ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রুত যাওয়ার প্রবণতায় বাড়ছে দুর্ঘটনা

রাজধানীতে লাফিয়ে বাড়ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১০ নভেম্বর ২০১৮

রাজধানীতে লাফিয়ে বাড়ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিনই নামছে নতুন মোটরসাইকেল। তবে গত দুই বছরে এই হার বেড়ে গেছে অনেক। মূলত মোবাইল ফোনের এ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে রাজধানীতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা। গণপরিবহন সঙ্কটের এ শহরে মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং চলতি পথের যাত্রীদের কিছুটা স্বস্তি দিতে পারলেও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা। রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলের কারণেই যে দুর্ঘটনা বাড়ছে- তা নিশ্চিত করে বলার মতো সুনির্দিষ্ট কোন গবেষণা এখনও হয়নি। তবে সংশ্লিষ্টরা এটিকে দুর্ঘটনা বাড়ার একটি বড় কারণ বলেই মনে করছেন। পাশাপাশি চালকের অদক্ষতা, আইন না মানা, দ্রুত যাওয়ার প্রবণতা, নিরাপত্তা উপকরণ না নিয়ে চালানো, রাজধানীর সড়ক সম্পর্কে ধারণা না থাকাকেও দুর্ঘটনার কারণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১৬ সালে ঢাকায় রাইড শেয়ারিং সেবা নিয়ে আসে উবার। প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে শুধু ব্যক্তিগত গাড়ির মাধ্যমে এই সেবার সুযোগ করে দিলেও পরে মোটরসাইকেলও যুক্ত করে। একই সময়ে একে একে আসে পাঠাও, স্যাম, বাহন, সহজ, ওভাই। গত দুই বছরে ঢাকার রাস্তায় মোটরসাইকেল বাড়ার চিত্র পাওয়া যায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যে। প্রতিষ্ঠানটির ঢাকা কার্যালয় থেকে ২০১৬ সালে যেখানে ৫৩ হাজার ৭৩৮টি মোটরসাইকেলের নিবন্ধন দেয়া হয়েছিল, সেখানে ২০১৭ সালে নিবন্ধিত হয় ৭৫ হাজার ২৫১টি। আর এ বছরের অগাস্ট পর্যন্ত ৬৫ হাজার ৩৩২টি মোটরসাইকেলের নিবন্ধন হয়েছে। এ হিসাবে, ২০১৭ সালে ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ২০৬টি মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে। আর এ বছরের প্রথম আট মাসে প্রতিদিন গড়ে ২৬৭টি মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে। তবে রাইড শেয়ারিংয়ে যেসব মোটরসাইকেল চলে তার একটা বড় অংশ ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলার নম্বরপ্লেটধারী। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটর (এআরআই) হিসাবে ২০১৭ সালে রাজধানীতে ৪৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৫৩ জন নিহত এবং ১৯ জন আহত হন। এ বছরের আট মাসেই (জানুয়ারি-অগাস্ট) সেই সংখ্যা প্রায় ছুঁই ছুঁই। এ সময়ে ঢাকায় ৪২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৪৭ জনের মৃত্যু এবং ৩৭ জন আহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় নিহতদের অনেকেই রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলের চালক অথবা যাত্রী ছিলেন। গত ১৭ সেপ্টেম্বর খিলক্ষেতে দুর্ঘটনায় মারা যান লাফিজুর রহমান নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী। ৩ সেপ্টেম্বর রাতে মতিঝিল এলাকায় রিপন শিকদার এবং জানে আলম গাজী নামে দু’জন নিহত হন। এরও আগে ২০ অগাস্ট মোহাম্মদপুরে ট্রাকের ধাক্কায় সোহেল পারভেজ, ৬ জুলাই বিমানবন্দর গোলচত্বরের কাছে নাজমুল হাসান এবং ৬ মার্চ তেজগাঁওয়ের আড়ং চেকপোস্টে কাজী মারুফ হাসান নামে মোটর সাইকেল আরোহী নিহত হন। দুর্ঘটনার জন্য চালকদের অদক্ষতা এবং নিরাপত্তা জ্ঞানের অভাবকে বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন বুয়েটের এআরআইর সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোঃ সাইফুন নেওয়াজ। তিনি বলেন, ‘প্রথমত, রাইড শেয়ারিংয়ের কারণে মোটরসাইকেলের চলাচল বেড়েছে, দুর্ঘটনা বাড়ার এটা একটা কারণ। দ্বিতীয়ত হেলমেট ব্যবহার না করা। মোটরসাইকেল চালকরা সবাই অপেশাদার চালক। তাদের ক্ষেত্রে ড্রাইভিং শিখে আসার বিষয়টা নেই। চালকদের অনেকেই বেপরোয়া, অনেকে দক্ষ হলেও নিরাপত্তা জ্ঞানের অভাব আছে।’ তিনি বলেন, ‘মোটরসাইকেল খুব হালকা একটা বাহন। দুইটা কার বা একটা কারের সঙ্গে রিক্সার দুর্ঘটনা ঘটলে যাত্রীদের মারা যাওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। কিন্তু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। রাইড শেয়ারিংয়ের চালকদের দ্রুত ট্রিপ শেষ করার একটা বিষয় থাকে। এজন্য তারা দ্রুত চালাতে চান। এক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে।’ মাত্র এক ঘণ্টার প্রশিক্ষণেই মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং দেয়া শুরু করেছেন এমন চালকও রয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের মফিজুল হক এমনই একজন। ছয় মাস ধরে রাইড শেয়ার করে আসা মফিজুল হক বলেন, আগে প্রাইভেট কার চালালেও মোটরসাইকেল পারতেন না। ছয় মাস আগে তিনি মোটরসাইকেল কিনছেন। তিনি বলেন, ‘আরেকজন চালাইয়া বাসায় আনছে। হেই দিনই এক ঘণ্টা চালাইয়া শিখছি। এরপর থেইকা রাইড শেয়ার দেই।’ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের নাজমুল হাসান আগে ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। এখন শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ার করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি লার্নার লাইসেন্স নিয়েছি তিন মাস হল। এখনও আসলটা পাইনি। লার্নার দিয়েই মোটরসাইকেল চালাই। কোন সমস্যা হচ্ছে না। শুধু আমি না, অনেকেই লার্নার লাইসেন্স দিয়ে উবার, পাঠাওয়ে মোটরসাইকেল চালায়।’ একবার একটি বড় দুর্ঘটনার পর কিছুদিন লার্নার লাইসেন্স দিয়ে নিবন্ধন বন্ধ থাকলেও এখন আবার দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। ‘দায় আছে’ রাইড শেয়ার কোম্পানিগুলোরও ॥ রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো যে নিবন্ধনের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার বিষয়টি দেখছে না- তা স্বীকার করেছেন শেয়ার আ মোটরসাইকেল (স্যাম) এর প্রধান নির্বাহী ইমতিয়াজ কাসেম। তিনি বলেন, রাইড শেয়ারিংকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন অনেকে। অনেকে গ্রাম থেকে চলে এসেছেন মোটরসাইকেল চালাতে। রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো শুধু লাইসেন্স থাকলেই চালানোর অনুমতি দিয়ে দিচ্ছে। কোনমতে কাগজপত্র তৈরি করেই রাস্তায় নেমে যায়। কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় দুর্ঘটনায় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।’ ইমতিয়াজ কাসেম বলেন, দূরত্ব অনুযায়ী মোটরসাইকেলের ভাড়া কিছুটা বেশি নির্ধারণ করেছে বিআরটিএ। এ কারণে এত লোক এতে আগ্রহী হচ্ছে। আমি শুরুতেই প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া আট টাকা প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু বিআরটিএ প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ১২ টাকা করে দেয়ায় স্বাভাবিকভাবেই আয়ের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এতে আগ্রহ বেড়েছে বাইকারদের। অনেকেই এটাকে স্থায়ী পেশা হিসেবে নিয়েছেন। লাভের ব্যাপার থাকায় চালকরা দ্রুত রাইড শেষ করতে চান, তাড়াহুড়ো করেন। কিন্তু আট টাকা থাকলে লোকজন অফিসে যাওয়া-আসার পথে কারও সঙ্গে রাইড শেয়ার করত। তাড়াহুড়োর কোন ব্যাপার থাকত না।’ পাঠাওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হুসাইন এম ইলিয়াসও স্বীকার করলেন, এর দায় কিছুটা তাদেরও আছে। তিনি বলেন, ‘দায়ভার অবশ্যই কিছুটা আছে। কিন্তু এ খাতে শৃঙ্খলা আনতে হলে সবাইকেই কাজ করতে হবে। আমরা যেহেতু সবাই মিলে কাজ করছি। ফল আসবেই।’ শিক্ষানবিশ লাইসেন্স থাকলেই রাইড শেয়ার করার সুযোগ দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘লাইসেন্স থাকলেই কেউ ভাল ড্রাইভার নাও হতে পারে। যাই হোক, আমরা চিন্তা করছি কীভাবে এ বিষয়টি আরও নিয়মের মধ্যে আনা যায়। এখন আর লার্নার দিয়ে কাউকে রাইড দেয়ার সুযোগ দিচ্ছি না। রাইডারদের জন্য বাড়তি কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় কিনা সেটাও আমরা ভেবে দেখছি।’ নিরাপত্তার জন্য এখন পর্যন্ত পাঠাও দশ হাজার হেলমেট বিতরণ করেছে বলে জানান হুসাইন এম ইলিয়াস। এ বিষয়ে এক লিখিত বিবৃতিতে উবার জানিয়েছে, উবার মটোর পার্টনার হতে হলে একজন চালকের অবশ্যই ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকতে হবে। থাকতে হবে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেটও। এছাড়া দক্ষতা, সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে উবার এক্সেলেন্স প্রোগ্রামের আওতায় চালকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
×