ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ শেষ নবী (সা) শান্তি সংস্থাপক

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ৩০ নভেম্বর ২০১৮

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ শেষ নবী (সা) শান্তি সংস্থাপক

বিশ্বজগতের জন্য রহমত সাইয়েদুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটে এমন একটা সময় যখন সমগ্র পৃথিবী অজ্ঞতা আর অশান্তিতে ভরে গিয়েছিল। মানবতা বলতে কোথাও কিছু ছিল না। জেএইচ ডেনিসন ‘ইমোশন এ্যাজ দ্য বেসিস অব সিভিলাইজেশন’ গ্রন্থে লিখেছেন : In the fifth and sixth centuries, the civilised world stood on the verge of chaos, it seemed then that the great civilisation which it had taken four thousand years to construct was on the verge of disintegration, and that mankind was likely to return to that condition of barbarism where very tribe and sect was against the next, and law and order was unknown. The new sanctions created by Christanity were working division and destruction instead of unity and order. It was among these people (Arabs) that the man was born who was to unite the whole known world of the East and South. -পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে সভ্যজগত উপনীত হয়েছে নৈরাজ্যের তুঙ্গে, তখন এটাই প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, চার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা বিশাল সভ্যতা বিখ-িত হওয়ার চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং মানবজাতি যেন বর্বরতার চরম অবস্থায় ফিরে গেছে, যেখানে প্রতিটি জাতি ও গোত্র পরস্পরেরবিরোধী ছিল, আইনশৃঙ্খলা বলতে কোথাও কিছু ছিল না। খ্রিস্টধর্মের দ্বারা সৃষ্ট নিত্যনতুন নিয়ম ঐক্য ও শৃঙ্খলার বদলে বিচ্ছেদ এবং ধ্বংসের কাজ করছিল। ...এই জনগোষ্ঠীর (আরবদের) মধ্যে সেই পুরুষপ্রবর জন্মগ্রহণ করলেন, যিনি পূর্ব ও দক্ষিণের সমগ্র জানা দুনিয়াকে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করার জন্য আবির্ভূত হলেন। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আইয়ামে জাহিলিয়াতের অবসান ঘটিয়ে আলোর যুগের উদ্ভব ঘটালেন। তাঁর আবির্ভাবকালটিতে বিশ্বজুড়ে চলছিল মানুষে মানুষে হানাহানি, কাটাকাটি, দুর্বলরা শক্তিধরদের অত্যাচারে, শোষণ ও নির্যাতনে জর্জরিত হচ্ছিল। নারীদের পণ্যসামগ্রীতে পরিণত করা হয়েছিল। তাদের ছিল না কোন অধিকার, ছিল না কোন মর্যাদা। মানবিক মূল্যবোধ বলতে কোথাও কিছু ছিল না। ক্রীতদাস প্রথা প্রকট আকার ধারণ করেছিল। ধর্মের নামে সর্বত্র বিরাজ করছিল শিরক, কুফর, কুসংস্কার, অধর্ম এবং ধর্মহীনতা। সেই অস্থির, অরাজকতাপূর্ণ পৃথিবীতে তাঁর আবির্ভাব ঘটল শান্তির দূত হিসেবে, শান্তি সংস্থাপক হিসেবে। তিনি এলেন সিরাজাম মুনীরা রূপে- প্রদীপ্ত প্রদীপ রূপে, তিনি এলেন রহমাতুল্লিল আলামীন রূপে। তাঁর আবির্ভাবে সত্য-সুন্দরের উন্মেষ ঘটল, প্রবাহিত হলো প্রকৃত শান্তির আলোকধারা। জেমস এ মিসনার ‘ইসলাম দ্য মিসআন্ডারস্টুড রিলিজিয়ন’ গ্রন্থে বলেন : Muhammad the inspired man who founded Islam, was born about A.D. 570 into Arabian tribe that worshipped idols. Then in a series of dramatic and terrifying events, he began to receive through the Archangel Gabriel a revelation of God's word. Like almost every major Prophet before him, Muhammad fought shy of serving as the transmitter of God's word. sensing his own inadequacy. But the angel commended : Read! So far we know, Muhammad was unable to read or write, but he began to dictate those inspired words which would soon revolutionise a large segment of the earth: There is but one God. -হযরত মুহম্মদ (সা) সেই প্রত্যাদিষ্ট মহান ব্যক্তিত্ব যিনি ইসলাম কায়েম করেন। তাঁর জন্ম হয় ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আরবের এমন এক গোত্রে যা ছিল মূর্তিপূজারী। ...জীবনের বাঁকে বাঁকে বহু নাটকীয় ও দুঃসহ ঘটনা তাঁকে অতিক্রম করতে হয়। আল্লাহর কালাম তাঁর নিকট নাজিল হতে থাকে ফেরেশতা জিবরাইল (আ)-এর মাধ্যমে। ...