চলে সেতুটিতে। -মজিবর রহমান ফয়সাল, নান্দাইল, ময়মনসিংহ থেকে
×