তাঁর পূর্বেকার অধিকাংশ বিশিষ্ট আম্বিয়া কেরামের মতো হযরত মুহম্মদ (সা)-ও নিজের অপর্যাপ্ততার কথা ভেবে আল্লাহর কালাম পঠনে ইতস্তত করছিলেন। কিন্তু ফেরেশতা তাঁকে বললেন : পাঠ করুন (ইক্রা)। আমরা যতদূর জানি হযরত মুহম্মদ (সা) পড়তে বা লিখতে অপারগ ছিলেন। কিন্তু তিনি সেই সমস্ত প্রত্যাদিষ্ট কালাম অন্যদের তিলাওয়াত করে শোনাতে লাগলেন, যা অচিরেই পৃথিবীর একটা বিশাল অঞ্চলে এক মহা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়ন করল। ঘোষিত হলো : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্- আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই।... প্রিয় নবী (সা)-এর মহান জীবনেতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদ মনীষীগণ বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছেন। স্যার টমাস কারলাইল লিখেছেন : A great change what a change and progress is indicated here in the universal conditions and thought of men... . A greater number of God's creature believe in Muhammad's word at this time than in any other word whatever... . Islam means in its way denial of self, annihilation of self. This is yet the highest wisdom that Heaven has revealed to our earth -সে এক মহা পরিবর্তন! কী এক দারুণ পরিবর্তন ও প্রগতি সূচিত হলো মানবকুলের বিশ্বজনীন অবস্থায় এবং চিন্তায়। ...আজকের যুগে আল্লাহর বৃহত্তর সংখ্যক মখলুক অন্য যে কোন বাণীর চেয়ে হযরত মুহম্মদ (সা)-এর বাণী বেশি বিশ্বাস করে। আত্মত্যাগ ও আত্মসমর্পণের মধ্যে ইসলামের অর্থ নিহিত রয়েছে। আমাদের এই পৃথিবীতে নাজিলকৃত আসমানী গভীর জ্ঞানের মধ্যে অদ্যাবধি এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ ও উন্নত। (দ্রঃ Hero and Hero Worship)। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আগমনে বিশ্বচরাচরে যে আলোকিত ও শান্তিময় প্রতিবেশ গড়ে উঠল, এক অনন্য জ্যোতির্ময়তায় শোভিত হয়ে পৃথিবী যে জেগে উঠল, একটি প্রগতিশীল জাতিসত্তার যে উন্মেষ ঘটল সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্যার টমাস কারলাইল বলেন : These Arabs, the man Mohamet and that one century, is it not, as if a spark had fallen, one spark on a world what seemed black unnoticeable sand! But lot The sand proves explosive prowder blazed heaven high from Delhi to Granada. -একটি জাতি নাম তার আরব, একজন মানুষ নাম তাঁর মুহম্মদ (সা) আর সেই একটা শতাব্দী, এটা কি তাই নয় যেন একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, শুধু একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পতিত হলো এমন এক পৃথিবীর ওপর যা দেখে মনে হচ্ছিল ঘনকালো অজ্ঞাত বালুকণা, কিন্তু দেখ, দেখ! সেই বালুকণা বারুদের মতো বিস্ফোরিত হলো আকাশ সমান আলো হয়ে, আর সেই আলোয় আলোকিত হয়ে গেল দিল্লী থেকে গ্রানাডা পর্যন্ত। মনীষী ল্য মারটিন বলেন : If greatness of purpose, smallness of means and astounding result are the three criteria of human genious, who could dare to compare any great man in modern history with Muhammad? The most famous men created arms, laws and impires only. They founded. If anything at all, no more than meterials powers which often crumbled away before their eyes. This man moved not only armies, legislations, empires, peoples and dynasties, but millions of men in one third of the then inhabited world and more than that, he moved the alters. The Gods, the religions, the ideas, the beliefs and souls, on the basis of a Book, every letter of which has become law, he created a spiritual nationality which blended together people of every tongue and of every race. ...Philosopher, orator, aposite legislator, warrior, conqueror of ideams, restorer of rational dogmas, of a cult without images, the founder of twenty terrestial empires and one spiritual empire, that is Muhammed. As regards all standards by which human greatness may be measured. we may well ask, is there any man greater than he? ...উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব, উপায়ের ক্ষুদ্রতা এবং বিস্ময়কর ফলাফল এই তিনটি যদি হয় মানব প্রতিভার মানদ-, তাহলে আধুনিক ইতিহাসে কার এমন ধৃষ্টতা আছে যে, কোন মহৎ ব্যক্তিকে হযরত মুহম্মদ (সা)-এর সঙ্গে তুলনা করতে পারে? অধিকাংশ মশহুর ব্যক্তি শুধুমাত্র সৈন্যবাহিনী গঠন করেছেন, আইন বানিয়েছেন এবং গড়ে তুলেছেন সাম্রাজ্য। তাঁরা যদি কিছু করেই থাকেন তা পার্থিব ক্ষমতার নামান্তর মাত্র, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের চোখের সম্মুখেই ধূলিসাত হয়ে গেছে। এই পুরুষ (হযরত মুহম্মদ মুস্তাফা (সা) কেবল সৈন্যবাহিনী পরিচালনাই করেননি, তিনি কেবল আইনই দেননি, রাজত্ব প্রতিষ্ঠাই করেননি, কেবল জনগণকে সুসংগঠিতই করেননি এবং কেবল সালতানাত সংস্থাপনই করেননি, বরং সেই সঙ্গে তিনি সেই সময়কার পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ কিংবা তারও বেশি জনঅধ্যুষিত এলাকার লাখ লাখ মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আনয়ন করেছেন, বহু দেবতার খপ্পর থেকে তাদের উদ্ধার করেছেন, ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, ভাব ও বিশ্বাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছেন এবং আত্মার বিকাশ ঘটিয়েছেন। একখানি কিতাবের ভিত্তিতে তিনি গড়ে তুলেছেন এক অনন্য রুহানি জাতীয়তা যা প্রতিটি ভাষাভাষী ও প্রতিটি গোত্রের মানুষকে এক সুদৃঢ় ঐক্য সূত্রে আবদ্ধ করেছে। সেই কিতাবের প্রতিটি হরফ আইনে পরিণত হয়েছে। ...দার্শনিক, বাগ্মী, রসূল, আইনদাতা যোদ্ধা, ভাবসমূহ বিজয়ী, যুক্তিসিদ্ধ ধর্মমত উদ্ধারকারী, নিরাকারে ইবাদত আনয়নকারী, কুড়িটি পার্থিব সাম্রাজ্যের এবং একটি রুহানি সালতানাতের প্রতিষ্ঠাকারী হচ্ছেন হযরত মুহম্মদ (সা)। মানুষের মহত্ত্ব পরিমাপের সমস্ত মানদ- জড়ো করে আমাদের একটিই জিজ্ঞাসা : তাঁর চেয়ে মহত্তর কোন মানুষ কি কোথাও আছেন? আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁর প্রিয় হাবীব হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আলোচনাকে তাঁর খ্যাতি ও মর্যাদাকে বুলন্দ করে দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন : ওয়া রাফা’আনা লাকা যিকরাক। (সূরা ইনশিরা : আয়াত ৪)। আমরা দেখতে পাই পৃথিবীর খ্যাতিমান, যশস্বী প-িতজনেরা, মনীষী, ইতিহাসবেত্তা সবাই প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যে বিশ্ব শান্তির মহান দূত, তিনি যে মানবতার মুক্তিদূত, তাঁর দ্বারা পূর্ণাঙ্গ প্রাপ্ত আল্লাহর মনোনীত জীবন ব্যবস্থাই যে বিশ্ব মানবতার জন্য একমাত্র কল্যাণকর জীবন ব্যবস্থা, এটা এমন এক জীবন ব্যবস্থা যাতে দাখিল হতে হলে আল্লাহর ওপর ইমান আনতে হয়, তাঁর ফেরেশতাগণের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়, তাঁর সব রসূলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়, সমস্ত আসমানী কিতাবের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়, রোজহাশরে বিশ্বাস স্থাপন করতে হয় ইত্যাদি। এখানেই ইসলামের বৈশিষ্ট্য। জর্জ বার্নার্ড শ বলেন : If all the world was united under one leader then Muhammad would have been the best fitted man to lead the people of various creeds, dogmas and ideas to peace and happiness. -নানা ধর্মরত, ধর্মবিশ্বাস ও চিন্তাধারার মানুষকে শান্তি ও সুখের দিকে পরিচালিত করার উদ্দেশ্যে যদি গোটা পৃথিবীকে একত্র করে একজন নেতা খোঁজা হয় তাহলে সে জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ও যোগ্যতম ব্যক্তি হবেন হযরত মুহম্মদ (সা)। পৃথিবীতে নবী-রসুল আগমনের ধারাবাহিকতায় প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আগমন ঘটে সবার শেষে। তিনি নবীগণের সমাপ্তি, শেষ নবী। তিনি ইসলামের পূর্ণতা আনয়ন করেন এবং বিশ্বমানব সভ্যতায় স্বর্ণোজ্জ্বল মাত্রা সংযোজন করে এক বিস্ময়কর অবদান রাখেন। তিনি অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি আনয়ন করেন। ইসলামের জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্ হচ্ছে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, সত্য-সুন্দরকে বিশ্বমানবতার হৃদয়গভীরে স্থান করে দেয়ার জন্য, আলোকিত পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য। ইসলাম সন্ত্রাসকে ঘৃণা করে। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : লা তুফ্সিদু ফিল্ ্আরদ- পৃথিবীতে সন্ত্রাস সৃষ্টি কর না। (সূরা বাকারা : আয়াত ১১)। আর ইসলাম শব্দের শব্দমূল সলম-এর অর্থই তো হচ্ছে শান্তি। মুসলিমদের পারস্পরিক অভিবাদন হচ্ছে আস্সালামু আলায়কুম-ওয়া আলায়কুমুস সালাম। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ
×